সমৃদ্ধির বাংলাদেশ ও মেহনতি মানুষ

114

বিশ্বে বাংলাদেশের ও বাঙালির পরিচয় ছিল মিস্কিন। একইভাবে ক্যু হত্যা, হত্যার বিচার হবে না এমন আইনও ছিল বাংলাদেশে। দীর্ঘ ২৪ বছর আমরা পাকিস্তানের জংলি জাতির শাসনে ছিলাম। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের পদলেহি দালাল, আমলাসহ অন্যান্যরা ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশটিকে পাকিস্তানের মত চালাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ২১ বছর-এই দেশটি পাকিস্তানের আদলে চলেছে। কু্যঁ হত্যা চলতেই থাকে। বিশ্বে আমাদের মান সম্মান এমন অবস্থায় নেমে আসে যে এটি একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। রাষ্ট্রিয় সম্পদ লুণ্টন চলে। দুর্নীতিতে আমাদের দেশ পর পর ৫ বার চ্যাম্পিয়ান হয়।
১৯৭৪ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রায় বৃহৎ শিল্প লাভের মুখ দেখে। যে সকল শিল্প প্রতিষ্ঠার পর থেকে লাভের মুখ দেখেনি যেমন- আদমজি জুটমিলসহ প্রায় শিল্প লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, সাথে সাথে উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। কোন যাদুমন্ত্রে অলাভবান প্রতিষ্ঠান লাভের মুখ দেখেছে ? জাতির জনক বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প পরিচালনায় দুইজন শ্রমিক প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করেন। শ্রমিক প্রতিনিধিদের শ্রমিকের নিকট দায়বদ্ধতার কারণে সুষ্ঠুভাবে মিল পরিচালনায় প্রশাসনকে সহায়তা করে। সময়মত কাঁচামাল ক্রয় করা, সময়মত যন্ত্রপাতি ক্রয় ও মেরামত করার কারণে উৎপাদন বৃদ্ধি হয়। সাথে সাথে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত ও বিক্রয়ের কারণে এই সাফল্য আসে।
১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দেশ পরিচালিত হতে থাকে। পাকিস্তানি শাসকদের নীতি ছিল বিদেশি সাহায্যনির্ভর। বঙ্গবন্ধুর নীতি ছিল আত্মপ্রত্যয়ী স্ব-নির্ভর জাতি হিসাবে বাঙালি জাতিকে প্রতিষ্ঠা করা। ৭৫ পরবর্তী সরকার লাভজনক রাষ্ট্রয়াত্ত শিল্প পানির দামে বিক্রয় করে দিয়ে হাজার হাজার শ্রমিককে কর্মহীন করে। ভারতে নতুন নতুন পাটকল হয়েছে আর আমাদের দেশে একে একে পাঠকল বন্ধ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প রক্ষার জন্য শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ ১৯৮৪ সালে ঐতিহাসিক আন্দোলন করে। আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প বিক্রি কিছুটা মন্থর হলেও থেমে যায়নি। দেশ ও জাতির প্রতি দায় দায়িত্বহীন সরকার শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সাথে চুক্তি করেও চুক্তি মানেনি।
১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বিক্রয় থামিয়ে দেয় এবং ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প পরিচালনায় শ্রমিকদের নিকট ছেড়ে দেয়, ইতিপূর্বে যে সকল রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বিক্রয় করা হয় সে সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের মালিকেরা তাদের ব্যবসার স্বার্থে জুট-টেক্সটাইল এর জমির উপর কন্টিনার টার্মিনাল, আবাসিক প্রকল্প করে।
গার্মেন্টস শিল্পসমগ্র জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন এনে দেয়। গার্মেন্টস শিল্পে প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমিক কর্মরত। প্রায় ৮০% শতাংশ মহিলা। যে মহিলারা কেবল সংসারের কাজে নিয়োজিত ছিল তারা দেশের অগ্রগতিতে অর্থনৈতিকভাবে চালিকাশক্তিতে এসে গেছে। পাট, চা, চামড়া আমাদের একমাত্র রপ্তানি পণ্য ছিল। বর্তমানে গার্মেন্টস শিল্প আমাদের প্রধান রপ্তানিপণ্য। আমাদের রপ্তানিপণ্যের তালিকায় অন্যান্য পণ্যও যোগ হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অতীতের সকল সময়ের চেয়ে অতি-উত্তম অবস্থায় আছে। উন্নত দেশ হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা সময়ের ব্যাপার মাত্র এই সাফল্যের একমাত্র দাবিদার এদেশের মেহনতি শ্রমিক-কৃষক এবং বিদেশে কর্মরত আমাদের শ্রমজীবী বাঙালিদের। সর্বোপরি দেশপ্রেমিক সততার মূর্তপ্রতীক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্ব।
মেহনতি মানুষের শ্রমে দেশ দারিদ্র্যমুক্ত। মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলে ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্পে সরকারের তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। যেটুকু নিয়ন্ত্রণ কেবল শ্রম আইনের বিধানমতে। অনেক মালিক শ্রম আইনের প্রতি নজর দেয়না। শ্রম দপ্তর কলকারখানা অধিদপ্তরের যে ক্ষমতা তা দিয়ে মালিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কারণ শ্রম-অধিদপ্তর ও কলকারখানা প্রতিষ্ঠানের নিকট কোন ম্যাজিস্ট্রেট নেই বা তারা সরাসরি আইন ভঙ্গের জন্য কিছুই করতে পারে না। আইন ভঙ্গ করলে মামলা করে শ্রম আদালতে। মামলার রায় মালিকের বিরুদ্ধে গেলে তারা হাই কোর্টে রিট মোকদ্দমা করে স্থগিত করে দেয়। হাইকোর্টে মামলা চালানোর কোন ব্যবস্থা শ্রম অধিদপ্তর অথবা কলকারখানা অধিদপ্তরের তেমন নেই বললেই চলে। একইভাবে কোন শ্রমিক বা সিবিএ অথবা বেসিক ইউনিয়ন মালিকের অসদ শ্রম আচরণের জন্য অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে মামলা করে সে মামলায় নিষ্পত্তি হওয়ার পূর্বে শ্রমিক অবসর জীবনে চলে যায়, অথবা সিবিএ-বেসিক ইউনিয়নের ততদিনে নেতৃত্ব পরিবর্তন হয়ে যায়।
শ্রম আদালত জেলা জজের ক্ষমতাসম্পন্ন। শ্রম আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করার আইনগত অধিকার। শ্রম আপিল ট্রাব্যুনাল সর্বোচ্চ আদালত। দুঃখের বিষয় অধিকার হরণ করা হয়েছে বলে মালিকেরা রিট মামলা করে শ্রমিকদের হয়রানি করেন। শ্রমিকদের পক্ষে হাইকোর্ট সুপ্রিম কোটে মামলা চালানোর মতো অবস্থা না থাকার কারণে দুখে দুখে মরতে হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৪র্থ বারের মত গণরায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন। দেশের সমৃদ্ধির অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এটাই প্রত্যাশা।
ভরসা এই কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসন আমলে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে কোন শ্রমিককে প্রাণ দিতে হয়নি। সারের দাবিতে কোন কৃষকের প্রাণ কেড়ে নেয় নি। মজুরি বৃদ্ধির দাবি করার পূর্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মজুরি বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেন।
নির্বাচনী ইশতেহারে জননেত্রী শেখ হাসিনা ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ এর ৪৬ পৃষ্ঠায় শ্রমিক কল্যাণ ও শ্রমনীতি সম্পর্কে জাতির নিকট সাফল্য ও অর্জন সম্পর্কে উল্লেখ করেন। সংবিধানের আলোকে এবং আইএল ও কনভেনশন অনুযায়ী শ্রমনীতি ও শ্রমিক কল্যাণে বহুমুখী পদক্ষেপ বাস্তবায়নে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।
জুট মিল কর্পোরেশনের ৬১ হাজার ৯৫ জন চাকুরী টলমল অবস্থায়। ইশতেহারে লক্ষ্য ও পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়- রপ্তানি বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় খাত হিসাবে পাটজাত পণ্যের রপ্তানিতে আর্থিক প্রণোদনা অব্যাহত রাখা হবে। ৬১ হাজারেরও অধিক শ্রমিক আশার আলো দেখছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশে পাটশিল্প সমৃদ্ধ হচ্ছে। আমাদের দেশে না হওয়ার কারণ উৎঘাটনে কেবল সরকারি কর্মকর্তা নয় সাথে নির্বাচিত সংসদ সদস্য শ্রমিক প্রতিনিধি নিয়ে পরিচালনা বিবেচনা করা যায়। সমৃদ্ধির বাংলাদেশ গড়তে শেখ হাসিনার নির্দেশিত পথে মেহনতি মানুষ এগিয়ে যাবে।

লেখক : উপদেষ্টা মহানগর আওয়ামী লীগ,
বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা