সব হারিয়ে পুরো নিঃস্ব ৪শ গরিব মানুষ

69

বস্তির ছোট ছোট ঘরগুলোতে রচিত হত ছোট ছোট স্বপ্ন। মাসশেষে পারিশ্রমিকের যৎসামান্যটুকু জমা রাখতেন স্বপ্নগুলো পূরণের জন্য। হয়ত বালিশের নিচে, নতুবা ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর কাছে। এক সর্বনাশা আগুনের ভয়ঙ্কর রাত কেড়ে নিয়েছে তাদের স্বপ্ন পূরণের সব অবলম্বন। এমনিতেই গরিব এ মানুষগুলো এখন সব হারিয়ে পুরোপুরি নিঃস্ব। তারা খোলা আকাশের নিচে আহাজারি করছেন। তাদের ঘিরে ক্ষুধা আর আতঙ্কে কান্নাকাটি করছে অবুঝ শিশুরা। সরকারি খাস জমি দখল করে সিন্ডিকেটের গড়ে তোলা বস্তিতে ভাড়ায় থাকতেন এসব দরিদ্র মানুষ।
গতকাল দুপুর বেলা, তখনো চোখের জল শুকায়নি কারোর। এরমধ্যে দখলদাররা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ফের জায়গা দখলে। বাঁশের বেড়া, টিন দিয়ে তাড়াতাড়ি ঘিরে ফেলছেন। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ বস্তি এলাকায় সবচেয়ে প্রভাবশালী হলেন ফরিদ চেয়ারম্যান ও তার ভাইয়েরা। তাদের দখলে রয়েছে প্রায় ১ একর জায়গা। এতে রয়েছে দুইশতাধিক ঘর। ফরিদ চেয়ারম্যানের পুরো ফ্যামিলি আমেরিকায় থাকেন। বস্তির সবকিছু দেখাশোনা করেন কেয়ারটেকার ছগির মেম্বার। এছাড়াও প্রভাবশালী আক্তারের সাথে রয়েছে আরও ৪০ জনের সিন্ডিকেট। তাদের দখলে রয়েছে শতাধিক ঘর।
আগুনে পুড়ে যাওয়া ভেড়া মার্কেট সংলগ্ন বস্তির ৫ সারির প্রত্যেকটিতে ৩৬টি করে ঘর ছিল। আবার এর সাথে দোকান ছিল প্রায় ১৫টি। সাথে লাগানো ফরিদ চেয়ারম্যান কলোনিতে রয়েছে আরও ২শ ঘর। সে কলোনির ৪৩টি ঘর পুড়েছে, বাকিগুলোতে আগুনে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এ বস্তিতে প্রতিটি ঘরের ভাড়া ছিল ১৫শ থেকে ২ হাজার টাকা। দোকানগুলো ভাড়া আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা। আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হয়েছে বস্তির ২২০ ঘরের প্রায় চার শতাধিক মানুষ।
গতকাল দুপুরে সরেজমিনে গেলে একটি ফোনালাপ মনোযোগ কাড়ে। ফরিদ চেয়ারম্যান কলোনির ছগির মেম্বার ফোনে বলছিলেন, আগুন তো আমাদের কলোনিতে আসার সিন্ধান্ত ছিল না। পরে তার পাশে গেলেই ফোন রেখে দেন। কথা হলে তিনি জানান, পাকিস্তান আমল থেকে ফরিদ চেয়ারম্যানের বাবা এসব জায়গা দখল করেছেন। তারই সূত্র ধরে চেয়ারম্যানরাও দখল করে রেখেছেন। তারা সবাই আমেরিকা থাকেন। তবে দেশের সবকিছু দেখাশোনা আমি করি। মামলা চলছে, শীঘ্রই এসব জায়গা চেয়ারম্যানরা পাবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার, চাল, ডাল, পরনের কাপড়, কাঁথা-বালিশ সব কেড়ে নিয়েছে সর্বনাশা আগুন। হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের সুরুজ মিয়ার স্ত্রী রহিমা (৫৫) ওই বস্তিতে বসবাস করে আসছিলেন এক যুগের বেশি সময় ধরে। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করার পর ওই বস্তিরই আরেক ঘরে থাকতে শুরু করেন। তিন মেয়ে নাজমা আক্তার (১৬), নার্গিস (৯) ও নাসরিন (৫) এবং ছেলে জাকিরকে (১০) নিয়ে বস্তির দুটি ঘরে ছিল রহিমার সংসার। বস্তির পাশে একটি দোকান চালাতেন তিনি। রহিমার ছোট ভাই পেশায় শ্রমিক মো. আকবরও একই কলোনিতে ভাড়ায় থাকেন। ভোরের আগুনে ঘর পুড়লেও প্রাণে বেঁচে গেছেন আকবর ও তার স্ত্রী।
পূর্বদেশকে আকবর বলেন, আগুন লাগার পর মেজ মেয়ে নার্গিসকে নিয়ে বের হয়ে আসে আপা। পরে ছোট মেয়েকে আনতে ভেতরে গেছিল। কিন্তু আর বের হতে পারেনি। ওই কলোনির বাসিন্দা হোসনে আরা স্থানীয় বিভিন্ন বাসায় বুয়ার কাজ করেন। এক হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় বস্তির একটি ঘরে থাকতেন তিনি। গভীর রাতে লোকজনের চিৎকারে ঘুম ভাঙলে হোসনে আরা বুঝতে পারেন, বস্তিতে আগুন লেগেছে। বাইরে এসে দেখতে পান, কলোনির ভেড়া মার্কেট অংশের দিক থেকে ছড়িয়ে পড়ছে আগুন। হোসনে আরা বলেন, প্রাণ হাতে নিয়ে আমরা বেরিয়ে এসেছি। ঘর থেকে কিছুই আনতে পারিনি। আগুনে আমাদের সব গেছে। থাকার জায়গাটাও শেষ হয়ে গেছে।
রহিমার ঘরের কাছেই ছিল স্বামী পরিত্যক্তা আয়েশা আক্তারের (৩৭) ঘর। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর আয়েশা ও তার বোনের ছেলে সোহাগের (১৯) পোড়া লাশ উদ্ধার হলেও তার নিজের মেয়ে ঋতু আক্তারের (১২) কোনো খোঁজ পাননি স্বজনরা। ওই কলোনিতে ডিমের পাইকারি দোকান ছিল মো. কামলের। আগুন থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলেও হিসাবের বই আর দোকানের মালপত্র কিছুই বের করতে পারেননি। তার পাশে মুদির দোকান করতেন বাবুল। দোকানের সাথে লাগানো ঘরেই থাকত বাবুলের পরিবার। ঘরে থাকা নগদ ১ লাখ টাকা এবং দোকানে প্রায় ২ লাখ টাকার পণ্যের সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।