সফলতার উপকরণে দৌড় এবং হারুকি মুরাকামি

122

একেকটা সময় একেকটা বিষয়ের উদয় হওয়া মানে নতুনত্ব জড়িয়ে যাচ্ছে আপাত সময়ে। সময় খোলস রেখে অথবা খোলসের খোলাসায় সম্মুখের জঞ্জাল পদদলিত করে অথবা ভেঙ্গে যাওয়া সাঁকোর পিঠে চড়ে সময়ের পাখা ঘুরানোর নাম সর্বস্ব এক সৌন্দর্যের কাছে ভরসা রাখে মানুষের অথবা সময়ের স্বপ্ন। স্বপ্নের চারা রোপন করার মোক্ষম সময় বের করতে জানার নাম সার্থকতা। লেখক মানেই শিল্পের কাছে দায় হয়ে যাওয়া। শিল্প মানে লেখকের সব সুন্দরে একীভ‚ত হয়ে বিচরণ শীল মায়ার কানন পরিচর্যা করা মাত্র। একজন লেখকের হাসির ভেতর পৃথিবীর সব দুঃখ যেন আপন মহিমায় উদ্ভাস হওয়ার পখ খোঁজে। ইচ্ছের কাছে নুয়ে যায় শব্দ নামক এক কঠিন বারুদ বা আশার দ্যুতি। বেড়ে ওঠা সুন্দর আর বেড়ে ওঠা ইচ্ছে কিন্তু এক জিনিস না হলেও দুটোই ইচ্ছের কাছে ধরাশায়ী।
একটা বিষয়কে সবার সামনে গ্রাহ্য করে উপস্থাপন করার নাম কিন্তু শিল্প। এ শিল্পের ঢঙে চড়ে টগবগ করে শব্দ আর বাক্যের আশ্চর্য মেলবন্ধনের বয়ন শক্তি একজন পাঠককে বসিয়ে রাখে ঘন্টার পর ঘন্টা।পাঠক মাত্রই পুলকিত দাস। লেখক মাত্রই মঞ্চের প্রাণ সতেজ রাখা এক যাদুকর অথবা ক্যানভাসার। যে লেখক যত মজা করে বয়নের ধারাবাহিকতা রাখতে পারবে সে লেখক ততোটাই পাঠকের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ পাবেন। পাঠক মাত্রই স্বাদ আস্বাদন প্রাণী।
– আসলে অন্য কাউকে হারানোর বিষয়টা আমার ভেতর কাজ করে না। বরং নিজের জন্য যে লক্ষ্য স্থির করি, সেখানে পৌঁছানোর ব্যাপারে বেশী আগ্রহী আমি, এই হিসেবে দীর্ঘ দূরত্বের দৌড় আমার মানসিকতার সঙ্গে যখার্থ মানানসই।
কত চমৎকার দুটো লাইন। যেখানে এসময়ে এসে আমরা একে অপরের বড়ত্বের হিংসায়, সমালোচনায় এবং ল্যাঙ মারার সুকৌশল আবিস্কার উত্তর পরিকল্পনা এঁটেই চলি সেখানে একজন লেখক মানবিক লেখকের হাত ধরে তার পাঠককে কতভাবেই না পরিবর্তনের শিষ্টাচার তুলে দিচ্ছেন! লেখক মানেই বিবেকের সঠিক চারা রোপনকারী। সময়ের সদব্যবহারকারী। যাপিত জীবনের সূত্র এঁটে সুন্দরের চর্চা বাড়ানো।
‘দৌড় বিষয়ে যত কথা’ হারুকি মুরাকামি র একটি চমৎকার ভিন্ন প্যাটার্নের বই। বইটির বাংলাদেশে অনুবাদ করেছেন কবি ও ভ্রমন লেখক ফারুক মঈনউদ্দিন। বইয়ের নাম দেখে আর অনুবাদকের চয়েস দেখে আমার কাছে বেখাপ্পা মনে হয়েছে। দৌড় একটা সাবজেক্ট হতে পারে! তাও আবার বিশ্বখ্যাত লেখক হারুকি মুরাকামির। যিনি নোবেলের পাঠক প্রিয়তা ধরে শীর্যস্খানে অর্ধযুগ দখল করে আছেন। তাঁর মতো লেখকের পাকা হাতে লেখা বইটির অন্বুাদে হাত দিলেন বাঙলা সাহিত্যের আরেক জানু লেখক। তাই আগ্রহটা যতটুকু বাড়তেছিল তারচেয়ে বেশী রোমাঞ্চে ছিলাম ভেতরের পাঠ অনুরণনে। আসলে একজন জাত লেখক জানেন পাঠককে কোন মসলা অথবা কোন্ যাদুবলে বসিয়ে রাখতে হবে। বিচক্ষনতার জায়গা দখল করে সম্মুখে পথ বাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে লেখক মুরাকামি বলে গেলেন নিজের কথা, ইচ্ছের কথা, সুন্দর চর্চার কথা, একজন দায়িত্বশীল হওয়ার কথা।
পুরো বইটিতে একধরণের নষ্টালজিক ভর করে আছে। পাঠকমাত্রই যে প্রেম ভালোবাসা অথবা নৈতিকতা এবং প্রকৃতি নির্ভর হয়ে থাকতে চান লেখক মুরাকামি যেন তাই ভাঙতে বসেছেন। সফলও হয়েছেন। তবে বইটিতে কনফিডেন্সের কথাই বার বার এসেছে। সে যে কাজই হোক না কেন, কাজের প্রতি ব্যক্তির মনোনিবেশের বিষয় একাগ্রতা এবঙ অধ্যাবসায় যেন সঠিকভাবে নিরুপিত হয় তা লেখক টেনে টেনে বার বার এনেছেন। লেখক নিজেই দৌড়টাকে জীবনের ব্রততায় নিতে গিয়ে অনেক সত্যের ও কষ্টের মুখোমুখি হয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, চেষ্টা-ইচ্ছে, ধৈর্য এবং পরিশ্রম ছাড়া লক্ষ্যপানে পৌঁছা কোনমতেই সম্ভব নয়। বইটিতে লেখক সফলতার গল্পই এঁকেছেন। গল্পবলার ঢঙ অত্যান্ত চমৎকার।
একজন মানুষের মতো একজন লেখক। কিন্তু প্রতিটা মানুষ বা প্রতিটা লেখকের এইম কিন্তু এক রকম নয়। তবে ব্যতিক্রমও আছে। কিছু লেখক এবঙ কিছু মানুষ আছে – যারা নিজেদের ভবিষ্যৎ এইম ঠিক করে সম্মুখের পথ পরিক্রমা প্রস্তুত করেন। এই প্রস্তুত প্রণালীর সূত্রাবলী ঠিক না হলে যে কোন এ্যাইম বিফলে যেতে বাধ্য। সে রকম সূত্রাবলীই আলোচ্য বইটিতে হারুকি মুরাকামির লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা বলা যেতে পারে। একজন লেখক অথবা একজন পাদ্রী চান নিজের মত প্রকাশ অথবা নিজের দর্শন প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা। তবে কিছু মানুষ অথবা কিছু লেখক নিজেকে সফলতার চাবিকাঠির কাছে নিয়ে যেতে নিজের কিছু সত্যাসত্য প্রতিষ্টা করার চেষ্টাও রাখেন। তদ্রুপ হারুকি মুরাকামির ‘দৌড় বিষয়ে যত কথা’ বইটি পুরোটািই একটা মানুষের চেষ্টা, নিয়মঅনুবতিতা, ধৈর্য এবং শেষ ডেটলাইন পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার একটা সফল কিচ্ছাও বলা যায়। লেখকের ভাষায়- আমার লক্ষ্য দৌড়ের দূরত্ব বাড়ানো, গতি বড় একটা বিষয় নয়।একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব দৌড়াতে পারাটাই আমার মূল লক্ষ্য। কখনো মনে করলে দ্রুত দৌড়াই, কিন্তু লম্বা পা পেলে দৌড়ালে সময় কমিয়ে দেই, যাতে প্রতিটি দৌড়ের শেষে যে উল্লাস অনুভব করি, সেটির রেশ পরদিন পর্যন্ত বহমান থাকে।
অর্থাৎ যে কোন কাজ পরিকল্পনার চক যেমন আঁকা হবে তেমনি কাজের প্রতি মনোনিবেশের ধারাবাহিকতা ঠিক রাখার চেষ্টাই সফলতার মাপকাঠিও বটে। তবে লেখক হারুকি মুরাকামি এ বইটিতে দৌড় বিষয়ক এর ফাঁকে তার পারিবারিক জীবন, ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ এবং ভেতরের এক সুন্দরের সৌন্দর্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তার ভাষায় – আমার একমাত্র শক্তি ছিল এতটাই যে, আমি কঠোর পরিশ্রম করতে পারি, আর তাই শারীরিকভাবে অনেকটুকু ভার নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। রেসের ঘোড়ার চেয়েও বেশী এক কাজের ঘোড়া আমি। আমি বড় হয়েছিলাম একটা বাবু পরিবেশে। তাই ব্যবসায়িক উদ্যোগ সম্পর্কে বেশী কিছু জানা ছিল না, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমার স্ত্রীর পরিবার একটা ব্যবসা চালায়, তাই এ বিষয়ে ওর সহজাত জ্ঞান ছিল এক বড় সহায়।
লেখকের বেড়ে ওঠা আর স্বপ্নের সামিয়ানার জায়গা তৈরি করার ফাঁকে ফাঁকে বার ব্যবস্যা এবং হোটেল ব্যবসা চালিয়ে যেতেন প্রয়োজনের তাগিদে। কিন্তু এ প্রয়োজনের কঠিন সহযোদ্ধা ছিলেন তার স্ত্রী। লেখক নিজেই সাবজেক্টের নায়ক হয়ে গল্পের আদলে ভিবিন্ন তিক্ততা, আনন্দ, রোমাঞ্চের বর্ণনায় করতে করতে পাঠককে বসিয়েছে রোমাঞ্চের সহজিয়া পরিবেশে। যে পরিবেশে পাঠক মাত্রই রস আস্বাদনে নিবেদন রেখে ঢেউক তুলতে বাধ্য হয়। লেখার ফাঁকে ফাঁকে স্ত্রীর সাহায্যকে কখনো রোমাঞ্চে, কখনো বড় করে দেখিয়ে পারিবারিক জীবনের সোহার্দ্যতা গড়ে তোলার চিহ্নও এঁকে যাচ্ছেন।
নিজের প্রতি দৃঢ়আত্মবিশ্বাস নিয়ে বড় হতে পারার মাঝে যে কোন ব্যক্তির আনন্দ থাকে। যদি উপলব্দিময় ইচ্ছেশক্তির ছোঁয়া ঘ্রাস করতে পারে। লেখক নিজের লেখা একটি পান্ডুলিপি নির্বাচন নিয়ে দৃঢ়তার পরিচয়স্বরুপ দুইশ পৃষ্ঠার পান্ডুলিপির ডুপ্লিকেট কফি না রেখেই একটি সাহিত্য পত্রিকার নবীন লেখক পুরস্কারের জন্য পাঠান। যা অবাক করা বিষয়। হারুকি মুরাকামির ভাষায়- ‘পাঠানোর আগে কোনো অনুলিপিও রাখিনি, যেন মনোনীত হোক বা চিরতরে হারিয়ে যাক, তা নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা নেই আমার। এটাই সেই কাজ, যেটা জিয়ার দ্যা উইন্ড সিং নামে প্রকাশিত হয়েছিল।দিনের আলো দেখুক বা না দেখুকর, কার চেয়ে আমি বেশি আগ্রহী ছিলাম কাজটা শেষ করতে।’ এরি নাম কাজ ও কনফিডেন্স। আসলে লেখক এই বইটিতে মুলত কাজের প্রতি মনোনিবেশটাকে বেশী গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন। পাঠকমাত্রই নিশ্চিত পুলকের জায়গায় পুলকিত কাঁচামেহেদির ঘ্রাণের মতো।
লেখক মুরাকামির এ বইটিকে আমি শিখ খেরার তুমিও জিতবের চেয়ে অনেক বেশী বাস্তব মনে করছি। বইটিতে একটি জীবন্ত প্রাণ আছে। যে প্রাণে মানুষ কই মাছের মতো চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারলে সফলতা আসবেই। তবে কই মাছের প্রাণ থাকলেও মানুষের প্রাণের মতো নয়। তবে চেষ্টা ধরণ ভিন্ন। যেমন কই মাছকে কাটাকুটি করে কড়াই এ দেয়ার পরও সে তার পাখনাবিহীন শরীরটাকে নাড়ানোর আদলে বাঁচার ব্যর্থ প্রয়াস চালায়। অথচ মানুষ কই মাছের চেয়ে শক্তিশালী। মুরাকামির ভাষায়- ‘আমি এমন একজন মানুষ যে, যা-ই কিছু করি না কেন, তাতে সম্পূর্ণ অঙ্গীকার থাকতে হবে। আমি উপন্যাস লিখব আর অন্য কেউ ব্যবসা চালাবে, এমন বুদ্ধির কাজ করতে পারিনি। আমার যতটুকু আছে তার সবটুকুই লোয় দিতে চেয়েছি। যদি ব্যর্থে হতাম, মেনে নিতে পারতাম। কিন্তু যদি উৎসাহহীনভাবে কিছু করতে গিয়ে ব্যর্থ হতাম, তাহলে প্রতিনিয়ত অনুশোচনা করতে হতো আমাকে।’ লেখক দৃঢ়প্রত্যয়ের আশ্রয় নিয়েছেন বলে আজ বড় মাপের লেখক হয়ে লক্ষ লক্ষ পাঠকের মধ্যমনি হয়ে পুরো পৃথিবীর স্বাদ গ্রহণ করে চলেছেন।
লেখক তার জীবনের একটা দীর্ঘতা আবিস্কারের দ্বিতীয় স্টেপ হিসেবে নিয়েছেন প্রত্যেহ ব্যায়াম নামক দৌড়ের রেস,ম্যারাথন, সাইক্লিং এবঙ ট্রায়াথলিন এর মতো প্রশিক্ষণ। তবে কিছু কিছু প্রশিক্ষণ টেকনিক্যাল কারণে অনাগ্রহের সাবজেক্ট মনে করে এড়িয়ে গেছেন। যেমন সাইকেল ট্রেকিং নিয়মে থাকতে হবে তার ব্যাত্যয়ে প্রশিক্ষণার্র্থীর জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই অনেক কিছু ভেবে মুরাকামি দৌড় প্রতিযোগিতার আড়ারে নিয়মিত দৌড়ের রেস বাড়ানো এবং বিভিন্ন প্ল্যালেসের সাথে মানিয়ে উঠার নাম করে নিজেকে ব্রতপুরুষে রুপান্তরের এক কোচিং চালিয়ে গিয়েছেন। আবহাওয়া যেমনই হোক সব পরিবেশে নিজেকে এ্যাডজাষ্ট করার হেকমতের দরিয়া পুষেছেন। এবং সফলতাও পেয়েছে।
দৌড় ম্যারাথন এর জন্য যে পরিমাণ নিয়মিত শরীরের
কসরত তথা ব্যায়াম করতে হয় তা একজন ব্যক্তির সুস্থ থাকাও নির্ভর করে। ব্যায়াম শরীরের পেশিকে সতোজ রাখে, নার্ভসগুলোকে সচল করে গতিশীলতা বাড়ায়। এবং বৈজ্ঞানিক ক্রিয়ায় মানুষের দেহের কার্যক্ষম ক্ষমতা যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি সুস্থ থাকার দীর্ঘতা বৃদ্ধি পায়। ডাক্তারি ভাষায় ব্যায়াম একটা চরম মেডিসিনও বটে। তাই পেশির সুস্থতা নিশ্চিত করতে হবে বেঁচে থাকার জন্য। লেখকের ভাষায়- আমাদের পেশিগুলো বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন।যতক্ষণ পর্যন্ত ঠিক পথে নিয়ে যাওয়া হয়, অভিযোগ করে না।
আর এ চাপ যদি অল্প কয়েক দিনের জন্য থেমে যায়,পেশিগুলো আপনাআপনিই ধরে নেয় যে তাদের আর কঠিন পরিশ্রম করতে হবে না, তখন তারা তাদের ক্ষমতার উর্ধ্বসীমাটা নামিয়ে ফেলে। পেশীগুলো হচ্ছে প্রাণীর মতো,চাপ না দিলে নিজের কাজকে যখাসম্ভব সহজভাবে নেয়,তখন কেবল বিশ্রাম নেবে আর মুছে ফেলবে সব কাজের স্মৃতি।
এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহ‚র্তে আমাকে পেশিদের বুঝিয়ে দিতে হয়, প্রভু কে? ওদের (পেশী) কাছে পরিস্কার করতে হয়, আমি কী চাই।
হারুকি মুরাকামির এ বইটি একটি জীবন্ত গাইডলাইনও বটে। একজন লেখকের কতটুকু পরিমাণ ধৈর্যশীল হতে হবে তার একটা পরিমাপ দৌড় বিষয়ক বইটি। অনেক পথ পরিভ্রমণ করতে জানার মাঝে কিছু শৈল্পিকতাও থাকে। সেটুকু আত্মস্থ করার মাঝে সফলতা নিশ্চিত নির্ভর করে। কী পরিমাণ নিয়মানুবর্তিতা থাকা দরকার তা যেন এই বইটি পাঠের অংশে বুঝা যায়।
হারুকি মুরাকামি সাহিত্যে তার অগ্রজদের প্রতিও বিনয়ী এবং শ্রদ্ধাশীল। এটাও কিন্তু শিষ্টাচার ও আদব। যে বা যাদের আদব থাকে তারা যেমন সম্মানিত হয় তেমনি বড়ও হতে পারে। স্বপ্নের জায়গাগুলোর পরিসর বড় হতে বাধ্য। অগ্রজদের প্রতি তার কর্তব্যটুকু হলো- সৌভাগ্যবানদের যে জলধারে তা কখনোই শুকিয়ে যায় না, কতবার এখান থেকে জল তোলা হলো, তাতে কিছু যায় না। সাহিত্যিকের জন্য এটা এমন কিছু, যার জন্য কৃতজ্ঞ থাকতে হয়। শেক্সপিয়ার, বালজাক বা ডিকেন্সের মতো ব্যক্তিত্বদের বাদ দিয়ে সাহিত্যের ইতিহাস কল্পনা করা কঠিন। এসব বিশাল আকারের মানুষেরা শেষাবধি বিশালাকৃতিরই থাকেন- ব্যতিক্রমী কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব। বাকি বেশির ভাগ লেখক যারারা এই উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেন না, (অবশ্যয়ই আমিসহ) তাঁদের যে কোনো উপায়ে সম্ভব মেধার ভান্ডারে যে অভাব থাকে, তার ঘাটতি পূরণ করতে হয়। অন্যথায় তাঁদের পক্ষে কোনো মানসম্পন্ন উপন্যাস লিখে যাওয়া সম্ভব হয় না।
এই হলো একজন বাস্তবিক লেখকের বিশ্বাস এবঙ কনফিডেন্স। তবে কনফিডেন্স তৈয়ার করার বিশাল একটা মাপকাঠির ক্লাসও বলা যায়। নিজের বিশ্বাস ও আস্থার প্রতি দৃঢ়তার প্রতিচ্ছায়া রেখেই মুলত তিনি সম্মুখে হাঁটেন। ফলে বিজয়ের উচ্ছাসিত ফেুায় তিনি চুমুক রাখেন। চুমুকের ধরণ টা ঠিক এমন- আমি চোহদ্দিওয়ালা একজন লেখক- অপূর্ণ জীবনযাপনকারী একজন অপূর্ণ মানুষ- তবু আমি ভাবি যে এভাবেই জীবনের পরিপূর্ণতা আসে। এটাকে অলৌকিক কিছু বললে অতিশয়োক্তি মনে হতে পারে,তবে আমি এভাবেই ভাবি। আর প্রতিদিনের দৌড় যদি আমাকে এই পরিপূর্ণতায় সাহায্য করে, তাহলে আমি দৌড়ের প্রতি কৃতজ্ঞ।
একজন লেখকের বেড়ে ওঠা কাজের বর্ণনার একটা অংশও বলা চলে দৌড় বিষযে যত কথা বইটি। একজন পরিশ্রমী মানুষ অথবা একজন সফল মানূষে পৌঁচতে যে রুটিনের উর্ধ্বগতি তা পরিরিসংখ্যান দেখলে পাঠক মাত্রই আত্মস্থতা পাবে। যেমন – জুন মাসে ১৫৬মাইল, জুলাই মাসে ১৮৬ মাইল, আগস্ট মাসে ২১৭ মাইল, সেপ্টেম্বর মাসে ১৮৬ মাইল এবং খোদ একদিন ৬২ মাইল দৌড় করে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন।
একজন লেখক কত ভাবেই না পাঠককে নিয়ে মজা মারেন! মানে পাঠককে বসিয়ে নিজের লেখার গভীরতার গভীরতা খোঁজেন। খোঁজেন বিশ্বাসের একপরিধি। যে পরিধির জন্য লেখকের আবির্ভাব। যে পরিধির ভেতরগন্ধে লুকিয়ে থাকে একধরণের চাপাসুর। যে সুরের মূর্ছনায় একজন কথাসাহিত্যিক কাঁথা মোড়ানো ফেলে শরতের সবুজ ঘাসে এসে কাশফুলের মিহিতায় সিক্ততা প্রত্যাশা করেন। একটি ব্যতিক্রম বিষয়ে লেখক পাঠকের ধৈর্যের চেয়ে রোমাঞ্চের শোরুমে হাজির করে নিজের তৃপ্ততার প্রয়াস খোঁজেছেন। আর এ রকম একটি বইকে অনুবাদের মতো কঠিন আম্তানায় নিয়ে অনুবাদক নিজের সাহসের পরিচয় দিয়েছেস। সেটি ঠিক এমন যে, পাঠকের মনোগ্রাহী করে অনুবাদের পরিগ্রহরুপ সৃষ্টি করার মতো শিল্পকে করেছেন সমৃদ্ধ। অনুবাদকের পরিশ্রম নিশ্চিত সফলতা পেয়েছে। অনুবাদক মূল লেখক হারুকি মুনাকামির অন্তপ্রাণ ধরতে পেররছেন বলে মনে হয়েছে। অনুবাদের ঢঙ এবঙ সহজিয়া তা যেন প্রমাণ করে। তারচেয়ে বড় কথা লেখার শিল্পমান বজায় রাখতে চেষ্টা করেছেন বলে ধরা পরেছেন। যেমন অনুবাদের ভাষা – ‘মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, তেষ্টা পাক আর না পাক, প্রতিটি স্টেশনে কিছু পানি খেয়ে নেবো, কিন্তু তারপরও একটা দুর্ভাগা পরিণতির মতো, কৃষ্ণ হৃদয় নিশীথ রানির মতো তৃষ্ণা আমাকে তাড়া করতে থাকে।’
ভাষার সৌন্দর্য প্রয়োগক্ষমতায় অনুবাদকের দৃষ্টি ও অনুধাবনক্রিয়া প্রকাশ পায়। একজন অনুবাদক কিন্তু দ্বিতীয় দ্রষ্টার ভূমিকায় থাকলেও পারতপক্ষে নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারতে হয়। পাঠকতো অনুবাদের ভাষায় অনুরণিত হবে। অনুবাদের। স্বাদটা হচ্ছে এমনই- যেমন করে একজন গৃহবধূ সব মসলা পরিমাণমত দিয়ে তরকারিটাকে নিয়ে যাবে স্বাদের চূড়ায়। এ রকমটা হওয়াটাই পাঠকের চাহিদা ও রুচী।
একদম ঝরঝরে প্রাণচঞ্চল ভাষাই মূল্যায়নে নিয়ে যায় লেখক এবঙ অনুবাদককে।
অনুবাদক ফারুক মঈনউদ্দীন সচেতনভাবে বইটিকে অনুবাদে এনে পাঠকগ্রাহ্য করে কাজটি শেষ করে অনুবাদ সাহিত্যে পাঠকের খোরাক বৃদ্ধি চমৎকার প্রয়াস। অনুবাদকের ভূমিকাটা অত্যন্ত আশান্বিত করেেেছ পাঠকেকে। কথায় আছে – ‘মর্নিং সোজ দ্যা ডে’ তদ্রæপ ভূমিকার উপস্থাপনাই অনুবাদককে নিয়ে গেছে অনন্যতায়। অনুবাদকের শ্রমলব্দতায় পাঠক আনন্দিত হচ্ছেন নিয়ত।
বইটির মূল লেখক হারুকি মুরাকামি বইটির মাঝে ভিন্নতা আনার চেষ্টা করেছেন। বইটিকে কতগুলো অনুচ্ছেদে বিভাজন করলেও কিছু মজাদার শিরোনামের আশ্রয় নিয়ে হৃদ্য করেছেন পাঠকদের। পাঠক কিন্তু প্রতিনিয়ত ভিন্নস্বাদে রসনা ভেজাতে প্রস্তুত। শিরোনামগুলো যেমন-
১. মিক জ্যাগারকে নিয়ে কে উপহাস করে?
২. একজন দৌড়বিদ ঔপন্যাসিক হওয়ার সবক
৩. মধ্যগ্রীস্মে এথেন্স-প্রখমবারের মতো ২৬.২মাইল দৌড়
৪. প্রতিদিন দৌড়ে উপন্যাস লেখার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী যা জেনেছি
৫. আমার যদি তখন একটা লম্বা পনিটেল থাকত
৬. কেউ আর টেবিল চাপড়ায় নি, কেউ তাদের কাপ ছুড়ে মারেনি
৭. নিউইয়র্কের হেমন্ত
৮. প্রিফেকচারের এক সমুদ্রতীরবর্তী শহরে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ১৮
৯. অন্তত সেরকখনো হাঁটেনা
১০. বিশ্বজোড়া পথে পখে
অনুচ্ছেদের শিরোনাম যেমন চমৎকৃত তেমনি পুরো বইটিতে একজন বাতিওয়ালার ভূমিকা পালন করেছে। বেড়ে ওঠা, হেসে হেসে রেস করা এবং সঠিক প্রক্রিয়ায় দৌড়ের রেস কে সবার অবলম্বন করার প্রয়াস দেখিয়েছেন। বইটিতে খুব সচেতনভাবে বিভিন্ন রেফান্সেস টানা তথ্যগুলোকে স্টিকার স্টাইলে লিপিবদ্ধ বা সংযোজন করে পাঠকের প্রতি একটা প্রয়াসের পথ দেখিয়েছেন।