“এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু মুসলমান, সবার পবিত্র করা তীর্থনীরে আজি ভারতের মহা-মানবের সাগরতীরে”

295

১১৯২ সাল থেকে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাতশত বৎসর মুসলিম সম্রাটেরা ভারত শাসন করেছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে কোন হিন্দু সম্রাট দিল্লী মসনদে ক্ষমতায় ছিলেন না। বাইরের থেকে আসা মুসলমান সম্রাটদের ব্যাপারে আমাদের যত সমালোচনাই থাক না কেন, একটি কথা সবাইকে অকপটে স্বীকার করতে হবে, দখলকারী সম্রাটসহ তাঁর পরিবারের আর কেহ দখলের পর ভারত ছেড়ে যে দেশ থেকে এসেছেন সে দেশে আর যান নাই। ভারতকেই নিজ ভূমি জ্ঞান করে শত শত বৎসর ধরে নিজেদেরে জীবন কাটিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে গেলে,
“রণধারা বাহি জয়গান গাহি উন্মাদ কলরবে
ভেদী মরু পথ গিরি পর্বত যারা এসেছিলেন সবে
তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে, কেহ নহে নহে দূর
আমার শোণিতে রয়েছে ধ্বনিতে তার বিচিত্র সূর।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে আসল ব্যবসার উদ্দেশ্যে তারপর ভারতে ইংরেজ শাসন কি করে কায়েম হলো তা সবার জানা। ১৯৩০ সাল থেকে বৃটিশ সরকার ভারতে Divide and Rule ‘পৃথক কর এবং শাসন কর’ এই নীতি তীব্রভাবে বাস্তবায়িত করতে শুরু করে। উদ্ভূত সমস্যাবলি সমাধানের জন্য লন্ডনে প্রথমবারের মতো বৃটিশ সরকারের উদ্যোগে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে গোলটেবিল করতে গিয়ে মৌলানা মোহাম্মদ আলী বলেছিলেন, ‘My lord divide and rule is the order of the day, But in India we divide and you rule.’অর্থাৎ ‘মহামান্য লর্ড কালের নিয়ম হলো, ভাগ কর এবং শাসন কর। কিন্তু ভারতে আমরা বিভক্ত করি আপনারা শাসন করেন।’ স্বাধীনতার বহু বৎসর আগে থেকে ‘হিন্দুত্ববাদী’ আদর্শের উপর ভিত্তি করে একদল লোক রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলতে আরম্ভ করেন। এ রূপ অনেক সংগঠন ভারতে গড়ে উঠলেও, মূল সংগঠন ছিল আর.এস.এস. বা ‘রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ’। তাদের বক্তব্য হলো ভারতবর্ষ হিন্দুদের। আর সবাই বিদেশি। শত শত বৎসর ধরে ভারতবর্ষ যাঁরা শাসন করলেন, যে জাতির কোটি কোটি লোক মৃত্যুর পর এদেশের মাটির সাথে মিশে রয়েছে শত শত বৎসর ধরে, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকার কারণে তারা বিদেশি হয়ে যাবে। আর অন্যরা সংখ্যাগলিষ্ঠতার কারণে খাঁটি ভারতীয় হয়ে যাবেন। এর চাইতে জঘন্যতম, অমানবিক, অত্যাচারী এবং অযৌক্তিক বক্তব্য হতেই পারনা। ইহা মানবতা বিরোধী একটি দাবি।
কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতে এমন একদল স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সৃষ্টি হল যাঁরা ছিলেন প্রায় উচ্চ শিক্ষিত, রুচিশীল, সৎ, সর্বপ্রকার সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে, উদারতার ধারক এবং মানবতবাদী। সে সব নেতৃবৃন্দ গভীর পর্যালোচনার পর একমত হলেন ধর্মের ভিত্তিতে ভারতে কোন রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে তা পারস্পরিক ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে কোন দিন মুক্ত হতে পারবেনা। দেশে ধর্মীয় দাঙ্গা হাঙ্গামা লেগেই থাকবে। সে জন্য নতুন রাষ্ট্রের মূলনীতি হতে হবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। তখনকার শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, জওহার লাল নেহেরু, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, শ্রী রাধা কৃষ্ণানন, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, মহামতী অম্বেদকার এবং আরও অনেক অবিস্মরণীয় নেতা এবং নেত্রীরা।
কিন্তু মুসলিম লীগের সভাপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান নামে একটি আলাদা দেশ দাবি করে বসলেন। জিন্নার এই পরিকল্পনায় সাম্যাজ্যবাদী বৃটিশ সরকারের যে সুপরিকল্পিত গোপন সহযোগিতা ছিল তার ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে। যাই হউক, ভারতের স্বাধীনতার আগের দিন ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হলো এবং পরের দিন ভারতের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হলো ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে। ভারতের স্বাধীনতার স্থপতিরা দ্রুত ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র রচনা করেন যা ভারতের আপামর জনতার সমর্থনপুষ্ট।
ঐদিকে পাকিস্তান সৃষ্টির অল্পদিনের মধ্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পাকিস্তানের জিয়ারত নামক স্থানে প্রায় অবহেলিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্র্রী লিয়াকত আলী খাঁন যিনি পাকিস্তানেও অন্যতম স্থপতি ছিলেন এবং জিন্নাহ সাহেবের ব্যক্তিগত চিকিৎসকের কাছে পাকিস্তান সৃষ্টি করে ভুল করেছেন বলে জিন্নাহ আক্ষেপ করেছিলেন, যার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। যাই হউক ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে এবং বাংলাদেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এই স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয় সৈন্যরা আমাদের জন্য অনেক প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধী এবং ভারতের আপামর জনসাধারণ আমাদেরকে যে সাহায্য সহযোগিতা দিয়েছেন তা কোনদিন বাংলাদেশ ভুলতে পারবেনা।
আজকে অনেকে বলেন মুসলমানেরা পাকিস্তান সৃষ্টি করেছে, এটি অবশ্যই সত্য কিন্তু তদানীন্তন ভারতের সব মুসলমান পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য দায়ী নয়। তাই যদি হতো তাহলে আজকে ভারতে ২০ কোটি মুসলমান থাকতনা। এটি বেশি লোকের কাছে জ্ঞাত নেই মহাত্মা গান্ধীজীর বড় ছেলে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার আগে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেছিলেন। এব্যাপারে গান্ধীজীর বিরোধীরা বিদ্রæপ করে গান্ধীজীকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন, তাঁর ছেলে মুসলমান হওয়ার পর মদ পান করা ছেড়ে দিয়েছিলেন (কারণ ইসলামে মদ পান করা হারাম)। তখন তিনি তাঁর ধর্মান্তরকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। গান্ধীজী যে সব মুসলমানেরা নিজেদেরকে আলাদা জাতি হিসেবে মনে করেন তাঁদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন। কয়েক বৎসর আগে আমার জ্যেষ্ঠ ছেলে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছিল সে কি ‘পরবেনদরের’ (তার জন্মস্থান) বাসিন্দা হবে, না পাঞ্জাবের (তখন যেটাকে পাকিস্তান বানানোর প্রচেষ্টা চলছিল) হবে ? আমি মুসলমানদের জিজ্ঞেস করতে চাই। আমি মুসলমানদের জিজ্ঞেস করতে চাই, ভারত যদি আপনার মাতৃভূমি না হয় তাহলে অন্য কোন দেশটা হবে?
উক্ত ঘটনার উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, ‘ওহফরধ ংরবমব রিঃযরহ’ নামক বই হতে। যে বহুল প্রচারিত বইয়ের নাম উপরে উল্লিখিত হলো তার লেখক হলো প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক এবং লেখক এম.জে. আকবর। তিনি প্রথমে কংগ্রেস পার্টি করতেন। তিনি বিশ্বখ্যাত দু’একটা ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন এবং কংগ্রেসের মনোনিত প্রার্থী হিসাবে লোকসভার নির্বাচনে জয়ীও হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি বি.জে.পি’তে আছেন। কিছুদিন আগেও তিনি নরেন্দ্র মোদীর কেবিনেট মন্ত্রীও ছিলেন।
একথা অস্বীকার করার কোন কারণ নেই যে ভারত বিভাগের পর ভারতীয় মুসলমানদের একটি বিরাট অংশ পাকিস্তানকে অস্বীকার করে ভারতকেই নিজের দেশ হিসাবে গ্রহণ করে নেন। মুসলমানদের প্রগাঢ় আস্থা এবং বিশ্বাস ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা স্থপতিদের উপর। কারণ স্থপতিদের সবাই ছিলেন আদর্শবাদী, ত্যাগী এবং হাড়ে হাড়ে গণতান্ত্রিকমনা, বিশেষ করে তখনকার বিশ্বে এমন কোন নির্যাতিত জাতি ছিলনা যে জাতি গান্ধীজীর নেতৃত্বে বিশ্বাস করতনা। এই জন্যই দেখা যায় ভারত এবং পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার ৭ দশকের বেশী সময় পার হলেও এখনও ভারতে পাকিস্তানের চাইতেও কয়েক কোটি মুসলমান বেশি স্থায়ী বাসিন্দা হিসাবে বাসকরে। আজকে যারা ভারত থেকে মুসলিম নাগরিকদের ছলে-বলে-কৌশলে তাড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছেন তারা আহম্মকের স্বর্গে বাস করছেন এবং ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে কোন প্রকার সংশ্লিষ্টতা বা ওয়াকিফ হাল নয় বলে এসব দিবা স্বপ্ন দেখছেন। যে যত কথাই বলুক না কেন বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে শত চেষ্টা করলেও এন.আর.সি. বা অন্য কোনভাবে ভারত থেকে মুসলিম তাড়ানোর উদ্দেশ্যে আইন বাস্তবায়ন প্রায় অসাধ্য বরং এতে ক্রমশ! ভারত প্রত্যেক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়বে এবং ভারতের সার্বিক ঐক্য টিকে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ অবস্থার সৃষ্টি হলে শুধু হিন্দু নয় ভারতের মুসলমান সহ সব জাতির সর্বনাশ হয়ে যাবে।
ইতিমধ্যেই এই ভারতীয় বর্তমান বিষয়টি আন্তর্জাতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যেই ভারতের নাগরিকত্ব আইন (সি.এ.এ.) এবং বাবরি মসজিদের রায় সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি)। সৌদি আরবের জেদ্দায় গত রবিবার অনুষ্ঠিত ও.আই.সি. সাধারণ পরিষদের এক অধিবেশনে এব্যাপারে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। এর আগে এই আইনকে বৈষম্যমূলক উল্লেখ করে মানবকাধিকদার সংস্থা ‘অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল’ প্রতিবাদ জানিয়েছে। জাতিসংঘ ও অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি তাদের চার্টারের মাধ্যমে প্রত্যেকটি দেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করেছে। তার বিপরীতে ভারতের এমন আচরণ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
লেখক : কলামিস্ট