রোহিঙ্গাদের নিয়ে সংশয়

39

২২ আগষ্ট বাংলাদেশ থেকে ৩৫৪০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার লোকজন এ তালিকা তৈরী করেছিল। বিশ্বজনমত এ ব্যাপারে অবহিত ছিল। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, সেদিন প্রত্যাবাসনের কর্মসূচী সফল হয়নি। অথচ তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফেরার ব্যাপারে সস্মতি দিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে অশুভ এক চক্র এই কর্মসূচী সফল হতে দেয়নি। এই উদ্যোগ বিফলে যাওয়ার কারণে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ, এনজিওদের একটি অংশ, দেশী বিদেশী ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠি আগের দিন রাতে তাদের অস্ত্রের মুখে ভয় দেখিয়েছে। রোহিঙ্গাদের নেতৃত্বদানকারী নেতারা এই উদ্যোগকে মেনে নেয়নি। বিভিন্ন অপকর্মের ইন্ধনদাতা দালাল গোষ্ঠীও এর সাথে জড়িত। পরবর্তী ২৫ আগষ্ট রোহিঙ্গারা বিশাল এক সমাবেশের মাধ্যমে প্রত্যাবাসনের পূর্বশর্ত হিসেবে পাঁচ দফা দাবী উত্থাপন করে। তাতে নাগরিকত্ব এবং নিারপত্তাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। উক্ত সমাবেশ মিয়ানমারের উপর কতটুকু চাপ সৃষ্টি করবে, জানিনা। তবে বিশ্ব দরবারে এ বার্তা পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে মিয়ানমারে বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় থাকলেও বস্তুত: সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব এবং নেতৃত্ব সারা মিয়ানমার জুড়ে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী জনগণের নিরাপত্তা, অধিকার এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব চিন্তা করে না। তারা নিজেদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার স্বার্থে গৃহযুদ্ধ বহাল রাখতে চায়। মিয়ানমার সম্পর্কে আমাদের প্রত্যক্ষ ধারণা না থাকলেও এ কথা আমাদের জানা দরকার, রোহিঙ্গা সংকট রাতারাতি সৃষ্টি হয়নি। বার্মা তথা মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই এর উৎপত্তি। তৎকালীন আরাকান বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে মূলতঃ বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং রোহিঙ্গাদের জাতিগত সংঘাতের কারণে এহেন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত করার পরিকল্পনা, বিশেষ করে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী গঠনের পর থেকে শুরু হয়। ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে দুই দফায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছিল, তবে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতে বেশীর ভাগ রোহিঙ্গা ফেরত গেলেও ১৯৯২ সালে আসা লাখের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এখনও আছে। রোহিঙ্গাদের নেতা মুহিবুল্লাহ ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে এসেছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষক সূত্রে পাওয়া যায়, রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে সন্ত্রাসী গোষ্টি তৈরীতে তার জড়িত থাকার কথা প্রচারিত আছে। রোহিঙ্গা সংকট দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত সংশয় বাড়ছে। বাংলাদেশ মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তা অপূরণীয়।
দুই বছর আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত দাঙ্গা এবং রোহিঙ্গাদের উপর সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও গণহত্যা শুরু হলে প্রাণের ভয়ে প্রায় ১১ লাখের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। সেই সময়কার অবস্থা দেখে বাংলাদেশের মানুষ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। মানুষ মানুষের জন্য, এই ¯েøাগানকে ধারণ করে, মানবতার হাত প্রসারিত করে বাংলাদেশ সরকার তাদের টেকনাফে সাময়িক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে, তারা সরকারের অনুমতির তোয়াক্কা না করে বনাঞ্চল উজাড় করে, পাহাড় কেটে ঘর নির্মাণ করে। স্থানীয়দের অনেকের ধানের জমির চাষ স্থায়ীভাবে ব্যাহত হয়। কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফ সীমান্তবর্তী দুই উপজেলার ৩৪টি শিবিরে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে। রোহিঙ্গাদের আসার দৃশ্য ছিল বড়ই করুণ। তাদের ভাষ্যমতে প্রত্যেক পরিবারের জওয়ানদেরকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী অবিরত গুলি বর্ষণ করে হত্যা করেছে, বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে, যুবতী মেয়েদের ধর্ষণ করেছে, বাপ-দাদার ভিটে থেকে তাদের উচ্ছেদ করেছে, যা অবর্ণনীয়। এখনও আগুনের লেলিহান শিখা সীমান্তের এপার থেকে প্রত্যক্ষ করা যায়। তাদের এই আর্তনাদ, আগুনের সন্ত্রাস এবং নিরন্তর পথ চলার দৃশ্য ভিডিওতে প্রদর্শিত হলে আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্স কানাডাসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশ্বের অন্যান্য দেশ এবং ইসলামিক দেশগুলো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। খাদ্য সরবরাহ ও আর্থিক যোগান দিয়ে যাচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। জাতিসংঘ এবং তার অঙ্গসংগঠনগুলো ত্রাণ তৎপরতা ও মানবিক সাহায্য সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। সাহায্য-সহযোগিতা এবং ত্রাণ দেওয়া ছাড়া এ পর্যন্ত কোন দেশ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে কোন কার্যকর ভূমিকা রাখেনি। জাতিসংঘের নীতিমালা অনুযায়ী রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশে অর্থাৎ মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফেরত যাবে এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে, সেটা আমরা বিশ্বাস করি।
বিশ্বের বৃহৎ শক্তিধরদের হীন স্বার্থের কারণে বিশ্বের সর্বত্রই সভ্যতা এবং মানবতা ভূলুন্ঠিত। এক্ষেত্রে চীনকে আলাদা করে ভাবা যায় না। এতদসত্বেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে চীন সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সহযোগিতা করবে মর্মে আশ্বস্ত করেছে। সহযোগিতার ব্যাপার চীনের উপর নির্ভর করে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, চীনের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্ক অনেক পুরানো এবং গভীর। ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং পারস্পরিক সম্পর্ক তাদের মধ্যে বিদ্যমান। পাশাপাশি ভারত ও জাপান একই পথের দাবীদার। এক কথায়, যাদের সাথে মিয়ানমারের ভূ-রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তাদের কার্যকরী ভূমিকা থাকবে, এ কথা ভাবতে কঠিন লাগে। তাছাড়া চীন, রাশিয়া, ভারত এবং ঈসরাইল মিয়ানমারকে বাণিজ্যিকভাবে সমরাস্ত্র সরবরাহ করে আসছে।
বলাবাহুল্য, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি জান্তার কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে আমরা লাখ লাখ মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথে কোন মুরব্বী ছাড়া আমরা ভারত ছেড়ে নিজ দেশে ফিরে আসি। এ ব্যাপারে আমরা প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। সেই সূত্র ধরে বলতে চাই-কোন উদ্দেশ্যে নয়, শুধুমাত্র মানবিক কারণে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। কাজেই রোহিঙ্গারা মাতৃভূমিতে অর্থাৎ মিয়ানমারে ফিরে যাবে সেটাই বাস্তবতা। দিন যত গড়িয়ে যাচ্ছে, রোহিঙ্গারা তত বেসামাল হয়ে উঠছে। চুরি, ডাকাতি থেকে শুর করে খুন-অপহরণ, মাদক ব্যবসা, মানবপাচার, অস্ত্রের ব্যবসা, ইত্যাদি অপকর্মের সাথে জড়িয়ে বাংলাদেশের মানুষের ঘুম হারাম করে নিচ্ছে। আরাম আয়াসে থেকে কিছু দালাল প্রকৃতির মানুষের যোগসাজশে জন্ম নিবন্ধন কার্ড, স্মার্ট কার্ডের পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঠিকানা ব্যবহার করে পাসপোর্ট বানিয়ে বিদেশ গমনের আশায় বেশ কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এক কথায় বলা যায়, তারা নিজেদেরকে বাংলাদেশের নাগরিক ভাবতে শুরু করেছে। যাদের সংশ্লিষ্টতায় কাজগুলো সমাধা হয়েছে, তাদেরকে আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের সৃষ্ট সমস্যা। কাজেই সমাধানও মিয়ানমারের হাতে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব।
*রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন এবং ভারতের বিকল্প চিন্তা করা ভুল হবে। * আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে রোহিঙ্গা বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে কূটনৈতিক তৎপরতা আরো জোরদার করতে হবে। * আশ্রিত রোহিঙ্গারা যেন বাংলাদেশের জনগণের গলার কাঁটা না হয়, সেই মর্মে নজরদারি ও তদারকি বাড়াতে হবে। * এনজিওদের অপতৎপরতা রোধ করতে হবে, প্রযোজনে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হবে। * রোহিঙ্গারা ফের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টায় রত, কাজেই সীমান্তে বিজিবির টহল বাড়ানোর জন্য জনবল বাড়াতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক