রমজান আলী মামুন : কবি ও শিশুসাহিত্যিক সাহিত্যাকাশ থেকে ছিটকে পড়া নক্ষত্র

204

শিশুসাহিত্যিক রমজান আলী মামুন আমাদের মাঝে নেই। তিনি আর কোনদিন আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। ভাবতেই চোখ জুড়ে জল আসে। চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের ছড়াশিল্পের জগতকে আলোকময় করে দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন মামুন। শিশুসাহিত্যের বিশাল আঙিনা মাত করে সপ্রাণ থেকে গিয়েছিলেন আজীবন। মামুন নেই ,কাঁদছে প্রকৃতি। কাঁদছে আকাশ বাতাস। সাহিত্যের আকাশ থেকে ছিটকে পড়লো একটা নক্ষত্র। মামুন মরেও যেনো অমর। গত ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯। মঙ্গলবার। বেলা দুটোয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে মামুন চলে যান পরলোকে। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিলো মাত্র ৫২ বছর। মৃত্যুকালীন সহধর্মিনী, দুই ছেলে এক কন্যা সন্তান রেখে যান।


মামুনের মৃত্যু সংবাদে কান্নার রোল পড়ে সাহিত্যাঙ্গনে। শোকে বিহবল হয়ে পড়ে পড়ে শিশুসাহিত্য মহল। হাসপাতাল চত্বরে ছুটে আসেন দেশের বরেণ্য লেখক, ছড়াকার, কবি,সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিসেবী, পাঠক, অনুরাগী। ভীড় বাড়ে মামুনের টেরীবাজারের বাড়িতেও। রমজান আলী মামুন আপাদমস্তক নিপাট একজন ভদ্রলোক ছিলেন। পরোপকারী নিরহঙ্কারী মানুষ হিসেবেও নন, সাহিত্যিক তকমায় মামুন নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে অনন্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিজেকে। লেখালেখিতে মুন্সিয়ানা দিয়ে নয়,বৈচিত্র্যপূর্ণ লেখনীর পাশাপাশি সাহিত্যালোচক,দক্ষ সংগঠক, সম্পাদক, উপস্থাপক হিসেবে মামুন নিজেকে অনন্য উচ্চমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন। মামুনের অকালমৃত্যু তাঁর স্বভাবজাত অমায়িক আচরণ ও ভদ্রোজনিত মার্জিত ব্যবহারে বিমুগ্ধ লেখক বন্ধুমহল কোনমতেই মেনে নিতে পারছে না। মামুনের মরদেহ টেরীবাজারের নিজ বাসায় আসার পর থেকে রাতে বদরপাতি মাজার প্রাঙ্গনে জানাজা ও দাফন পর্যন্ত তার শুভাকাঙ্খী, আত্মীয় স্বজন, লেখক বন্ধু,নানা সংগঠনের কর্মীদের ভীড়ে মুখর থাকে। মামুনের মৃত্যু চট্টগ্রামের সাহিত্যাকাশেও কালোমেঘের ঘনঘটায় ছেয়ে গেছে। লেখক হিসেবে স্বমহিমায় নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন বহু আগে।
ছিলেন শিশুসাহিত্যিক, সহজেই মিশে যেতে পারতেন অন্য বলয়ের নানা ঘরানার মানুষের সাথে। মামুনের মৃত্যুর আকস্মিকতায় মুখপঞ্জীর পাতায় পাতায় ভরে গেছে শোকগাঁথা। স্মৃতিময়তা আর ঘটনাবহুল জীবনের নানা কথকতায়। এসএসসি পাশের পরই মুলতঃ মামুনের লেখালেখি শুরু। ষষ্ঠ/ সপ্তম শ্রেনীতে পড়ার সময়ই সংবাদপত্রে চিঠিপত্র কলামে লেখালেখির সূচনা করে । সামাজিক প্রেক্ষাপট ও উন্নয়নমূলক বিষয় আশয় নিয়ে দেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিয়মিত লেখাটা তার দৈনন্দিনকার চর্চায় পরিণত হয়। পড়াশুনা থেকে লেখালেখি। সুযোগ পেলেই ছুটে যেতো, বাড়ি থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে, নিকটেই গণগ্রন্থাগারে।সময়টা ৭৮/৭৯ র দিকেই। চট্টগ্রাম নগরীর লালদীঘি সংলগ্ন পৌর গণগ্রন্থাগার এবং মুসলিম হল সংলগ্ন পাবলিক লাইব্রেরীতে স্কুল ছুটিশেষে প্রতিদিন ছুটে যেতেন তিনি সেখানে। গ্রন্থাগারে বিভিন্ন সাহিত্য গ্রন্থ নিয়ে মামুন নিজেকে মগ্ন রাখতেন। জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকার পাশাপাশি মামুনকে আকর্ষণ করতো বিখ্যাত সব লেখকের বই। ছড়া,কবিতা, গল্প, উপন্যাস কোনোটাই বাদ রাখতেন না। গোগ্রাসে সব গিলতেন সব। প্রতিদিন স্কুল ছুটি হলেই মামুন কাপড়টা খুলেই দে ছুট। সোজা গণগ্রন্থাগারে ছুটে যেতেন। পাশেই ছিলো ঐতিহাসিক লালদীঘির স্বচ্ছ জলের ধারা। মামুনকে আকর্ষণ করতো ভিন্নভাবে।
চট্টগ্রাম মহানগরীর সেই সময়কালের কোলাহলমুক্ত পরিবেশে মামুনকে প্রকৃতিই লেখালেখির দিকে টেনে নিয়ে যায়। আশি সনের দিকে চিঠিপত্র কলাম দিয়ে লেখালেখির শুরু। প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদী ও নয়াবাংলায়। শিশুসাহিত্যের প্রথম প্রকাশ ঘটে ছোটদের মজলিশ এ। ছড়া দিয়েই আত্মপ্রকাশ। এখনো স্বপ্ন নিয়েই ছোটেন। স্বপ্œ দেখান। স্বপ¦ নির্মাণ করেন। নিজেই স্বপ্œের ঘোরে ফেরি করে চলেন জীবন, মানবতা লেখনী শক্তির মাধ্যমেই তুলে আনেন জীবনের লেখায় রেখায়। আশির দশক ছিলো মামুনের সেই সময় স্বপময় এক জীবন। বলা যায়, লেখালেখির দুরন্ত সময়। রুটিন মাফিক পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে তুলতেই লেখালেখির সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে মামুনের। মূলতঃ লেখালেখির ব্যাপারে অনুপ্রেরণাটা মামুন ওখান থেকে পেয়ে যায়। লামাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লামাবাজার এএএস সিটি কর্পোরেশন বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি সম্পন্ন করেন ১৯৮৪ সালে। এসএসসি পাশের পর নগরীর ওমরগণি এম ইএস কলেজে ভর্তি হয়ে পূর্ণোদ্যমে নেমে পড়েন শিশুসাহিত্য চর্চায়। এর পাশাপাশি শিশুসাহিত্যিক তকমাটা গায়ে লাগিয়ে স্থির হয়ে বসেও থাকেননি তিনি। নিজ বাড়ির পাশে পার্ড়াই যুবকণ্ঠ, উত্তরা কিশোর সংঘ, শাপলা কুঁড়ির আসর চট্টগ্রাম মহানগর সরাসরি জড়িত হন। স্বকাল সাহিত্য পরিষদের সাথে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই প্রত্যক্ষ ভাবেই জড়িত। আওয়াজ, কিশোর সমাবেশ, কথন, সাহিত্য সংবাদ সম্পাদনার সাথে জড়িত ছিলেন ওতপ্রোতভাবে। বর্তমানে আলোরপাতা ও কথন সম্পাদনা পরিষদে যুক্ত থেকেশিশুসাহিত্যের সেবা করে গেছেন নিরলসভাবে। প্রথম লেখা ছড়া দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তীতে শিশু কিশোরদের জন্য গল্প, উপন্যাস। বড়োদের জন্য কবিতা গল্প প্রবন্ধ নিবন্ধ কম লিখেন নি। এ যাবত মামুন সবমিলিয়ে ১৪টি বইয়ের ¯্রষ্টা হিসেবে সবিশেষ সুনাম কুড়িয়েছেন। সবগুলো বই মামুনকে নিয়ে গেছে অন্য এক মাত্রায়। কিশোর গল্প লিখেছেন হারিয়ে যাওয়া দুপুরে, আকাশপরী ও পাপিয়া, এক যে ছিলো রাজকন্যে, দিবা ও রহস্যময় বুড়ো, কিশোর নেমেছে যুদ্ধে, রুশনি ও একটি পতাকার গল্প। কিশোর উপন্যাস- রেল ছোটে মন ছোটে, মিঠু তুমি স্বাধীনতা। বর্তমানে কিশোর কবিতা নিয়ে যে মাতামাতি চলছে সেখানেও মামুনকে খুঁজে পাওয়া যাবে ভিন্নমাত্রায়। দু’টি কিশোর কবিতা গ্রন্থেই তিনি মাত করেছেন পাঠকদের। নীল ডানা এক পাখি, সবুজাভ কোন গ্রামে গ্রন্থ দু’টি যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে। ছড়াগ্রন্থ ছড়ার গাড়ি থামবে বাড়ি ছাড়াও মামুন বড়োদের জন্য ও লিখেছেন কাব্যগ্রন্থ- আমার অনেক কষ্ট আছে, তোর জন্য কষ্ট আমার। নিবিড়ভাবে লিখে যাওয়াটাকে মামুন অনেক বড়ো করেই দেখেছেন। এখন সেই ধারাবাহিক সময়ে ছেদ ঘটাননি কখনো। মামুনের সমসাময়িক বন্ধুদের অনেকেই হারিয়ে গেছেন। মামুন সাহিত্যের আঙিনায় টিকেছিলেন নিজস্বতায়।
লেখালেখি করতে গিয়ে নানাভাবে বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠন থেকে সম্মাননা পেয়েছেন- মনন সাহিত্য সম্মাননা-২০১২। বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি কর্তৃক কিশোর কবিতা সম্মাননা ২০১৬। অক্ষরবৃত্ত পাÐুলিপি শিশুসাহিত্য পুরস্কার-২০১৮ । সর্বশেষ মৃত্যুর ৩ দিন আগে বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি কর্তৃক শিশুসাহিত্য সম্মাননা পদক-২০১৯ প্রাপ্তি ছিলো উল্লেখযোগ্য। মৃত্যুর আগেই অনেক স্বপ্ন ছিলো ‘ শিশুসাহিত্যে মামুনের সাড়ে তিন দশক’ অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করার। অনেকটা গুছিয়ে এনেও নান প্রতিকূলতায় অনুষ্ঠানটি করা সম্ভব হয়নি। মামুনরে জীবনের নান দিক নিয়ে লেখা প্রকাশিতব্য সংকলনটিতে মামুনকে খুঁজে পাওয়া যাবে অনন্য সাধারণ ছড়াশিল্পী মামুনকে। মামুনের লেখার ধরণ, পদ্ধতি ছিলো সত্যিকার অর্থে অসাধারণ। মাকে ভালোবাসতেন হৃদয় দিয়ে। মায়ের সেবায় নিমগ্ন ছিলেন। মায়ের ভালোবাসায় অনুরক্ত মামুন বিধাতার অমোঘ নিয়মে মাকে দেখার আকুলতায় হয়তো ফিরে গেছেন মায়ের কাছে। এজন্যেই হয়তো মাকে নিয়ে তিনি লিখেন তাঁর ‘দরদী’ কবিতায় ,
“মা ও ছেলের মন বেদনায় / বুক করে চিন চিন
আজকে আমি একা / ও-দরদী দুঃখিনী মা
দাও না কেনো দেখা?”
সেই আশির দশক থেকেই বন্ধু হিসেবে রমজান আলী মামুনের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছি নানা কাজে আমিও। সুখে দুঃখে ভালোবাসার কান্না হাসিতে কেটে গেছে স্মৃতিময় দিনগুলো। সময়ের প্রেক্ষাপটে একজন রমজান আলী মামুনের জীবনে বন্ধু সতীর্থের কোন কমতি ছিলো না। তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্তের কোন অভাব নেই। মামুন ছিলেন অজাতশত্রæ। আমাদের মাঝে মামুন নেই, বন্ধুরা আসুন- সেই কষ্টের মুহূর্তগুলো আমরা ভাগাভাগি করতে পারি, মামুনের জন্য দু’হাত তুলে দোয়া করি, আল্লাহ মামুনকে বেহেশত নসীব করুন।

লেখক : কবি ও শিশুসাহিত্যিক