যে পাখিটি মানুষের কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসে

228

‘রূপসী বাংলা’র কবি জীবনানন্দ দাশের (১৮১৯-১৯৫৪) কবিতায় বাংলার প্রকৃতি ও পাখ-পাখালির অপূর্ব বিন্যাস লক্ষ্য করা যায়, যা বাংলা ভাষার অন্য কবিদের ক্ষেত্রে প্রায় বিরল। বাংলার প্রায় পঞ্চাশ প্রজাতির পাখির নাম জীবনানন্দ দাশের কলমে অমর হয়ে আছে। ইংরেজ কবি জেমস জয়েসের (১৮৮২-১৯৪১) ‘দ্য ডাবলিনার্স’ কবিতার মাধ্যমে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন নগরী বিখ্যাত হয়ে আছে। সমালোচকরা বলেন, যদি কোনো দৈব বা প্রাকৃতিক কারণে আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিন নগরী ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে জেমস জয়েসের ‘দ্য ডাবলিনার্স’ কবিতা অবলম্বনে পুনঃ-নির্মাণ সম্ভব। তেমনি জলবায়ু বিপর্যয় কিংবা প্রাকৃতিক কারণে বাংলার প্রকৃতির ঐ ৫০টি পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেলে জীবনানন্দের কবিতাপাঠে তাঁর প্রিয় পাখির ধারণা পাওয়া যাবে। জীবনানন্দের গভীর অনুভূতির ভাবব্যঞ্জনায় মিলেমিশে একাকার। জীবনানন্দ বাংলা সাহিত্যের এমন কবি, যিনি পাখিদের কাছ থেকে পর্যবেক্ষণের পর কবিতায় এনেছেন। পাখিদের ঘণিষ্ঠভাবে অবলোকন করার চিত্র তাঁর প্রতিটি বর্ণনায় উদ্ভাসিত হয়েছে। তিনি কবিতায় পঞ্চাশটি পাখি নিয়ে লিখলেও পাঁচ প্রজাতির পাখি তাঁর লেখায় বিশেষভাবে স্থান করে নিয়েছে। পাখিগুলো হলো : বুনোহাঁস, পেঁচা, শালিক, চিল ও কাক। আমাদের বিষয় কাক প্রজাতি, তাঁর বারোটি কবিতায় কাক এসেছে বিভিন্নভাবে। নিম্নে এগুলোর উদ্ধৃতি দেয়া হলো :
১। মৃত্যুর আগে [ধূসর পাণ্ডুলিপি]
“আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা সব রাঙা / কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে। / ধুসর মৃত্যুর মুখ; একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিলো সোনা ছিলো যাহা / নিরুত্তর শান্তি পায়; যেন কোন মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে। / কি বুঝিতে চাই আর … রৌদ্র নিভে গেলে পাখি-পাখালির ডাক শুনিনি কি? / প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক”।
২। তাই শান্তি [অপ্রকাশিত কবিতা]
“সন্ধ্যার মেঘের পথে দাঁড়কাক তবু জানে অন্য এক বিশ্রাম কল্যাণ / অন্য এক ক্ষমা শান্তি সমারোহ- আমিও শুনেছি সেই পাখিদের স্বর”
৩। মেয়ে [অপ্রকাশিত কবিতা]
“ব্যথা পেল সেই প্রাণ- খানিক দাঁড়াল চুপে- তার পর ধোঁয়া / সব তার ধোঁয়া হয়ে গেল ধীরে ধীরে তাই / শাদা চাদরের মতো বাতাসেরে জড়াল সে একবার- / কখন উঠেছে ডেকে দাঁড়কাক / চেয়ে দেখি ছোট মেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে খেলে- আর কেউ নাই”
৪। আবার আসিব ফিরে [রূপসী বাংলা]
“আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়ি’টির তীরে এই বাংলায় / হয়তো মানুষ নয় হয়তোবা শঙ্খচিল শালিকের বেশে / হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে / কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়”।
৫। খুঁজে তারে মরো মিছে [ রূপসী বাংলা ]
“খুঁজে তারে মরো মিছে- পাড়াগাঁর পথে তারে পাবে নাকে আর; / রয়েছে অনেক কাক এ উঠানে- তবু সেই ক্লান্ত দাঁড়কাক / নাই আর; অনেক বছর আগে আমে জামে হৃস্ট এক ঝাঁক / দাঁড়কাক দেখা যেত দিনরাত সে আমার ছোট বেলাকার / কবেকার কথা সব; আসিবে না পৃথিবীতে সেদিন আবার; / রাত না ফুরাতে সে যে কদমের ডাল থেকে দিয়ে যেত ডাক; / এখনো কাকের শব্দে অন্ধকার ভোরে আমি বিমনা, অবাক / তার কথা ভাবি শুধু; এতদিনে কোথায় সে? কি যে হলো তার”
৬। কতো ভোরে- দু’পহরে [রূপসী বাংলা]
“সকালের কাকের ডাকে আলো আসে, / চেয়ে দেখি কালো দাঁড়কাক”
৭। কতোদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে [রূপসী বাংলা]
“কতোদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়াছি আমরা দু’জনে / আকাশ প্রদীপ জ্বেলে তখন কাহারা যেন কার্তিকের মাঠ / সাজায়েছে মাঠ থেকে গাজন গানের ধোঁয়াটে উচ্ছ্বাস / ভেসে আসে; ডানাতুলে সাপমাসি উড়ে যায় আপন মনে / আকন্দ বনের দিকে; একদল দাঁড়কাক ম্লান গুঞ্জরণে / নাটার মতন রাঙ্গা মেঘ নিঙড়ায়ে নিয়ে সন্ধ্যার আকাশ / দু’মুহ‚র্ত ভরে রাখে- তারপর মৌরীর গন্ধমাখা ঘাস পড়ে থাকে; / লক্ষীপেঁচা ডাল থেকে ডালে শুধু উড়ে চলে বনে”
৮। একদিন পৃথিবীর পথে [রূপসী বাংলা]
“সুন্দর করুন পাখা পড়ে আছে- দেখি আমি; চুপে থেমে থাকি / আকাশে কমলা রঙ উঠে সন্ধ্যায় কাকগুলো নীল মনে হয়”
৯। পৃথিবীর পথে আমি [রূপসী বাংলা]
“এইসব দেখিয়াছি : দেখিয়াছি নদীটিরে- মজিতেছে ঢালু অন্ধকারে” / সাপমাসী উড়ে যায়; দাঁড়কাক অশ্বত্থের নীড়ের ভেতর / পাখনার শব্দ করে অবিরাম, কুয়াশায় একাকী মাঠের ঐধারে। / কে যেন দাঁড়ায়ে আছে : আরো দূরে দু’একটা শব্দ খেড়ো ঘর পড়ে আছে / খাগড়ার বনে ব্যাং ডাকে কেন- থামিতে কি পারে; (কাকের তরুণ ডিম পিছলায়ে পড়ে যায় শ্যাওড়ার ঝাড়ে।)
১০। কোন দিন দেখিব না [রূপসী বাংলা]
“যখন মেঘের রঙে পথহারা দাঁড়কাক পেয়ে গেছে ঘরের সন্ধান / ধুসর সন্ধ্যায় সেই- আসিবে না সে এখানে; এইখানে ধুন্দল লতাতে”
১১। এই সব ভালো লাগে [রূপসী বাংলা]
“কবেকার মৃতকাক; পৃথিবীর পথে আজ নাই সেতো আর / তবুও সে ম্লান জানালার পাশে উড়ে আসে নীরব সোহাগে / মলিন পাখনা তার খড়ের চালের হিম শিশিরে মাথায়; / তখন এ পৃথিবীতে কোন পাখি জেগে এসে বসেনি শাখায় / পৃথিবীও নাই আর; দাঁড়কাক একা একা সারারাত জাগে / কি বা হায় আসে যায়, তারে যদি কোন দিন না পাই আবার”
১২। কুড়ি বছর পরে [বনলতা সেন]
“আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি / আবার কুড়ি বছর পরে / হয়তো ধানের ছড়ার পাশে / কার্তিকের মাসে / তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে- তখন হলুদ নদী / নরম নরম হয় শর কাশ হোগলায়- মাঠের ভিতরে”
জীবনানন্দের কবিতায় গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘ধূসর পাÐুলিপি’-তে একটি, ‘অপ্রকাশিত কবিতাতে দুটি, ‘রূপসী বাংলা’য় আটটি এবং ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থে একটিতে কাক কবিতার বিষয় হয়ে এসেছে। সর্বমোট বারোটি কবিতায় কাক-প্রসঙ্গ এসেছে নয়বার এবং দাঁড়কাক এসেছে দশবার। উল্লেখ্য যে, এ তুলনায় নজরুলের কবিতায় কাক প্রসঙ্গ এসেছে মাত্র পাঁচবার। জীবনানন্দের কবিতায় সবচেয়ে বেশি কাক প্রসঙ্গ এসেছে ‘রূপসী বাংলা’ কাব্য গ্রন্থে। কাব্যগ্রন্থটি ১৯৩৬ সালে (অগ্রহায়ণ, ১৩৪৩ বাংলা) ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। এটি তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ।
জীবনানন্দের কবিতায় পাতিকাকের চেয়ে দাঁড়কাকের প্রসঙ্গ বেশি এসেছে। সম্ভবত তিনি পূর্ব-বাংলার বরিশালে অবস্থানকালে কবিতাগুলো রচিত হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে দাঁড়কাক শহর-এলাকা থেকে গ্রামীণ ও জংলা পরিবেশে বেশি পরিমাণে দেখা যায়। বরিশালে তখনও নগরায়ণ প্রক্রিয়া গড়ে উঠেনি।
জীবনানন্দ রূপসী বাংলার কবি। তাঁর কবিতায় প্রকৃতি ও জীবজগৎ উঠে এসেছে। আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কাক যেভাবে আসার কথা ছিল সেভাবে কিন্তু আসেনি। ইংরেজ কবি টেড হিউজ (১৯৩০-১৯৯৮) ‘দ্য ক্রো’ নামে একটি কবিতা গ্রন্থই প্রকাশ করেন। উনিশ শতকের প্রথম ভাগে সে-গ্রন্থটি বেস্টসেলারের তালিকায় উঠে আসে। এছাড়া অ্যালান পোর দ্য রেভেন কবিতাটিও পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। এই পাখিটি মানুষের কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসে অথচ আমাদের সাহিত্যে কাক নিয়ে একক কোনো গ্রন্থ নেই।
তথ্যসূত্র : রনেশ দাশগুপ্ত (সম্পাদিত), জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভার, খান ব্রাদার্স এ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা। [৪র্থ সংস্করণ, আষাঢ়, ১৩৮১ বাংলা।]
লেখক : কবি, নিসর্গী, ব্যাংক নির্বাহী (অব)