যানবাহনে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার কতটুকু নিরাপদ

65

বলা হয়ে থাকে ‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ’। এই কথাটি আজ শুধু বইয়ের কালো বর্ণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। কারণ বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উৎকর্ষের ফলে প্রযুক্তির বিকাশ হলেও, আমাদের জীবনের সার্বিক বেগ বেড়ে গেলেও, যানবাহন ও আবাসিক ভবনে গ্যাস সিলিন্ডার এ কৃত্রিম গ্যাস এর মত গ্যাস এর ব্যবহার বাড়লেও, এই খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট আমাদের দেশীয় ব্যবসায়ীমহল তাদের জনস্বার্থ মূলক আবেগ গুলোকে কবর দিয়ে,জনস্বার্থকে আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত কুÐে নিক্ষেপ করে, ‘অতি মুনাফা’র মন-মানসিকতা থেকে সরে না আসতে পারার কারণেই আজ থেকে ১০ বছর আগে সংঘটিত নিমতলী ট্রাজেডি থেকে আমরা কোন শিক্ষা নিইনি। আর নিইনি বলেই পয়লা ফাল্গুনের আমেজ না কাটতেই,ভালোবাসা দিবসের রেশ না ফুরাতেই, পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা’তে ২১ ফেব্রæয়ারির প্রারম্ভেই যানবাহনে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৭০টি তাজা প্রাণ হারিয়ে গেল। যে কারণে এই প্রাণহানীর ঘটনা ঘটে তা ছিল যানবাহনে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার এর বিস্ফোরণ।


যানবাহনে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার থেকে এত বড় বড় বিস্ফোরণ ঘটলেও কেন যানবাহনে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার -এর ব্যবহার সীমিত বা নিয়ন্ত্রণ বা সংশ্লিষ্ট বিদ্যমান আইন কেন কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছেনা… তা আজ সর্বত্র আলোচনার বিষয়।
যানবাহন ও আবাসিক ভবনে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এ পর্যন্ত যেসব দুর্ঘটনা ঘটে তার কিছু তথ্য দেখলেই বুঝা যায় কী এক মৃত্যুপূরীতে আমরা বাস করছি। ২০১৫ সালে ৮০ টি,২০১৬ সালে ১৩১ টি,২০১৭ সালে ৭৯ টি,২০১৮ সালে ১৭৮ টি দুর্ঘটনা আমরা এ দেশে দেখেছি , যার সবগুলো বোতলজাত তথা গ্যাস সিলিন্ডার থেকে সংঘটিত (সূত্র : ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স) । পর্যবেক্ষণে বুঝা যায়,গত ৪ বছরের মধ্যে ২০১৭ সাল ছাড়া প্রতি বছরই থেকে দুর্ঘটনা বেড়েছে।
তারপরও এর সাথে জড়িত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জচএঈখ সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কেন, কিসের লোভে নাকে সর্ষে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে তা বোধগম্য নয়।
সমস্যা বিশ্লেষণ :
যানবাহনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে ১) যানবাহনে মেয়াদ উত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার এর অহরহ ব্যবহার, ২) নিয়মিত গ্যাস সিলিন্ডার পুনরায় চেক না করা, ৩) গাড়ির চালক ও আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার সম্পর্কিত পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব, ৪) যানবাহনে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার অনুপযোগী ভাঙ্গা রাস্তা ও যত্রতত্র ংঢ়ববফ নৎবধশবৎ এর প্রভাব। ৫) সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারীর অভাবই এমন প্রাণঘাতী বিস্ফোরণের জন্য দায়ী।
বিশ্লেষকদের মতামত : গ্যাস সিলিন্ডার এর এমন মরণঘাতী আক্রমণে আশাহত হয়ে পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন গ্যাস সিলিন্ডার বহনকারী একটি গাড়ি যেন একেকটি তাজা বোমা নিয়ে চলছে”।
গ্যাস সিলিন্ডার বিষয়ে নাভানা সিএনজির সিনিয়র সেলস নির্বাহী কামরুজ্জামান বলেছেন আমাদের প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা ১ লক্ষেরও বেশি গ্যাস সিলিন্ডার এর ৭০ শতাংশই গ্রাহকরা জব-ঞবংঃরহম করেন না।
পাশাপাশি ওহঃৎধপড় ঈহম’র অএগ নাসিরুদ্দিন এর মতে “প্রতি ৫ বছর পর পর গ্যাস সিলিন্ডার এর মান পরীক্ষার আইন রয়েছে,পরীক্ষার মান ভালো হলে আরো ৩ বছরের জন্য ঈবৎঃরভরপধঃব দেয়া যেতে পারে,এরপর নতুন গ্যাস সিলিন্ডার নেয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু এসব আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে স্বার্থান্বেষী পরিবহণ মালিকরা কিছু অর্থ সাশ্রয়ের জন্য গ্যাস সিলিন্ডার ঞবংঃরহম না করিয়ে মানুষ রূপী রাক্ষসরা ৫ বা ৮ বছরের বেশি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করে আমাদেরকে অবধারিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে”।
স¤প্রতি আনোয়ারায়ও অত্যন্ত ভয়াবহ ও মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। গত ১৭অক্টোবর ২০১৯ তারিখে চট্টগ্রাম থেকে চিকিৎসা শেষে অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়ি ফিরছিলেন একই পরিবারের সদস্যরা অ্যাম্বুলেন্সটি আনোয়ারা উপজেলার চাতরী বাজারে পৌঁছালে এর গ্যাস সিলিন্ডার বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। অ্যাম্বুলেন্সটি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়ে এবং যাত্রীদের মধ্যে দুইজনের দেহ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরিবারটির অভিভাবক ও তার দুই পুত্রবধূ নিহত হয় এবং তিনজন গুরুতর আহত হয়। এই দুর্ঘটনায় বলা যায়, একটি পরিবার শেষ হয়ে গেল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বোমা বিস্ফোরণের মতো ভয়ংকর শব্দে এলাকাটি কেঁপে ওঠে। তারা কোনো কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না। পরে দেখতে পান একটি অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থলে দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে আছে। উল্লেখ্য, গাড়িসহ বাসা-বাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ নতুন কোনো ঘটনা নয়। প্রায়ই সিলিন্ডার বিস্ফোরণে অনেক মানুষ আহত ও নিহত হচ্ছে। একেকটি বিস্ফোরণে পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। গত কয়েক মাসে রাজধানীতেই গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এতে বেশ কয়েকজন আহত ও নিহত হয়েছে।
গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ রোধে করণীয় :
ক. প্রতি ৫ বছর পর পর গ্যাস সিলিন্ডার ঃবংঃ করা।
খ. ঞবংঃ না করালে তৎক্ষণাৎ গ্যাস সিলিন্ডার এর লাইসেন্স বাতিল করা এবং পুনরায় উক্ত গাড়ির মালিক ও তার পরিবারের কাউকে লাইসেন্স না দেয়া।
গ. গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহী প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারকারীর সাথে মেয়াদ পূর্তির আগেই যোগাযোগ করে ৎব-ঃবংঃরহম করাতে বাধ্য করা।
ঘ) রাস্তায় যেখানে সেখানে ংঢ়ববফ নৎবধশবৎ স্থাপন না করা এবং নিয়মিত ভাঙা রাস্তা সংস্কার করা, যাতে ংঢ়ববফ নৎবধশবৎ ও ভাঙ্গা রাস্তার কারণে মধং এর বোতলে ঝাকুনি না লাগে এবং বিস্ফোরণ না ঘটে।
ঙ) বিশ্লেষকরা বলেন, মহাসড়ক ছাড়া অন্য রাস্তায় তেলনির্ভর বা বষবপঃৎরপরঃু ঢ়ড়বিৎ নির্ভর যানবাহন ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। কারণ অন্য রাস্তাগুলো সাধারণত অনেকাংশে ভাঙা-চোরা ও ৩০/৫০ গজ পরপর ংঢ়ববফ নৎবধশবৎ থাকে, যে কারণে এসব রাস্তায় একটি গাড়ির সাথে অন্য গাড়ির ধাক্কা বা যত্রতত্র ংঢ়ববফ নৎবধশবৎ এর কারণে গাড়িতে ঝাকুনির ফলে গ্যাস সিলিন্ডার এর উপর যে আঘাত আসে তার কারণেও বিস্ফোরণ হতে পারে।
এখনই যানবাহন ও আবাসিক ভবনে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, অন্যথায় দেশ ও জাতি এর চেয়েও বিভীষিকাময় পরিস্হিতির সম্মুখীন হবে যা আপনার, আমার, কারো কাম্য নয় ।
লেখক: প্রাবন্ধিক