মানবতার ক্রন্দন থামাবে কে ? করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বিশ্বের পরাশক্তিগুলো পরাস্ত!

152

শাহাবুদ্দীন খালেদ চৌধুরী

আমার দৃঢ় বিশ্বাস কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো একটি উপযুক্ত চামার কুলপতি বের করতে পারলে জুতো আবিষ্কারের মত করোনা ভাইরাস বা “কোভিড-১৯” রোগের ঔষধও আবিষ্কার হয়ে যাবে। গতবছর ডিসেম্ভর মাসে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী ওহানে উপরোক্ত রোগের পাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল। মাত্র তিন মাসের মাথায় দেশটির সবকটি প্রদেশে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে এবং লক্ষাধিক মানুষ এভাইরাসে আক্রান্ত হয়, মৃত্যুবরণ করে সাড়ে তিনহাজারের অধিক । দেশটির জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চীনে সর্বশেষ ( গত শনিবার পর্যন্ত) ৮২ হাজার ৫২৬ জন আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ৩ হাজার ৩৩০ জন। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ৭৬ হাজার ৯৩৪ জন। তবে ওয়াশিংটন পোস্ট চীনের দেয়া তথ্যকে ভ্রান্ত উল্লেখ করে সংবাদ মাধ্যমটিতে প্রায় ৫০হাজার চীনা নাগরিকের মৃত্যু ঘটেছে।
যাই হোক, চীন থেকে শুরু হওয়া করোনা ভাইরাসের অগ্রযাত্রা আর থামে নাই। বর্তমান বিশ্বের প্রায় দেশে এ রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে চীনের রাজধানী বেইজিং শহরে অবস্থিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অফিসে চীন সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল যে, চীনে অচেনা একটি রোগের পাদুর্ভাব শুরু হয়েছে যা সনাক্ত করা যাচ্ছে না। প্রায় দুই মাসের মধ্যে সারা বিশ্বে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ল। বিশ্বের প্রায় সরকার স্ব-স্ব দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। প্রায় দেশে মানুষের সর্তকতা বাড়ানোর জন্য সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। বিশ্বের প্রত্যেক দেশে সরকার মানুষকে ঘর থেকে বের না হওয়ার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছেন এবং প্রায় দেশের রাস্তায় সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে। বিশ্বের বড় বড় দেশে ট্রিলিয়ন, ট্রিলিয়ন ডলার স্ব-স্ব পার্লামেন্টে অনুমোদন নিয়ে করোনা ভাইরাস মোকাবিলার জন্য খরচ শুরু করছে। অপেক্ষাকৃত অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলোও বসে নেই, তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী করোনা মোকাবিলার জন্য বাজেট বরাদ্দ দিয়েছেন। আক্রান্ত সব দেশের এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। করোনা ভাইরাস বা কোভিব-১৯ এর আক্রমণের সারা বিশ্বে একটি কথা প্রমাণিত হলো করোনা ভাইরাসের মত একটি ফ্লু মোকাবিলা করার মতো প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সারা বিশ্বের তথাকথিত শক্তিশালী দেশগুলোর নেই। এমনকি যেসব দেশকে মনে করা হতো চিকিৎসার জন্য আদর্শস্থানীয়, অত্যাধিুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর সেসব দেশও আজ অসহায়, তাদের হাসপাতালের সংখ্যাও অপ্রতুল, চিকিৎসার ইক্যুপমেন্ট নেই। ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য সবারই একই অবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রেরে সবচাইতে বড় এবং সমৃদ্ধশালী অর্থনীতি, দুনিয়া জয়করার মতো সামরিক শক্তি, বিশ্বের সর্বত্র ডজন ডজন শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি থাকলেও এবার প্রামাণ হলো করোনা ভাইরাসের মতো একটি (সর্দি, কাশি ও জ্বরের) ভাইরাস সামাল দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তাঁদের নেই। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলি যেখানে ট্রিলিয়ন, ট্রিলিয়ন ডলার জাতীয় নিরাপত্তার জন্য খরচ করে অথচ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে উক্ত দেশগুলোর জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১ হাজার রোগীর জন্য ২.৮ হাসপাতালের বেড, ইতালিতে প্রতি ১ হাজার রোগীর জন্য ৩.২, চীনে প্রতি ১ হাজার রোগির জন্য ৪.৩ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতি ১ হাজারের জন্য ১২.৩ বেড রয়েছে। করোনাভাইরাসের ধাক্কার ফলে বোঝা গেল যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রত্যেক উন্নত দেশে প্রয়োজনীয় মেডিকেল যন্ত্রপাতির বিরাট ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র গত অর্ধ শতাব্দিতে বিশ্বের সকল অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ থেকে ৫.৫ শতাংশ দেশীয় অস্ত্র বিক্রয় করেছে, ২০১৫ সাল, ২০১৯ সাল বিশ্বে যেসব দেশ সবচাইতে বেশি অস্ত্র বিক্রয় করেছে তার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি এবং চীন। ধনী ও ক্ষমতাশালী দেশগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে লেগেই আছে এবং ট্রিলিয়ন, ট্রিলিয়ন ডলার অস্ত্র তৈরিতে খরচ করছে। এক শক্তিশালী অপর শক্তিশালী দেশের চাইতে এগিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এ প্রতিদ্ব›িদ্বতা মানুষ মারার, একদেশ আরেক দেশকে ঘায়েল করার। এটি এমন যে, যা কোন দিন শেষ হওয়ার নয়। কারণ শক্তি সঞ্চয়ের তো শেষ নেই। এ অবস্থায় যখন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে সাহায্য করার ইচ্ছা প্রকাশ করে তখন তা হৃদয়বিদারক তমাশা মনে হয়। কারণ অনেক দিন আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, ইরানের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর কড়া বিধিনিষেধ দিয়ে রেখেছে। বর্তমানে করোনাভাইরাসের মোকাবিলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া বিধি নিষেধের জন্য ইরান বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় অসুধও আনতে পারছে না। গত সপ্তাহে আরো নতুন নিষেধাজ্ঞা দেয়ার সময় আমেরিকা বলেছে, কোন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে না। ইরান মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে করোনাভাইরাসের সবচাইতে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। শেষ খবরে জানাগেছে মিনিটে একজনের করোনাভাইরাসে মৃত্যু হচ্ছে এবং প্রতিঘণ্টায় ৫০ জনের মতো ইরানি ভাইরাস শনাক্ত হচ্ছে। ইরানের এক খবরে জানা যায় করোনা আক্রান্ত কিছু লোক বেপরোয়া করতে শুরু করে তাতে প্রায় ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। যায় হোক, যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি বিশ্বের বৃহত্তম শক্তিশালী রাষ্ট্রকে মানবতাহীন আচরণে মানায়ও না। চীনে শুরু হওয়া করোনাভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যেতে দুই মাস সময়ও লাগে নাই। মানবতাহীন বিশ্বের মানুষের কেবল প্রয়োজন থাকতে পারে না। শুধু মানবতার কারণেই ইরানকে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি দিতে বিশ্বের সব দেশে সর্বপ্রকার সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত। এই ব্যাপারে ভিন্নরকমের চিন্তার সুযোগ নেই। ইতোমধ্যেই জানা গেছে চীন, রাশিয়া এবং পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করার আহŸান জানিয়েছেন। আসলে “করোনাভাইরাস” একটি মহামারী। বিশ্বের সমস্ত মানব জাতির অস্তিত্বের উপর এই মহামারীর আক্রমণ, এখানে কোন নোংরা রাজনীতির আশ্রয় নেওয়া মানবতার প্রতি বিরাট অবমাননা বলে ভবিষ্যতে ইতিহাস বিচার করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টিলগ্ন থেকে মানবতার প্রতি আমেরিকার স্থপতিরা যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছেন এর ব্যতিক্রম যে হয়নি তাঁ নয়। তবে আগের পুরানো বিশ্ব শক্তিগুলোর চাইতে মানবতাশূন্য নয়। অবশ্য অল্প কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে করোনা ভাইরাসের সাহায্য করার প্রস্তাব দিয়েছিল যা ইরান প্রত্যাখ্যান করেছিল। মানবতার এই দুঃসময়ে ইরানের এই প্রত্যাখ্যান একটি অমানবিক এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়।
গত ডিসেম্ভর মাসের শেষ দিকে চীনে করোনা ভাইরাসের শুরু। মাত্র ৩ মাসের মধ্যেই বিশ্বের প্রায় সবদেশে এই ভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এরই মধ্যেই ৭৩ হাজারের বেশি মানুষ এই ভাইরাসে মৃত্যুবরণ করেছে এবং প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা এবং রোগে আক্রান্তের সংখ্যা জ্যামিতিকহারে বেড়ে চলেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্ধশতাধিক প্রথম সারির নেতা ও রাষ্ট্র প্রধান করোনায় আক্রান্ত। বর্তমানে সবচাইতে ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে বিশ্বের শীর্ষ প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন মৃত্যুর সংখ্যা ১ থেকে ২ লাখের মধ্যে রাখতে পারাটাই সফলতা বলে গণ্য হবে। নিউইয়র্ক সিটির হাসপাতালগুলোতে দ্রæত বাড়ছে করোনায় আক্রান্ত মৃত্যুর হার। প্রতি ৯ মিনিটে একজনের মৃত্যু ঘটছে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ নিশ্চুপ হয়ে থাকতে পারে না। করোনা আঘাতের দুশ্চিন্তা ছাড়াও আমাদের আরেকটি দুশ্চিন্তার কারণ হলো, বাংলাদেশে যেসব বড় বড় অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে তার বেশিরভাগ প্রকল্পেই চীনের কারিগরি সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। কাজেই কোন কারণে চীন এসব প্রকল্পগুলোর কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন করতে অক্ষম হলে আমাদের অর্থনীতি বিরাট একটা সংকট মোকাবিলার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যাবে। এ ছাড়াও বাংলাদেশের পোশাকশিল্প, মেশিনারী এবং পোশাক শিল্পের কাঁচামালের জন্য প্রায় ৬০ শতাংশ চীনের উপর নির্ভর করতে হয়। এর বাইরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গার্মেন্টস শিল্পের জন্য দক্ষ জনবল চীন থেকে আমদানি করতে হয়। করোনা ভাইরাস -এর কারণে চীনের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্প সংস্থা ( বিজেএমইএ) জানিয়েছে যে কাঁচামালের অভাবে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের কারখানার অনেক উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশের কেমিক্যাল শিল্পের জন্যও চীনের উপর প্রায় সম্পূর্ণ নির্ভরশীল এবং বাংলাদেশের ঔষধ শিল্পের কাঁচামালের অনুরূপভাবে বাংলাদেশ চীনের উপর নির্ভরশীল। আমাদের আমদানি বা রপ্তানি বাণিজ্যের কোন দেশের উপর এককভাবে নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে। আমদানি হোক বা রপ্তানি হোক উভয় ব্যবসার জন্য আমাদের বিকল্প বাজার সৃষ্টি করার উপর জোর দিতে হবে। সেজন্য আমাদের রপ্তানিপণ্যের গুণগত মান অবশ্যই বাড়াতে হবে। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের শিল্পে এবং আমদনি-রপ্তানি বাণিজ্যে ইনশাআল্লাহ্ একটি দক্ষ উদ্যোক্তা শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে, তাঁরা যদি এ ব্যাপারে প্রয়াস চালান তাহলে অবশ্যই, ইনশাআল্লাহ্ সফল হবে। আমাদের প্রচেষ্টা হবে কত কম দামে আমরা কত মানসম্পন্ন পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করতে পারি। পরিতাপের বিষয় আমাদের মাতৃভ‚মিতে একটি তথাকথিত ব্যবসায়ী শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছে যাঁরা দরিদ্র মাতৃভূমির টাকায় চলে-বলে-কৌশলে বিভিন্ন বে – আইনি পন্থার বিদেশে পাচার করে নিয়ে (কানাডা, মালেশিয়া ইত্যাদি দেশে) রাজ প্রাসাদসম বাড়ি তৈয়ার করেছেন। এদের মনে রাখা উচিত, করোনার শাস্তি থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। তার পরও কবর জগতের বিধাতার শাস্তি অবশ্যই চলবে। তাঁদেরকে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সাজানো উদ্ধৃত দিয়ে শেষ করতে চায়।
“ জীবনের পিছনে মরণ দাঁড়ায়ে, আশার পিছনে ভয় –
ভকিনীর মত রজনী ভ্রমিছে
চিরদিন ধরে দিবসের পিছে
সমস্ত ধরাময়।

লেখক : কলামিস্ট