মাঠ-প্রশাসনে অচলাবস্থা

1212

পদবি ও বেতন গ্রেড উন্নীত করাসহ ৯ দফা দাবিতে বাংলাদেশ কালেক্টরেট সহকারী সমিতির (বাকাসস) ডাকে তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারিদের তিন দিনের কর্মবিরতি শুরু হয়েছে। এ কর্মবিরতির কারণে মাঠ প্রশাসনে দাপ্তরিক কার্যক্রমে এক প্রকার অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার কোনো কর্মচারীই চেয়ারে বসেননি। ফলে নানা প্রয়োজনে এসে শত শত সেবা প্রার্থী সেবা না পেয়ে ফিরে গেছেন। আজ এবং আগামীকালও সারাদিন কর্মবিরতি পালন করবেন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা। কর্মবিরতি চলাকালে জেলা প্রশাসক কার্যালয় প্রাঙ্গণে অবস্থান ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
কর্মচারীরা জানান, একই পদের ২১ ধরনের কর্মচারীর পদবি ও গ্রেড পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৯৫ সালের ১৯ মে সচিবালয়ের প্রায় দুই হাজার তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির কমর্র্কতা পদে উন্নীত করা হয়। কিন্তু বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনে কর্মরত তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তারা যে পদে চাকুরিতে ঢুকেছেন, সে পদ নিয়েই অবসরে যেতে হচ্ছে। এর চাইতে লজ্জার বিষয় আর কি থাকতে পারে। কেরানি হয়েই মরতে হচ্ছে। সব বিভাগের কর্মচারীদের পদোন্নতি হয়, আমাদের হয় না। এক দেশে কি দুই আইন থাকতে পারে।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টায় বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রশাসনের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের সবগুলো চেয়ার খালি। কেউ-ই অফিসে নেই। হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে কর্মচারীরা কর্মসূচিতে যোগদান করেছেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ভূমি অধিগ্রহণ) কার্যালয়ে দেখা যায়, অফিস সহকারীদের সমস্ত চেয়ার খালি। কর্মকর্তারা তাদের কক্ষে থাকলেও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন না। তারা খাতায় স্বাক্ষর করে বেরিয়ে গেছেন বলে পিয়নরা জানান।
বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, অধীনস্থ সব অফিসের কর্মকর্তারা রুমে বসে আছেন। কিন্তু অফিস সহকারীরা কেউ নেই। তারা অফিসে এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেই সোজা কর্মসূচিতে চলে গেছেন।
জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, আগ্নেয়াস্ত্র শাখা, জেএম শাখা, শিক্ষা শাখা, রেকর্ড রুম, স্থানীয় সরকারি বিভাগসহ সকল শাখায় কর্মরত কর্মচারীরা কর্মবিরতি পালন করেছেন। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলার কার্যক্রমও বন্ধ ছিল। ফ্রন্ট ডেস্কেও কোন কর্মচারী কাজ করেননি।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনে কোনোধরনের দাপ্তরিক কাজকর্ম হয়নি। ফ্রন্ট ডেস্কে খতিয়ান তুলতে আবেদন নিয়ে আসা অন্তত ২০ জন লোক ফিরে গেছেন। তাদের আবেদন নেয়ার জন্য কেউ ছিলেন না। জমির খতিয়ান নিতে আসা অর্ধশতাধিক লোক খতিয়ান না পেয়ে ফিরে গেছেন। ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় জমির ক্ষতিপূরণ নিতে আসা শতাধিক লোক হতাশ হয়ে ফিরে যান। শিক্ষা, আগ্নেয়াস্ত্র, জেএম শাখাসহ বিভিন্ন শাখায় আসা কয়েকশ’ লোক সেবা না পেয়ে ফিরে গেছেন।
উপজেলা পর্যায়েও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে কর্মরত তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরাও দিনভর কর্মবিরতি পালন করেছেন।
কর্মবিরতি চলাকালে কর্মচারীরা জেলা প্রশাসক কার্যালয় প্রাঙ্গণে দিনভর অবস্থান ও সভা-সমাবেশ করেছেন। সমাবেশে তারা অবিলম্বে তাদের দাবি মেনে নেয়ার আহবান জানান।
সংগঠনের চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক এস এম আরিফ হোসেনের সঞ্চালনায় সভায় অতিথি ছিলেন বাকাসস’র বিভাগীয় কমিটির সহ-সভাপতি স্বদেশ শর্মা, আন্দোলন বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক উদয়ন কুমার বড়ুয়া, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মো. জামাল উদ্দিন ও নুরুল মুহাম্মদ কাদের। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাকাসস চট্টগ্রাম জেলা শাখার সদস্য প্রদীপ কুমার চৌধুরী, আলী আজম খান, শোয়াইব মুহাম্মদ দুলু, স্বপন কুমার দাশ, কানু বিকাশ নন্দী, ফজলে আকবর, মহিউদ্দিন আহমেদ, কাজলী দেবী, মো. জাহাঙ্গীর আলম, আবদুল মোমিন, নাজিমউদ্দিন চৌধুরী, আবদুল মন্নান, বেগম সাদিয়া নুর, সৈয়দ মোহাম্মদ এরশাদ আলম, সাহেদুল ইসলাম, অপর্না দাশ, শুভ্রা চাকমা, সফিউল আলম, মো. মহসীন, রিয়াজ উদ্দিন আহমদ, সাইদুল ইসলাম, এম,এ হাসেম, মো. খোরশেদ, পরাগ মনি, মনিরথ দাশ, অরুন কান্তি মল্লিক, সুফিয়া বেগম, মো. কামরুল ইসলাম, হেলাল হোসেন, মোহাম্মদ আয়ুব প্রমূখ।
সমিতি সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে মাঠ প্রশাসনের বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী ও ভূমি কার্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণির (১৩-১৬ গ্রেড) ৫ শতাধিক কর্মচারী রয়েছেন। এ সংখ্যা সারা দেশে আছে প্রায় ১৩ হাজার। এর মধ্যে প্রতিটি শাখায় কাজ করছেন পাঁচ থেকে আটজন অফিস সহকারী। কিন্তু প্রতি শাখায় উচ্চমান সহকারীর পদ আছে মাত্র একটি। ফলে মাঠ প্রশাসনের বেশিরভাগ কর্মচারী অফিস সহকারী থেকে পদোন্নতির সুযোগ পাচ্ছেন না। অফিস সহকারী হিসেবেই চাকরি জীবন শেষ করতে হচ্ছে তাদের। পদোন্নতির কোনো ব্যবস্থা নেয়নি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
কর্মচারীরা জানান, পদোন্নতি ছাড়াই একই পদে কাজ করছেন মাঠ প্রশাসনের এমন হাজার হাজার কর্মচারী। এই কষ্ট নিয়ে অবসরে যাচ্ছেন। এই বৈষম্যের অবসান চেয়ে দুই দশক ধরে নানাভাবে আন্দোলন করছেন তারা। পদবি ও গ্রেড পরিবর্তনের জন্য তারা প্রধানমন্ত্রী, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন একাধিকবার। নীতিনির্ধারকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন বহুবছর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদোন্নতির নির্দেশনা দিলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তা বাস্তবায়ন করেনি।