মদ মানুষকে ধ্বংস করে

531

মদ্যপ হওয়া অথবা মদ মানুষকে কোন পর্যায়ে বা স্তরে নিয়ে যেতে পারে সে সম্পর্কে একটি অদ্ভুত খবর বেরিয়েছে সম্প্রতি বাংলাদেশ, ভারত এমনকি আমেরিকার কোনো কোনো পত্রিকায় যা আমাদের সম্মানিত পাঠকদের উপহার দিতে চাই। পাঠক নিশ্চয়ই খবরটি উপভোগ করবেন। খবরটি আকারে ছোট হলেও তাৎপর্যে বড়। খবরটি হলো আমাদের এই উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে একটি বটগাছ দীর্ঘ সোয়া শ’ বছর ধরে ‘জেল খাটছে’। ১২১ বছরেও বুড়ো বটের মুক্তি মেলেনি। পেশোয়ার এলাকার এই বটগাছ হয়ে আছে এক মদ খাওয়া মাতালের শিকার। এ জন্য গাছটার গা ভর্তি শেকল। যা বন্ধন ও দাসত্বের প্রতীক। জানা গেছে, ১৮৯৮ সালে স্থানীয় লান্ডিকোটাল ক্যান্টনমেন্টের এক ইংরেজ অফিসার মদ খেয়ে চুর হয়ে সে পথে যাচ্ছিল। তখন মদের নেশার ঘোরে তার কাছে মনে হয়েছিল, বটবৃক্ষটি তার দিকে তেড়ে আসছে (সম্ভবত এই কর্মকর্তাকে মদ পানের শাস্তি দেয়ার জন্য)। সাথে সাথে সিপাইদের প্রতি জেমস স্কোয়াইড নামের সাদা চামড়ার লোকটির অর্ডার, ‘বে আদব গাছটাকে গ্রেফতার করো’ আদেশ তৎক্ষনাৎ প্রতিপালিত হলো। বটগাছটি কঠোর সাজা পেলেও দোষী মিলিটারি অফিসারের প্রাপ্য শাস্তি সে ভোগ করেছে বলে জানা যায় না। উল্লেখ্য তখন আমাদের এই উপমহাদেশ জুড়ে ছিল শ্বেতাঙ্গ ব্রিটশদের শাসন। তাদের মুখের কথাই অনেক ক্ষেত্রে ছিল ‘আইন’ মাদক সেবনের পরিণতি যে কত ব্যাপক ও ভয়াবহ সে বিষয়ও প্রমান করছে সবার সমনে, মদসহ বিভিন্ন প্রকার মাদকের প্রতি আসক্তি মুনষকে অমানুষ করে তোলে। সে তখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ইসলামে মাদকাসক্তিকে নিষিদ্ধ করার প্রধান কারণ এটি। আমাদের দেশে অতীত থেকে বহুবার অভিযান চালানো হয়েছে ও হচ্ছে মাদকের বিরুদ্ধে। কিন্তু দেশী-বিদেশী মদসহ নানা প্রকার মাদক দ্রব্যের ব্যবহার এবং এর আমদানি, পরিবহন, সরবরাহ, মজুদ, তথা কারবার মোটেই কমেনি। এ দিকে কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি মোকাবেলায় হিমশিম খাওয়ার পাশাপাশি, বিশেষত কিশোর তরুণ যুবকরা ক্রমবর্ধমান হারে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে।

Bangladesh batsman Mohammad Mahmudullah plays a shot during the third day of the first Test cricket match between South Africa and Bangladesh in Potchefstroom on September 30, 2017. / AFP PHOTO / GIANLUIGI GUERCIA

ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি। বস্তির মেথর বা ধাঙ্গর থেকে শুরু করে অট্টালিকার ধণাঢ্য বিলাসী পর্যন্ত বহুলোক নিয়মিত মদ্যপায়ী। তারা এর পেছনে মোটা অংকের টাকা খরচ করে থাকে। নেশার খোরাক জোগাতে গিয়ে অনেকেই লিপ্ত হয় জুয়া খেলায়। অনেকে বাপের টাকা আর মায়ের গয়না চুরি করে। নেশা করতে গিয়ে অনেকে সংসারে অনটন ও অশান্তি বাড়িয়ে তোলো। আর জুয়ারিদের একটা অংশ বারবার হেরে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। তাছাড়া মদপান বা মাদকের আসক্তির সাথে জুয়া, মিথ্যাচার, নির্যাতন, নারী নিপীড়ন এবং চুরি ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপরাধ সম্পৃক্ত। ইংরেজিতে একটি প্রচলিত কথা আছে ওয়াইন (ডরহব) এবং মেয়ে (ডড়সধহ) এসব মিলিয়ে শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সর্বনাশ নিশ্চিত হয় না, তার পরিবার ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায় এবং সমাজটা দৃশ্যত যতই সমৃদ্ধ হোক, মূলত পাপাচার ও অন্যায়ই হয়ে দাঁড়ায় এর পরিণাম।
প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময় একদিন বাসায় ফেরার পথে দেখি। থানার সামনে হইচই আর ভিড়, আমরা দু’ তিনজন ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম ঘটনা জানার জন্য সেখানে দেখলাম এক মেথর তার মতো লম্বা একটা বাঁশ নিয়ে একাই থানায় হামলা চালিয়েছে। সে বলছিল ‘‘ ইয়ে থানা হামারা সম্পত্তি হ্যায়’’। হিন্দিভাসী ও মদখোর এই মেথরকে শহরের অনেকেই চিনতেন। সেদিন মদ খেয়ে মাতলামি করতে করতে লোকটা থানাকে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করেছিল। একজন দারোগা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। আরো বড় হয়ে দেখেছি, গরিব ও অশিক্ষিত মেথরের ‘বাংলা মদ’ পানেই সীমিত নয় এই বদাভ্যাস। সচ্ছল ও শিক্ষিত লোকজনের একাংশও মদে আসক্ত। তখন হেরোইন, ফেনসিডিল, ইয়াবা, সিসা প্রভৃতি ছিল না। বরং অনেকে গাজা-আফিম, ভাং, তাড়ি দিয়ে মাদক সেবনের কাজ সারিয়ে নিত।
শৈশবে দেখেছি মেথরের মাতলামি। পরে শুনলাম আমাদের সমাজে গণ্যমান্য কারো কারো পানাভ্যাস আছে। মদে আসক্ত এমন লোকজনকে কেউ কেউ ঠাট্টা করে ‘মান্যগণ্য জঘন্য’ বলতেন, এ ধরনের লোকেরা সাধারণত ভদ্রবেশি বিত্তবান ও বেশ প্রভাবশালী। তাদের অনেককে দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, উনি মদের প্রতি আসক্তি বোধ করেন। আমাদের দেশে সম্মানজনক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার অনেকেও সঙ্গদোষে বা অন্য কোনো কারণে মদ বা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। সৎ সাধারণ ও নিরীহ মানুষ তাদের এসব কারবার দেখে অবাক হওয়া বা আফসোস করা ছাড়া আর কি-ইবা করতে পারেন।
বাজারে যাওয়ার পথে এক জায়গায় দেখতাম একটা ব্যতিক্রমী বিপনি। ছোট ছোট খোপের মতো কাউন্টার। সেখানে কী যেন বিক্রি হয়। আর খরিদ্দারও নির্দিষ্ট কয়েকজন। মাঝ বয়সী এক বাবা আর তার তরুন ছেলে মিলে ব্যবসাটা চালাতেন। জানলাম, এটা ‘অনুমোদিত গাজার দোকান’। যাদের পারমিট আছে, তারাই কেবল এ দোকান থেকে গাজা কিনতে পারে সীমিত পরিমাণে। নেশা করার এই আইন সম্মত ব্যবস্থা এক দিকে ঔপনিবেশিক যুগের ধারাবাহিকতা; অন্য দিকে, প্রচলিত আইনের দুর্বলতা ও স্ববিরোধিতার একটি নজির। কেউ উল্টাপাল্টা কথা বললে তাকে ব্যঙ্গ করা হতো ‘গাজা খোর’ বলে। কিন্তু এ যুুগে কেউ মদ পান করে যত অন্যায় বা অস্বাভাবিক আচরণ করুক না কেন; তাকে ‘মদখোর’ বলার সাহস কারো দেখা যায় না।
এক সময় দেখা যেতো অনেক স্থানে গাজা চাষের জন্য পরিচিত ছিল। তা বলে মনে করা উচিত হবে না যে, সেখানে বেশির ভাগ মানুষ গাজা খায়। প্রশাসনের অনুমোদনেও পৃষ্ঠপোষকতায় এসব স্থানে গাজার চাষ করা হতো। তা থেকে সরকারের আয়ও হতো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। এখনকার কথা আমার জানা নেই। তবে মনে হয় ্এসব অনুমোদন আর নেই। মদখোর ও গাজা খোরদের নিয়ে বানানো একটি ছড়া উল্লেখ করছি। যেমনÑ ‘এক ছিলিমে যেমন তেমন/ দু’ছিলিমে প্রজা/ তিন ছিলিমে উজির নাজির / চার ছিলিমে রাজা। ও আমার মদ ও গাজা’। আবার ‘গাজার নৌকা পাহাড় দিয়া যায়’ বলা হতো উদ্ভট, অবাস্তব, অযৌক্তিক ও অসঙ্গত আচরণ প্রসঙ্গে।
গত শতকের শেষ দশকে ঢাকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রামে যেতে হয়েছিল পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে। সকাল ১০টায় সভা শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু দীর্ঘ সময় পরেও প্রধান অতিথি সভায় পৌঁছতে না পারায় তাকে ছাড়াই সভার কাজ শুরু হয়েছিল। জানা গেল সরকারের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পানদোষ ছিল এবং এ কারণে অনেক সময় রাতে তিনি ঘুমাতেন অনেক দেরি করে। ফলে পরদিন সকালের প্রোগ্রামে সময়মত তিনি হাজির হতে পারেন নি। শুধু আমার বা নেতাদের কথাই বা বলব কেন ? সমাজে যারা বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত এবং মিডিয়া, বিনোদন, শিক্ষা-সংস্কৃতির অঙ্গনের মহাজন, তাদের মধ্যে অনেকেই মদ জাতীয় পানীয় সেবনের অভ্যাস করে এর ফাদ থেকে বের হতে পারেননি। তাদের মেধা, প্রতিভা, যোগ্যতা কম নয়। কিন্তু এই মন্দ অভ্যাস না থাকলে দেশ ও জাতিকে তারা অনেক বেশি দিতে পারতেন। খুব প্রতিভাবান ও সাহসী ব্যক্তিদের কেউ কেউ এ কারণে অকালে হারিয়ে গেছেন। পরিবারকে অসহায় অবস্থায় ফেলে তারা চিরবিদায় নিয়েছেন। কথায় বলে, ‘মানুষ প্রথমে মদ বা মাদক খায়। কিন্তু পরে সেই মন্দ জিনিষটিই তাকে গ্রাস করে। আমাদের দেশে বিভিন্ন পেশার বহু কৃতী ব্যক্তিত্ব এভাবে হারিয়ে গেছেন চিরতরে। তারা প্রথমে স্বীয় কর্মক্ষেত্র থেকে এবং এক পর্যায়ে পৃথিবী থেকেই স্থায়ীভাবে চলে গেছেন। স্বজনের কান্না, ভক্তদেশ আহাজারি। কিছুই তাদের আর ফিরিয়ে আনতে পারেনি।
পাদটীকাÑ এক মাতালের কাহিনী শুনেছিলাম অনেক আগে। রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফেরার সময় যে ড্রেনে ময়লার ভিতর পড়ে যায়। তখন রাগে ক্ষোভে বলতে থাকে, ‘শালার ড্রেন, সারাদিন তুই থাকিস রাস্তার এক পাশে। রাতে যখন আমি বাড়ি যাই, তখন কেন রাস্তার মাঝখানে চলে আসিস ও এই মাতাল একবার গভীর রাতে টলতে টলতে হাটছিল ‘সে সময়ে হঠাৎ একটা লাইট পোষ্টের সাথে প্রচÐ ধাক্কা খায়। সাথে সাথে সে লোহার থামের গোড়ায় দু’হাত দিয়ে কদমবুচি করা শুরু করে দেয়। তখন তার কাছে সে লাইটপোষ্টকে মনে হয়েছিল তার শ্রদ্ধেয় বাপজান। তাই নেশার ঘোরে বলতে থাকে ‘আব্বাজান, আজকের মতো মাফ করে দেন।’
দু’মাতালের একজন আরেকজনকে বলছে, ‘দেখেছিস, পানিতে আগুন লাগায় সব মাছ গাছে উঠে গেছে।’ শোনে দ্বিতীয় মাতাল বলল, ‘তুই আস্ত পাগল হয়ে গেছিস নাকি ? মাছ তো আর গরু না যে, গাছে চড়বে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট