ভ্যাট বাড়ালে চাপ বাড়ে কার ওপর?

83

বহুল আলোচিত নতুন ভ্যাট আইন আগামী ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। তবে, ভ্যাট আইনটি কার্যকর হওয়ার পর ভোক্তাপর্যায়ে বাড়তি ভ্যাটের চাপের আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্য, ভ্যাট নিয়ে ব্যবসায়ীরা কথা বললেও এর চাপ বাড়ে মূলত ভোক্তার ওপর। কারণ, ভ্যাট দেন ভোক্তারাই। এদিকে, নতুন আইনে সব মিলিয়ে পাঁচটি ভ্যাট স্তর হচ্ছে। এই স্তরগুলো হলো ২, ৫, ৭ দশমিক ৫, ১০ ও ১৫ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নতুন আইনে যেভাবে ভ্যাট আদায়ের প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে মোট কর-ভার পণ্য ও সেবার মূল্যে গড়ে ২৭ শতাংশ থেকে ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে, যা এখন আছে ২০ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ভ্যাট দেয় ভোক্তারাই। ভোক্তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট দিচ্ছে। ভোক্তাদের দেওয়া এই ভ্যাটের অর্থ ব্যবসায়ীদেরই সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়। কিন্তু অনেক সময় ব্যবসায়ীরা সঠিকভাবে এই ভ্যাটের অর্থ জমা দেয় না’। তিনি বলেন, ‘নতুন আইনে দুই পদ্ধতিতে ভ্যাট আরোপ হতে যাচ্ছে। যারা ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দেবেন, শুধু তারাই রেয়াত পাবেন। অন্যরা রেয়াত পাবেন না। এতে ট্যাক্স অন ট্যাক্স বা করের ওপর কর (দ্বৈত কর) আরোপ করা হবে। তখন পণ্য ও সেবার খরচ বাড়বে, যা ভোক্তার ঘাড়ে এসে পড়বে’। পৃথিবীর কোথাও এমন আইন নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
এ প্রসঙ্গে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)-এর সাবেক সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘নতুন আইন চালু না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না, ভোক্তাদের ওপর চাপ বাড়বে কি বাড়বে না’। তিনি বলেন, ‘নতুন আইনে ভ্যাটের হার হচ্ছে পাঁচটি। এতে সর্বনিম্ন ২ শতাংশ ও সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। কিন্তু আমরা এখনও জানি না, কোন স্তরে কোন কোন পণ্য থাকবে। ফলে কোন ধরনের ভোক্তার ওপর বেশি চাপ পড়বে তাও বলা যাচ্ছে না। তবে যেখানে সমস্যা হবে, সেখানে সমাধানও হবে। কাজেই আগে আইনটা বাস্তবায়ন হোক’।
হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার পর মাঠপর্যায়ে কোনো সমস্যা হলে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করবে সরকার। যেমন, রেয়াত নিতে না পারলে যদি পণ্যের দাম বাড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে তখন সরকার দেখবে’।
প্রসঙ্গত, আগামী (২০১৯-২০) অর্থবছরে সোয়া তিন লাখ কোটি টাকা রাজস্বের জোগান দিতে আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) খাতে মূল নজর থাকবে সরকারের। এই পরিমাণ অর্থ আহরণ করতে হলে সরকারকে করের আওতা বা করদাতা বাড়াতে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ‘করের আওতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এর সঙ্গে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হওয়া দরকার’। তিনি উল্লেখ করেন, আইনটির বাস্তবায়নই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
জানা গেছে, এবার রাজধানী ঢাকাসহ সিটি কর্পোরেশন এলাকার বাড়ির মালিকদের রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতায় আনা হবে। রাজধানী ঢাকাসহ সিটি কর্পোরেশন এলাকার বাইরে জেলা, উপজেলা এমনকি গ্রামেও আয়করের আওতা বাড়ানোর বিষয়ে ঘোষণা করবে সরকার। টিআইএনধারী বিদ্যমান ৪০ লাখ থেকে বাড়িয়ে এক কোটিতে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে এনবিআরের। অতীতে প্রতিষ্ঠান লোকসান দেখিয়ে কর এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও এবার সে সুযোগ বাতিল হচ্ছে। লোকসান করলেও কর পরিশোধ করতে হবে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার না কমলেও মুনাফায় করের হার বিদ্যমান পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়তে পারে। গার্মেন্টসসহ সব ধরনের রফতানিতে উৎস কর হারও বাড়তে পারে।
জানা গেছে, নতুন আইনে ১৫ শতাংশের নিচের ভ্যাট স্তরে রেয়াত সুবিধা না থাকা এবং কাদের ওপর কি ধরণের হার নির্ধারণ হয়, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এ আইনে জনজীবনে পজিটিভ প্রভাব ফেলতে পারে যেমন- ওষুধ, পেট্রোলিয়াম, রড, বিভিন্ন জাতের মসলা, কাগজসহ বেশ কিছু পণ্য। এসব পণ্যে বিশেষ ব্যবস্থায় কম হারে ভ্যাট হার নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। যেন দাম সহনীয় থাকে।
উল্লেখ্য, দুই বছর স্থগিত থাকার পর আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হওয়ার কথা। আজ (বৃহস্পতিবার) জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হবে।
জানা গেছে, বর্তমানে ১৯৯১ সালের আইনে নির্দিষ্ট খাতে (৩৯টি) প্রযোজ্য হারে ‘উৎসে’ ভ্যাট আদায় করা হয়। নতুন আইনে প্যাকেজ ভ্যাট ছাড়া প্রায় সবই বহাল থাকছে। নতুন ও পুরনো আইনের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। একাধিক ভ্যাট হার, টার্নওভার কর থাকবে। বিদ্যমান সম্পূরক শুল্ক হারও বহাল থাকবে। তবে নতুন আইনে উৎসে ভ্যাট কর্তনের পরিধি ব্যাপক বাড়ানো হচ্ছে। এখন শুধু আমদানি পর্যায়ে বাণিজ্যিক পণ্যে (কমার্শিয়াল ইমপোর্টার) ‘অগ্রিম’ ভ্যাট (এটিভি) আদায় করা হয়। নতুন আইনে বাণিজ্যিকসহ সব পণ্যে অগ্রিম ভ্যাট দিতে হবে। ফলে ভ্যাটের আওতা ব্যাপক হারে বাড়বে।
বিশেষ কিছু পণ্যের জন্য থাকছে দুই শতাংশের ভ্যাট। এছাড়া যেসব পণ্য বর্তমানে ট্যারিফ পদ্ধতিতে ভ্যাট দিচ্ছে, এমন বিশেষ কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে (ওজনে পরিমাপ হওয়া পণ্য) ‘স্পেসিফিক ভ্যাট’ নামে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভ্যাট আদায় হবে। অগ্রিম ভ্যাট (এটিভি) আদায় হবে অগ্রিম কর নামে। বর্তমানে কেবল বাণিজ্যিক পণ্যের আমদানিতে ৫ শতাংশ অগ্রিম ভ্যাট আদায় হলেও বন্ডেড সুবিধায় আনা পণ্য বাদে অন্য সব ধরণের পণ্যের ক্ষেত্রে অ্যাডভান্স ট্যাক্স দিতে হবে। বছরে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি (টার্নওভার) ভ্যাটমুক্ত থাকছে। পরবর্তী তিন কোটি টাকা পর্যন্ত বিক্রিতে চার শতাংশ হারে টার্নওভার ট্যাক্স আদায় হবে।
পণ্য বা সেবা আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ, উৎপাদনে ১০ শতাংশ, পাইকারি পর্যায়ে ৭.৫ শতাংশ এবং খুচরায় ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হবে। এত দিন যেসব পণ্য বা সেবায় ট্যারিফ মূল্য ও সংকুচিত ভিত্তিমূল্যের ওপর ভ্যাট দিতো, সেখানে ২ শতাংশ হারে ভ্যাট নির্ধারণ করা হচ্ছে। তবে মৌলিক খাদ্য, নির্ধারিত জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, গণপরিবহন সেবা, গণস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, কৃষি, মৎস্য চাষ, দাতব্য প্রতিষ্ঠানের অবাণিজ্যিক কার্যক্রম, অলাভজনক সাংস্কৃতিক সেবা- এসব ক্ষেত্রে ভ্যাট দিতে হবে না। এই তালিকায় রয়েছে ১ হাজার ৯৮৩টি পণ্য ও সেবা।
ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সীমিত পরিসরে অনলাইনভিত্তিক ভ্যাট রিটার্ন জমা বা ভ্যাট পরিশোধের সুযোগ দিয়ে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু হবে। কিছুটা অনলাইনভিত্তিক হবে। আবার হিসাব-নিকাশ আগের মতো খাতা কলমেও রাখা যাবে। কারণ, ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো কি ধরণের সফটওয়্যার ব্যবহার করবে, তা এখনও চূড়ান্ত করা যায়নি।