ভাষাসৈনিক কালা চান বাবু ও চট্টগ্রামের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস

215

নব্বই বছর দেশের গড় আয়ুর তুলনায় বেশ দীর্ঘ বয়স। এই বয়সে প্রয়াণ মানে পরিণত বয়সে দেহাবসান। সে অর্থে কালা চাঁদ বাবুর মৃত্যু অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু কিছু কিছু জীবন যত ব্যাপক, যত দীর্ঘ হয় ততই মঙ্গল। তাঁদের নির্বাপণে দেশ ও সমাজের ক্ষতি। আক্ষরিক প্রদীপ নিভে যাওয়া। মূঢ়তার কারণে আমরা ভাবি রাজনীতি একমাত্র নিয়ামক, কেবল রাজনৈতিক নেতা বা কর্মকাÐের ফলাফলই দেশ নিয়ন্ত্রণ করে। সময়ও শুধু এসব মনে রাখতে সচেষ্ট। মূলত তা নয়। নয় বলেই কালা চাঁদ বাবুকে বাংলাদেশ ভুলতে পারেনা। সময়ের ফ্রেমেই জীবন্ত তিনি। চট্টগ্রামের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যে কজন সপ্তসুরে বেঁধেছেন, তারই এক কারিগর কালা চাঁদ বাবু। প্রকৃত নাম শ্রী কৃষ্ণ গোপাল সেন। ৪ অক্টোবর, ২০১৮ সালে ৯০ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন। আজ ৪ অক্টোবর ২০১৯ প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর প্রথম মৃত্যুবাষিকী উপলক্ষে দেওয়ানজী পুকুর পাড়স্থ পূজামÐপ প্রাঙ্গণে কালা চাঁদ বাবুর স্থায়ী আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হচ্ছে। এই অনুষ্ঠাানে উপস্থিত থাকবেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল,আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. অনুপম সেন সহ চট্টগ্রামের বিশিষ্ট জন।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে কালা চাঁদ বাবুর আবিভৃাব হয়েছিল এক দুরন্ত কিশোর হিসেবে। পাকিস্তান যখন সা¤প্রদায়িক মন নিয়ে দ্বিজাতিতত্তে¡র খন্ডিত ‘গন্দম’ ভক্ষণ করল, তখন সাম্রাজ্যবাদী বিষে জর্জরিত সা¤প্রদায়িকতার ভয়ঙ্কার ঘৃণ্য ও কুৎসিত দৃষ্টিতে স¤প্রীতি বিধ্বংসী বিভাজন হয়েছিল। আর তারই প্রতিবাদে মার্কসবাদী চৈতন্যে দীক্ষিত তরুণ কালা চাঁন বাবু দৃপ্ত পায়ে সংগঠক হিসেবে চট্টগ্রামের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জগতের ‘কমান্ডার’ হিসেবে আবির্ভুত হলেন।


আমি তাঁকে জেনেছি এবং চিনেনি একজন কট্টর মার্কসবাদী রাজনৈতিক সংগ্রামী সংগঠক হিসেবে। তাঁর এবং সমকালীন বন্ধুদের মধ্যে যাঁরা প্রান্তিক নবনাট্য সংঘের সাথে জড়িত ছিলেন তাঁদের মধ্যে ভাষা সৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী, গণশিল্পী বলিষ্ঠ সুরকার অচিন্ত্য চক্রবর্তী, গণগায়ক কলিম শরাফী, গোপাল বিশ্বাস, চিরঞ্জীব দাশশর্মা, সুচরিত চৌধুরী, হরিপ্রসন্ন পাল, ফনী বড়–য়া প্রমুখ। এঁদের ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকে প্রগতিশীলতার যে পত্তন হয়েছিল কালা চাঁদ বাবু ছিলেন তার অন্যতম নির্মাতা। তাছাড়া তিনি রাজনৈতিকভাবে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন কমিউনিস্ট নেতা সুখেন্দু দস্তিদারের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে তাঁরই প্রেরণায় সাহচর্যে ঐতিহ্যবাহী দেওয়ানজী পুকুর পাড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় অগ্রণী সংঘ। বলতে গেলে খুব অল্প বয়সেই কমিউনিস্ট পার্টিও সাথে যুক্ত হয়ে যান তিনি। যুব ও সংস্কৃতি সংগঠন গড়ার দায়িত্ব পান তিনি। নন্দনকাননে গড়ে তোলেন আরেকটি যুব-সংগঠন- শক্তিসংঘ।
একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন, এসময় নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের দ্বিজাতিতত্ত¡-খন্ডিত পূর্বাংশে আমাদের বাস। এ অঞ্চল ভাগ হওয়ার পর পূর্ববাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রগতিশীল বলয় কেবল নয়, সংস্কৃতি বলয়টারই টালমাটাল অবস্থা। সংস্কৃতি ও প্রগতিমনা বহুজনই এই সা¤প্রদায়িক বিভক্তির বাংলায় থাকার স্থান পাননি, চলে গেছেন ভারতে। এমনকি কমিউনিস্টরাও, যাঁরা আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাস করতেন, তারাও দেশত্যাগ করলেন। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগের পরের সে ঊন্মতাল দিনগুলোতে ১৯৫০ সালে সেদিনকার যুব নেতা মাহবুব-উল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে হরিখোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব বঙ্গ সাংস্কৃতি সম্মেলন। কোলকাতা থেকে এতে যোগ দিতে এসেছিলেন প্রখ্যাত গণসংগীত শিল্পী সলিল চৌধুরীর নেতৃত্বে গণনাট্য সংঘের এক বিশাল দল। অসা¤প্রদায়িক রাজনৈতিক বাতাবরণ গড়ে তোলার লক্ষে আহুত এ সমেলন বানচালের হুমকি দেয় মুসলীম লীগ। তা মোকাবেলা করে সম্মেলনস্থলের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার সার্বিক দায়িত্ব অর্পিত হয় কালা চাঁদ বাবুর উপর। অগ্রণী সংঘ, শান্তি সংঘ ও চকবাজার নওজোয়ান ক্লাবের সর্বমোট ৬শ সদস্যেও স্বেচ্ছাসেবক ব্রিগ্রেড গঠন করে পাঁচ দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত সম্মেলনকে সার্থক করে তোলেন তিনি। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে নন্দনকাননের সরভুজ মজুমদার গ্যারেজে বসে প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও কালা চাঁন বাবু পালন করেন অনন্য ভূমিকা। একদিকে সাংস্কৃতিক আন্দোলন, অন্যদিকে ভাষার অধিকারের দাবিতে গড়ে উঠার আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন তিনি। ৫২-এর ২১ ফেব্রæয়ারি ঢাকায় সংগঠিত ছাত্রহত্যার পর পর ভাষার আন্দোলনকে নস্যাতের অভিপ্রায়ে চট্টগ্রামে যে ১৪ জনকে আটক করেছিলো সরকার, কালা চাঁদ বাবু তদোর মধ্যে অন্যতম একজন। দীর্ঘ ১০ মাস কারান্তরালে থ্কাাবস্থায় একটানা ৪০ দিন অনশন ধর্মঘটের পর তিনি মুক্ত হন।
৬০-র প্রলয়ংকারী জলোচ্ছ¡াসের পর আর্তমানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েন কালা চাঁন বাবু। দেওয়ানজী পুকুর পাড় এলাকার ১৫জন যুবককে সাথে নিয়ে রান্না করা খিচুড়ি বিতরণ করেন কুমিরা, সীতাকুÐম বরতাকিয়ার উপদ্রæত এলাকায়। ত্রাণকাজ ছাড়াও দুঃস্থদের আশ্রয়দানের ব্যবস্থা করেন। ঐতিহ্যবাহী প্রবর্তক সংঘের তৎকালীন সম্পাদক কর্মবীর বীরেন্দ্র লাল চৌধুরী এ মহৎ কাজে শ্রী সেনকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে নিজ তহবিল থেকে ১০০০ টাকা আর্থিক অনুদান দিয়ে আর সংঘের ১০জন অনাথ ছাত্রকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব দিয়ে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর প্রায় পুরোটা সময় কালা চাঁদ বাবু ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুরে ধ্বজনগর যুব শিবিরের তত্ত¡াবধায়কের দায়িত্ব পালন করেন। তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য প্রখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী তাঁকে এ দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের আগে-পরে যুবকরা এখানে অবস্থান করতেন। প্রাক্তন গণ পরিষদ সদস্য এম কফিলউদ্দিন প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতারাও এখানে থাকতেন। ৭১ -র ২৫ নভেম্বরে ভারত সরকারের নির্দেশে চার দিনের মধ্যে বাঁশ দিয়ে একশ খড়ের বেডের হাসপাতাল তৈরি করেন কালা চাঁন বাবু, যা নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকার কর্তৃক প্রশংসিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম উপ-অধিনায়ক ক্যাপ্টেন সুজাত আলী তা উদ্বোধন করেন।
শৈশব-কৈশোর-যৌবন-বার্ধক্যের সুদীর্ঘ জীবনে দেওয়ানজী পুকুর পাড় এলাকার ও আশেপাশের হিন্দু-মুসলিম সর্বস্তরের এলাকাবাসী সবাই কালা চাঁদ বাবুর বড়ই আপনজন। এলাকাবাসীর সুখে-দুঃখে বিপদে-আপদে তিনি ছিলেন সর্বক্ষণ। তাদের পাশে থেকে স্বীয় দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থেকেছেন। ৭২ সাল পর্যন্ত এলাকার পরিবেশটা ছিলো এমন যেনো সবাই একই ঘরের। শহর জীবনের কোলাহল ছিল এখানে অনুপস্থিত। শান্তি-স¤প্রীতি সৌহার্দ্যরে মেলবন্ধন সর্বত্রই। পাড়ার যুবকদের সংঘবদ্ধ শক্তির পাশাপাশি শ্রী সেনের অকুতোভয় ভূমিকা নানান সময়ে নানান প্রতিকুল পরিস্থিতিতে এলাকাকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন। স্বাধীনতাত্তোরকালেও এলাকার ঐক্যবদ্ধ যুবশক্তি গঠনের অভিপ্রায়ে পুনরায় উজ্জীবিত করেন অগ্রণী সংঘকে। গড়ে তোলেন পাঠাগার, প্রতিষ্ঠা করেন অগ্রণী সংগীত শিক্ষা কেন্দ্র। তারই একান্ত প্রচেষ্টায় অগ্রণী সংঘ আজ নিজ জায়গার উপর দাঁড়িয়ে আছে। জনস্বার্থে ঐতিহ্যবাহী দেওয়ানজী পুকুরের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে তিনি পালন করেন অগ্রণী ভূমিকা। নানান প্রতিকূল পরিস্থিতি এর অস্থিত্ব বিলীন করলেও কালা চাঁদ বাবু এলাকার বিশিষ্টজনদের সাথে নিয়ে এলাকার ঐতিহ্য রক্ষায় প্রায় সাড়ে সাত গন্ডা জমিতে স্থায়ী সার্বজনীন পূজামন্ডপ গড়ে তুলেন। গঠন করে ট্রাস্ট্রি বোর্ড। শুধু কি তা-ই। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে হানাদার পাকিস্তানিদের হাতে নির্মমভাবে নিহত এলাকার শহীদদের এবং এলাকায় বসবাসকারী দেশবরেণ্যদের স্মৃতিকে নব প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার জন্যে শহীদ মিনার গড়ে তোলেন। সমাজ অনুভবে, সংস্কৃতির উন্মোচনে, ভাষার আন্দোলনে, মুক্তির সংগ্রামে কালা চাঁন বাবু পালন করেছেন অগ্রগণ্য ভূমিকা। তাই তিনি আমাদের নমস্য-শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়।
শ্রী কৃষ্ণ গোপাল সেন (কালাচাঁদ)-র জন্ম চট্টগ্রামেরে রাউজান থানাধীন কোয়েপাড়া গ্রামে ১৯২৯ সালের ২৪ নভেম্বর। পিতা স্বর্গীয় যোগেশ চন্দ্র সেন, মাতা স্বর্গীয়া সুহাসিনী সেন।
লেখক : গবেষক ও প্রকাশক