ভালোবাসার বড়ই অভাব

155

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। নানা বয়সের মানুষের ভালোবাসার বহুমাত্রিক রূপ প্রকাশের আনুষ্ঠানিক দিন। এ ভালোবাসা যেমন মা-বাবার প্রতি সন্তানের, তেমনি মানুষে-মানুষে ভালোবাসাবাসির দিনও এটি। কিন্তু শুধু একটি দিন ভালোবাসার জন্য কেন? এ প্রশ্নে কবি নির্মলেন্দু গুণের ছোট জবাব, ‘ভালোবাসা একটি বিশেষ দিনের জন্য নয়। সারা বছর, সারাদিন ভালোবাসার। তবে আজকের এ দিনটি ভালোবাসা দিবস হিসেবে বেছে নিয়েছে মানুষ।’
তারুণ্যের অনাবিল আনন্দ আর বিশুদ্ধ উচ্ছাসে সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশের তরুণ-তরুণীদের মাঝেও ভালোবাসা দিবস পালিত হচ্ছে। ভালোবাসার উৎসবে মুখর আজ নগর। এ উৎসবের ছোঁয়া লেগেছে গ্রাম-বাংলার জনজীবনেও। মুঠোফোনের মেসেজ, ই-মেইল অথবা অনলাইনের চ্যাটিংয়ে পুঞ্জ পুঞ্জ প্রেমকথার কিশলয় হয়ে উঠবে পল্লবিত। অনেকের মতে, ফেব্রুয়ারির এ সময়ে পাখিরা তাদের জুটি খুঁজে বাসা বাঁধে। নিরাভরণ বৃক্ষে কচি কিশলয় জেগে ওঠে। তীব্র সৌরভ ছড়িয়ে ফুল ফোটে সৌন্দর্যবিভায়। পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়। এ দিনে চকোলেট, পারফিউম, গ্রিটিংস কার্ড, ই-মেইল, মুঠোফোনের এসএমএস-এমএমএসে প্রেমবার্তা, হীরার আংটি, প্রিয় পোশাক, জড়াজড়ি করা খেলনা মার্জার অথবা বই ইত্যাদি শৌখিন উপঢৌকন প্রিয়জনকে উপহার দেয়া হয়।
অন্যদিকে আজকের এ ভালোবাসা শুধুই প্রেমিক আর প্রেমিকার জন্য নয়। মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, ভাইবোন, প্রিয় সন্তান এমনকি বন্ধুর জন্যও ভালোবাসার জয়গানে আপ্লুত হতে পারে সবাই। চলবে উপহার দেয়া-নেয়া।
ইতিহাসবিদদের মতে, দুটি প্রাচীন রোমান প্রথা থেকে এ উৎসবের সূত্রপাত। এক খ্রিস্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক ফাদার সেন্ট ভ্যালেনটাইনের নামানুসারে দিনটির নাম ভ্যালেনটাইনস ডে করা হয়। ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি খ্রিস্টানবিরোধী রোমান সম্রাট গথিকাস আহত সেনাদের চিকিৎসার অপরাধে সেন্ট ভ্যালেনটাইনকে মৃত্যুদন্ড দেন। মৃত্যুর আগে ফাদার ভ্যালেনটাইন তার আদরের একমাত্র মেয়েকে একটি ছোট্ট চিঠি লেখেন, যেখানে তিনি নাম সই করেছিলেন ফ্রম ইওর ভ্যালেনটাইন। সেন্ট ভ্যালেনটাইনের মেয়ে এবং তার প্রেমিক মিলে পরের বছর থেকে বাবার মৃত্যুর দিনটিকে ভ্যালেনটাইনস ডে হিসেবে পালন করা শুরু করেন। যুদ্ধে আহত মানুষকে সেবার অপরাধে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত সেন্ট ভ্যালেনটাইনকে ভালোবেসে দিনটি বিশেষভাবে পালন করার রীতিক্রমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
ভ্যালেনটাইনস ডে সর্বজনীন হয়ে ওঠে আরো পরে প্রায় ৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। দিনটি বিশেষভাবে গুরুত্ব পাওয়ার পেছনে রয়েছে আরো একটি কারণ। সেন্ট ভ্যালেনটাইনের মৃত্যুর আগে প্রতি বছর রোমানরা ১৪ ফেব্রুয়ারি পালন করত জুনোদ উৎসব। রোমান পুরানের বিয়ে ও সন্তানের দেবী জুনোর নামানুসারে এর নামকরণ। এ দিন অবিবাহিত তরুণরা কাগজে নাম লিখে লটারির মাধ্যমে তার নাচের সঙ্গীকে বেছে নিত। ৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রোমানরা যখন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীতে পরিণত হয় তখন জুনোদ উৎসব আর সেন্ট ভ্যালেনটাইনের আত্মত্যাগের দিনটিকে একই সূত্রে গেঁথে ১৪ ফেব্রæয়ারি ভ্যালেনটাইনস ডে হিসেবে উদযাপন শুরু হয়। কালক্রমে এটি সমগ্র ইউরোপ এবং ইউরোপ থেকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
আমাদের দেশে দিনটিকে ঘিরে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। রয়েছে বর্ণাঢ্য র‌্যালি, সূচনা সঙ্গীত, ভালোবাসার স্মৃতিচারণ, কবিতা আবৃত্তি, গান, ভালোবাসার চিঠি পাঠ এবং ভালোবাসার দাবিনামা উপস্থাপনসহ আরো নানা কর্মসূচি। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে কনসার্টেরও আয়োজন করা হয়েছে।

ছেলেমেয়ে বিদেশে, স্ত্রী
ফ্ল্যাটে, তিনি বৃদ্ধাশ্রমে

প্রবীণ নিবাসের বাসিন্দাদের জীবনের বাস্তবতা এমনই করুণ
তৈয়ব চৌধুরী, রাউজান
আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসার বন্ধনে থাকার দৃঢ় প্রত্যয়ের এই দিনটি যেন ¤øান করে দেয় সন্তান-সন্ততিদের অবহেলার শিকার প্রবীণদের হৃদয়ের হাহাকার। প্রতিটি মা-বাবার আপন ঠিকানা তার পরিবার। যে সন্তানদের লালন পালন করতে জীবনটাই শেষ করে দিয়েছেন, জীবনের শেষ বেলায় এসে তাদের কাছেই বোঝা হয়ে গেছেন তারা। সকল অসহায়ত্বকে ধারণ করে বৃদ্ধ জীবনের শেষ সময়টুকু অনিচ্ছা সত্তে¡ও কাটাতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। প্রতিদান অযোগ্য আরাধ্য সন্তানদের ভালোবাসা বঞ্চিত আজ অনেক মা-বাবা। এমন অনেক মা-বাবার ঠিকানা ঠিকানা হয়েছে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়ার আমেনা-বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র তথা বৃদ্ধাশ্রমে। তাঁদের মতে- এখন তাদের কেউই আপন নয়। তাঁরা কেউ ছেলে-মেয়ে, কেউ স্ত্রী, কেউ পরিবার-পরিজনের অবহেলায় নিরুপায়। তাদের কাছে এখন অতি আপন ঠিকানা আমেনা-বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রটি।
ছেলে-মেয়ে, স্ত্রীর অবহেলা-অনাদর আর আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে অনেক দ‚রে থাকা এসব বয়স্কদের নিরানন্দ দিন কাটছে বৃদ্ধাশ্রমটিতে। অলস বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন তারা। বয়সের ভারে ন্যূব্জ হয়ে গেছেন। চলনশক্তি হারিয়ে জীবনকে টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে। আপনজনের কাছে থাকতে না পারার কষ্ট তাড়না দিচ্ছে বেশি। ফেলছেন দীর্ঘশ্বাস।
এই প্রবীণ নিবাসে থাকা উপজেলার নোয়াপাড়ার ঘাটকুল এলাকার বাসিন্দা প্রবাস ফেরত আবু আহমদের বয়স এখন ৭০ বছর। এক সময় তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবসা ও নিজ দেশে তেলবাহী জাহাজের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। এসময় তিনি নিয়েছেন ফ্ল্যাট, নগরীতে কয়েকটি জায়গাও ক্রয় করেন। বিদেশে থাকাকালীন সময়ে নিজ টাকায় নগরীর মেহেদীবাগস্থ আমিরাবাগে বিটিইআই টাওয়ারের দ্বিতীয় তলায় ফ্ল্যাট ও নগরীর শেরশাহ কলোনীতে সাড়ে ৬ গন্ডা জায়গাও নিজের সন্তান ও স্ত্রীর নামে ক্রয় করেন। আর এখন মেয়ে শারমিন আকতার থাকেন আমেরিকায়। ছেলে হাসান আহমেদ ব্যবসা করেন আবুধাবীতে। স্ত্রী জাহানার বেগম তার কেনা ফ্ল্যাটে কিন্তু আমার ঠাঁই হয়েছে রাউজানের আমেনা বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে।
কেন তিনি এই বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে- এমন প্রশ্ন করতেই ছোট্ট শিশুর মতো কেঁদে উঠেন। কান্না থামিয়ে জানান, বিদেশ থাকাকালিন সময়ে নিজের টাকা দিয়ে স্ত্রীর নামে জায়গা, ফ্ল্যাট নিয়েছি। নিয়েছি আরো বহু কিছু। কিন্তু আজ শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কারণে হারিয়েছি স্ত্রী, সন্তানদের। আজ যে টাকায় আমার ফ্ল্যাট বাড়ি ও জায়গা নেওয়া হলো। সেখানে আমি নিজেই থাকতে পারছি না। আমার উপজেলা রাউজানের এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর এখানে এলেও এখনো একবারের জন্যও তারা আমার খবর নেয়নি। মানুষের কাছেও কিছু বলতে পারছি না। নিজে নিজেই সব সহ্য করে এখানে দিন কাটাচ্ছি।
চট্টগ্রামের একমাত্র প্রবীণ নিবাসে কথা হয় শোভা রানী দে’র সাথে। তাঁর বয়স এখন ৭০। তিনি এখানে এসেছেন প্রায় ৫ বছর। তাঁর দুই ছেলের মধ্য এক ছেলে থাকেন ওমানে। সেখানে চাকুরি করে উপার্জন করলেও কোনো দিন খবর নেননি মায়ের। তবে ছোট ছেলে স্বপন দে একটি চায়ের দোকানে কাজ করলেও মা কে সুযোগ পেলে দেখতে আসে। ৫ মেয়ে থাকলেও দেখতে আসেন খুবই কম।
কাঞ্চনা কর্মকার, বয়স এখন ৭০। ১ ছেলে ও ৩ মেয়ে। স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে-মেয়েদের কেউই এখন আর কাঞ্চনা কর্মকারের খবর রাখে না। ৭০ বছরের নজরুল ইসলামের বাড়ি রাঙ্গুনীয়া উপজেলার মরিয়ম নগরে। দুই ছেলে ১ মেয়ের সবাই স্বচ্ছল। আরিফুল ইসলাম আরজু নামের এক ছেলে ব্যবসা করেন আবুধাবীতে। মিজানুল ইসলাম দেশে থাকলেও নজরুল ইসলামকে থাকতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। একই আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা পেয়ার মোহাম্মদের দুই ছেলে বিদেশে থাকলেও খোঁজ নেন না বাবার।
বৃদ্ধাশ্রমে থাকা ফেনীর সোনাপুর গ্রামের বাসিন্ধা পেয়ার আহমদের বয়স এখন ৭৪। এখানে কেন থাকেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জীবনের সব টাকা-পয়সা ও জায়গা-জমি ক্রয় করেছেন স্ত্রীর নামে। ৭ বছর আগে প্রায় ৪ কোটি টাকার সম্পত্তি নিয়ে তাঁকে তালাক দিয়ে চলে যায় স্ত্রী। ছেলে মো. সেলিম ও শাহ আলম আবুধাবীতে থাকলেও খোঁজ-খবর রাখে না।
নগরীর বিপনী বিতানের একসময়ের নামকরা টেইলর মাস্টার দুলাল দাশের বয়স ৮৫। পড়ন্ত এই সময়ে বৃদ্ধাশ্রমে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করতেই চোখের কোণে জ্বলের কণা জমাট বাঁধে। ভাঙা গলায় তিনি জানান, স্ত্রী মারা গেছেন বেশ ক’বছর হলো। ১ ছেলে ৪ মেয়ে আছে। ছেলে তাপস দাশ রাঙামাটির একটি কোম্পানীতে চাকুরি করে। তেমন যোগাযোগ নেই। তবে অন্য সন্তানেরা যোগাযোগ রেখেছে।
৮০ বছরের তপন দাশের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারায়। তাঁকে দেখতে এসেছেন নগরীর পাহাড়তলীর দিলিপ দাশের স্ত্রী মনিষা দাশ। স্বামী-স্ত্রীর কাছে জানতে চাই তপন দাশ বৃদ্ধাশ্রমে কেন- প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তপন দাশ আমার দুরসম্পর্কের দাদা হন। এখানে একটি কাজে প্রায়শ আমাকে আসতে হয়। এই ফাঁকে দাদাকেও দেখে যাই।
এখানে থাকা নগরীর খুলশীর বাহার উল্লাহ (৬৫), কুমিল্লার শিতচাইলের মুবিনুল হক (৭০), রাউজানের সিকদারটেকের নুরুল আমিন (৯৬), তপন দাশ, নোয়াপাড়ার প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জাহাঙ্গীর আলম (৪৫), বোয়ালখালীর কদুরখীল এলাকার মো. শফি (৬৫), রাঙামাটির যতীন্দ্র ত্রিপুরা (৮০), আনোয়ারার মেনু দাশ, খাগরাছড়ির হুগিলা পুজি চাকমা (৮০), রেনু লতা চাকমা (৮১), কুমিল্লার নাছিমা আকতার (৬২) এর জীবন গল্পও অন্যদের মতোই- পরিবারে জায়গা হয়নি তাঁদের।
রাউজানের নোয়াপাড়ায় ২০১৪ সালের ১ মে চালু হয় আমেনা-বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রটি। স্থানীয় শিল্পপতি বেসরকারি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ভাইস-চেয়ারম্যান সামশুল আলম অসহায় বৃদ্ধ নারী-পুরুষদের বেঁচে থাকার অবলম্বন করে দিতে সুদৃশ্য বৃদ্ধাশ্রমটি নির্মাণ করেন। বর্তমানে এ বৃদ্ধাশ্রমে রয়েছেন ১৭ জন। এর মধ্যে ১১ জন পুরুষ, ৬ জন নারী। এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন ডা. সালাউদ্দিন মুরাদ। ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন মো. ফারুক। আর আশ্রিতদের প্রয়োজনীয় দেখভাল করেন মানু দে, সনজিত দে, প্রদীপ দে, লুৎফুর রহমান, লুৎফা আকতার।
এখানকার ব্যবস্থাপক মো. ফারুক জানান, এখানে থাকা বয়স্কদের মধ্যে এ পর্যন্ত ২০-২৫ জন মারা গেছেন। আমিও এখন বয়স্কদের দলে। তাদের সেবা করে যাচ্ছি, ভালো লাগছে। সেবার মানসিকতা নিয়ে কাজ করে যেতে চাই।
রাউজান উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা মনির হোসেন জানান, তাঁদের কাছ থেকে নিবন্ধন নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে আমেনা বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র। বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া হয় না।