বিশ্রামের আড়ালে চলছে ‘চাঁদাবাজি’

255

সড়কে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশ চাঁদাবাজি করছে। এমন দৃশ্য এখন আর দেখা যায় না। তবে বন্ধও হয়নি। শুধু পরিবর্তন এসেছে কৌশলের। কেননা মোড়ে মোড়ে রয়েছে রঙিন কাচে ঘেরা নিরাপদ ট্রাফিক পুলিশ বক্স। পুলিশদের বিশ্রামের নামে ফুটপাত দখল করে এসব বসানো হলেও কার্যত নিরাপদে চাঁদাবাজি চলে এই পুলিশ বক্সে। গাড়ি আটকিয়ে চালককে ঢুকানো হয় বক্সে, তারপর লেনদেন সেরে হাসিমুখে ফিরছেন দুইপক্ষই। কেননা বক্সের ভিতর নেই কোন সিসি ক্যামেরার ঝামেলা।
অন্যদিকে দিনে নগরীতে ট্রাক-লরি প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। অথচ অবাক করার মত হলেও সত্য যে, আবার তারাই দিচ্ছে দিনে ট্রাক-লরি চষে বেড়ানোর ‘বিশেষ মামলার স্লিপ’। বিনিময় মাসিক ১ হাজার টাকা। প্রশ্ন উঠছে, নিষেধাজ্ঞা কি নগরীতে যানজট কমানোর জন্য, নাকি অবৈধভাবে চাঁদা আদায়ের জন্য?
গত রবিবার দুপুর ২টা ৩২ মিনিট। বায়েজিদের পাশ থেকে ২নং গেট মোড়ে একই সাথে মালবাহী দুইটি ট্রাক আসে। গাড়ি দুইটি আটকালেন এক ব্যক্তি। তবে তিনি পুলিশ নন। মোল্লা কবির নামে এ ব্যক্তির মুখে দাঁড়ি আর পরনে সাদা টি-শার্ট। গাড়ি দুইটি থামিয়ে চালকের পাশে বসা দুই সহকারীকে নিয়ে পুলিশ বক্সে ঢুকলেন মোল্লা কবির। মিনিট পাঁচেক পর আবার বের হলেন। পাশের দোকান থেকে ‘এক প্যাকেট সিগারেট’ কিনলেন এবং দর কষাকষির পর আবারো পুলিশ বক্সে ঢুকলেন কবিরসহ ওই দুইজন। লেনদেন সেরে হাসিমুখে বেরিয়ে গেলেন দুই ট্রাকের দুই সহকারী। সাথে সাথে গাড়িও চালিয়ে গেলেন। তারই কিছুক্ষণ পর ২টা ৪৩ মিনিটে দুই নম্বর গেটে আসল আরও একটি ট্রাক। যথারীতি চালককে মোল্লা কবির নিয়ে গেলেন পুলিশ বক্সে। চালক সালাম বের হলেন প্রায় ৬ মিনিট পর।
পুলিশ বক্সে কি হয়েছিল? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি পূর্বদেশকে জানান, আমার গাড়ির রেজিস্ট্রেশন কার্ডের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এছাড়া গাড়িতে এক্সট্রা রেলিং লাগানো রয়েছে। যার কারণে ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি ধরে মামলা দেয়। তাই মাসিক টোকেন নিয়েছি ১ হাজার টাকা দিয়ে। যাতে আর কোন ঝামেলা পোহাতে না হয়। তার হাতে থাকা মামলার স্লিপে দেখা যায়, জরিমানার মোট পরিমান ২শ টাকা। এছাড়া ঘটনার তারিখ ও নিষ্পত্তির তারিখ মুছে দেওয়া হয়েছে। তবে হাতে লেখে নিষ্পত্তির তারিখ দেওয়া হয়েছে ২৫ জুলাই।
চালক আরও জানান, এই স্লিপ থাকলে আর কোন পুলিশ গাড়িতে মামলা দিবে না। ধরলেই ছেড়ে দিবে। প্রতি মাসেই এভাবেই ‘বিশেষ মামলার স্লিপ’ নিয়ে গাড়ি চালান তিনি। ওই সময়ে গ্রাহক সেজে কথা হয় পুলিশের সোর্স মোল্লা কবিরের সাথে। সে নির্ভয় দিয়ে ‘স্যারের’ সাথে কথা বলার আহবান জানান। এমন কি এক পর্যায়ে প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন, আমাদের মাসুম উল্লাহ স্যার হলেন অনেক সিনিয়র। কিছুদিন পরেই টিআই হয়ে যাবে। তার থেকে টোকেন নিলে পুরো শহরজুড়ে গাড়ি চালাতে পারবেন।
অন্যদিকে ২নং গেট থেকে অক্সিজেন মোড় পর্যন্ত হিউম্যান হলার চলাচল করে। এই লাইনে প্রায় ৪শ গাড়ি রয়েছে। প্রতিটি গাড়ি থেকে দৈনিক ১শ ৭০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। এই টাকাগুলো লাইনম্যান ও টিআইয়ের মধ্যে ভাগ ভাটোয়ারা হয় বলে জানান সাইফুদ্দিন নামের এক চালক।
এছাড়া ওই মোড় থেকে চকবাজার পর্যন্ত টেম্পু। যেখানে প্রায় দেড়শ গাড়ি রয়েছে। এই লাইনে টেম্পু চালকদের প্রতিদিন ১শ টাকা এবং মাসিক ১২শ টাকা দিতে হয়। প্রদীপ নামের এক শ্রমিক নেতা এই টাকা নেন বলে জানান চালকরা। তবে ওই টিআইকে ম্যানেজ করতে এই চাঁদা নেন বলেনও জানান তারা।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, সকাল ৮টা থেকে রাত ৮ পর্যন্ত কোন ট্রাক-লরি মেট্রো এলাকায় ঢুকতে পারবে না। তবে বিজিএমই ও বিকেএমই’র প্রায় দুইশ গাড়ির অনুমোদন রয়েছে। তবে এসব গাড়ি নগরীতে প্রতিদিন প্রবেশ করে যানজট সৃষ্টি করছে। এমনকি ২নং গেট এলাকায় দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা অবধি যানজটের অন্যতম কারণ এসব ট্রাক-লরির অবৈধ প্রবেশ। প্রায় প্রতিটি টিআইয়ের বিশেষ টোকেনে চলে এসব ট্রাক-লরি। প্রতিমাসে ১ হাজার বিনিময়ে তাদের ‘বিশেষ মামলার স্লিপ’। ফলে নিষেধাজ্ঞা আমান্য করে দিন-দুপুরে শহরে চষে বেড়ায় এসব ট্রাক, ক্যাভার্ড ভ্যান ও লরি। তবে বন্দর এলাকায় দায়িত্বরত টিআইদের টোকেনে বেশি গাড়ি চলে বলে জানা গেছে। এছাড়া বছরের পর বছর চট্টগ্রামেই দায়িত্ব পালন করছেন অনেক টিআই। ফলে তারা অবৈধ আয়ের ব্যাপক ‘নেটওয়ার্ক ’ বিস্তার করেছে পুরো শহরজুড়ে।
গতকাল দুপুর ১টা ৩৩ মিনিট। চকবাজার মোড়ে যানজট সামলাতে ব্যস্ত ট্রাফিক কনস্টেবলরা। ঠিক ওই সময় ফুটপাতের উপর নির্মিত পুলিশ বক্সে খোশ-গল্পে ব্যস্ত সার্জেন্ট আরাফাত। তবে কিছুক্ষণ পরই হাজির হলেন একজন প্রাইভেট সিএনজি অটো রিকশার চালক। তিনি আসলেন, পুলিশ বক্সে ঢুকলেন আর টাকা দিয়ে মামলার স্লিপ নিয়ে চলে গেলেন। তার সাথে কথা বলতে চাইলে কোন জবাব না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে গেলেন তিনি।
এর খানিক পরেই আসলেন আরেক চালক। তিনিও একইভাবে টাকা দিয়ে মামলার স্লিপ নিয়ে বের হলেন। তার সাথে কথা হলে তিনি জানান, তার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই এবং মিটারে গাড়ি না চালানোর সময় যাতে পুলিশ মামলা না দেয়, তাই প্রতিমাসেই সার্জেন্ট আরাফাত থেকে ১ হাজার টাকা দিয়ে মামলার স্লিপ নেন এই চালক। তবে এই বিষয়ে সার্জেন্ট আরাফাত থেকে জানতে চাইলে তিনি বরাবরই অস্বীকার করেন।
সিটি কর্পোরেশনের ফুটপাত দখল করে এসব পুলিশ বক্স নির্মাণের কারণে পথচারীদের পথচলা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে পুলিশের এমন দখলদারী ভূমিকায় উৎসাহী হচ্ছেন হকার-ভ্রাম্যমাণ দোকানদাররা।
এই বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী মো. সামসুদ্দোহা বলেন, ফুটপাত কেউ দখল করতে পারবে না। তাছাড়া ট্রাফিক বিভাগ কোন ধরনের আলোচনা-অনুমতি ছাড়া বক্সগুলো বসিয়েছে। এই বিষয়ে তাদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেন এই কর্মকর্তা।
অন্যদিকে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও লরি চলাচলের বিষয়টি স্বীকার করলেও চাঁদাবাজির বিষয়টি অস্বীকার করেন সিএমপির উপ পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক-উত্তর) হারুণ অর রশীদ হাযারী।
তিনি পূর্বদেশকে বলেন, কিছু গাড়ি ফাঁকি দিয়ে শহরে প্রবেশ করে। এই নিয়ে আমরা সতর্ক রয়েছি। এই ব্যাপারে আরও কঠোর অবস্থানে যাওয়ার কথা বলেন তিনি।