বিশ্ব সবার প্রয়োজন মেঠানোর সামর্থ রাখে, তবে লালসা মেঠানোর নয়

51

বিশ্বের একটি বিরাট অঞ্চলব্যাপী আজ বিভাজন, বিদ্বেষ, ঘৃণা, কপটতা ও অনিশ্চয়তায় ভরে গেছে। এর মধ্যেও যে বিশ্বের কিছু অঞ্চলে শান্তির বাতাস বইছেনা তা নয় কিন্তু তা একে বারেই নগণ্য। বিশ্বের বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্থা বিশেষ করে বিশ্ব-ব্যাংকের হিসাব মতে বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যার সমান লোক এই অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং বিশ্বের তিন চতুর্থাংশ শিশু এই অঞ্চলে তীব্র পুষ্টিহীনতায় তিলে তিলে ভুগছে। বিশ্ব ব্যাংক সহ অন্যান্য বিশ্ব সংস্থার নিরীক্ষা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৫০ থেকে ৬৪ শতাংশ মানুষ ঐসব যুদ্ধ ও হিং¯্রতাপূর্ণ অঞ্চলে বাধ্য হয়ে বাস করতে হবে। জাতিসংঘের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী যুদ্ধ ও সংঘর্ষ প্রায় ৬০ শতাংশ এবং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ প্রায় ১২৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। যুদ্ধ, সংঘর্ষ এবং অত্যাচারিত হওয়ার কারণে প্রতি মিনিটে প্রায় ২৫ জন লোক নিজের দেশ থেকে পালাতে হচ্ছে। এসব বাস্তু হারা লোক বাধ্য হয়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিতে হচ্ছে এবং ঔসব দেশে স্বাভাবিকভাবে বাস্তুহারা লোক বাধ্য হয়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিতে হচ্ছে এবং ঐসব দেশে অস্থায়ীভাবে নির্মিত আশ্রয় ক্যাম্পের মধ্যে তারা অর্ধাহারে, অনাহারে এবং অনেকেই অর্ধবস্ত্রহীন অবস্থায় দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। একটি দেশে বাস্তুহারা হিসাবে আসার পর, সে দেশে স্বাভাবিকভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য কর্মকান্ডে তাদের কোন অংশগ্রহণ ও থাকেনা। ফলে তাদের মধ্যে স্বাভাবিক মানবিক গুণাবলী লোপ পেতে থাকে এবং ধীরে ধীরে অকমর্ণ্য হয়ে পড়ে।
বর্তমানে বিশ্বের সর্বমোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ লোক চরম দারিদ্রের মধ্যে জীবন যাপন করছে। এর মধ্যে ৪১৩ মিলিয়ন লোক বাস করে সাব-সাহারণ আফ্রিকায়, মধ্য প্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায় রয়েছে ১৮.৬ মিলিয়ন। বিশ্বের বাকী অংশে ৭৩৬ মিলিয়ন লোক আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করে। তারা প্রতিদিন মাথাপিছু ১.৯০ ডলারের বেশি কোন অবস্থাতেই খরচ করার ক্ষমতা রাখেনা। কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন দেশ উন্নয়নের লক্ষ্য হিসাবে দারিদ্রতা দূর করা গ্রহণ করে কাজ শুরু করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় বিশ্বের চারিদিকে যুদ্ধের দামামা, ইতিমধ্যে বিশ্বের বেশ কিছু দেশ অস্ত্রের মজুদ বাড়ানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। ফলে লক্ষ লক্ষ লোক নতুনভাবে দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাচ্ছে। একটি দেশ যখন যুদ্ধ-বিগ্রহের মুখোমুখি হয় তখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের কর্মসূচিগুলি থেমে যায়। বরং যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জাতীয় উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, মওজুদ সম্পদের ধ্বংস সাধন, অর্থনৈতিক অবকাঠামোগুলির ধ্বংস সাধন ইত্যাদি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রায় অসম্ভব। গত দশকে যেসব দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরে এসেছে, দেখা গেছে সেসব দেশের জি.ডি.পি প্রায় ৭ গুণ বেড়েছে। শ্রীলংকার কথা ধরা যাক, শ্রীলংকায় প্রায় ২৬ বৎসর পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ চলেছে যা ২০০৯ সালে সমাপ্ত হয়েছিল। গৃহযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার মাত্র ১০ বৎসরের মধ্যে শ্রীলংকার দারিদ্রতা ১৫.২ শতাংশ থেকে এই সময়ে ৭.৬ শতাংম নেমে এসেছে এবং মাথাপিছু আয় প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ এবং ভারতে কয়েকদশক ধরে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করাতে, দারিদ্রতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। ২০০০ সালে থেকে ২০১৬ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৮ মিলিয়নের মতো মানুষ দারিদ্র্য সীমা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে এবং ২০০৫ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ে ভারতে প্রায় ২৭১ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্য সীমা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। অবশ্য শুধু যুদ্ধ বা সশস্ত্র সংঘর্ষ দারিদ্রতার কারণ নয়। দেশের প্রতি স্তরে দুর্নীতি, আয় বৈষম্য, অসাধু ব্যবসার রমরমা অবস্থাও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় বাধা হিসাবে দাঁড়াতে পারে। বন্টন বৈষম্য দেশে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও মারাত্মকভাবে একটি দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করাতে পারে। আবার প্রতিদেশেই অশান্তির মূল কারণ অথনৈতিক। সম্প্রতি সুদান, হংকং, আলজেরিয়া, মিশর, ইরাক, চিলি এবং লেবাননে সে ভয়াবহ অশান্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। সর্বক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক কারণই প্রদান ভূমিকায় রয়েছে। সব সংগ্রামের মূল প্রতিপাদ্য হলো শাসক শ্রেণীকে বিদায় দিয়ে স্বচ্ছ ও দুনীর্তিমুক্ত শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা।
‘শান্তির’ অর্থ শুধু যুদ্ধ পরিহার করা নয়, সাথে সাথে অভ্যন্তরীণ অবিচার ও অত্যাচার বন্ধ করতে হবে। এক দেশের সাথে অন্য দেশের যুদ্ধ বন্ধ করার চাইতে দেশের অভ্যন্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আজকে বিশ্বের বহুদেশে দেশেরই সরকার কর্তৃক যেভাবে মানুষ দেশের অভ্যন্তরে নিপীড়িত হচ্ছে তার ভয়াবহতা দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের ভয়াবহতার চাইতে কম নয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় বিশ্বের বহুদেশে সরকার দেশের মানুষের সেবার চাইতে অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলার নামে সংশ্লিষ্ট দেশের মানুষের উপর অত্যাচার অবিচারের স্টিমরোলার চালাচ্ছে।
ইতিমধ্যে জাতিসংঘের ‘খাদ্য এবং কৃষি সংস্থা’ ঋঅঙ একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে তা হলো বিশ্ব ইতিমধ্যে যে খাদ্য উৎপাদন করছে তা বিশ্বের বর্তমান জনসংখ্যার দেড়গুণ মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারে। তার অর্থ দাঁড়ায়, বর্তমানে সারা বিশ্বে যে খাদ্য উৎপাদন হয় তা দিয়ে ১০ বিলিয়ন বা ১০০০ কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটানো সম্ভব। অথচ ২০৫০ সালের আগে বিশ্বে ১০ বিলিয়ন জনসংখ্যা হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। বিশ্বে বর্তমানে ৭.৫ বিলিয়ন বা ৭৫০ কোটি মানুষ হিসাব করলেও বাকী ২.৫ বিলিয়ন বা ২৫০ কোটি মানুষ অনাহারে কেন? মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন- ঞযব ড়িৎষফ যধং বহড়ঁময ভড়ৎ বাবৎু ড়হব’ং হববফ, নঁঃ হড়ঃ বহড়ঁময ভড়ৎ বাবৎু ড়হব’ং মৎববফ.’ অর্থাৎ ‘বিশ্বে প্রত্যেকটা মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট রয়েছে কিন্তু লোভ মেটানোর মত যথেষ্ট নেই।’ একটি সুশৃঙ্খল দেশ গড়ে তুলতে সবচাইতে বেশি প্রয়োজন ক) সু-শাসন, খ) আইনের শাসন, গ) গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা। অথচ বর্তমানে বিশ্বে এসবের ভীষণ অভাব রয়েছে। উপরোক্ত মূল্যবোধগুলি সারা বিশ্বে দ্রæত সংকোচিত হয়ে যাচ্ছে। আগে রাষ্ট্রে পরিচালনায় যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলি লালনের দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপর ছিল তা এখন কার দায়িত্বে তা বলা যাবে না। শাসকগোষ্ঠী যখন ভীষণ শক্তিশালী হয়ে যায় তখন তাঁদের প্রথম কাজ হয় জবাবদিহিতা নিবারণ, স্বাধীন সংবাদ মাধমে হস্তক্ষেপ এবং সরকারের জবাবদিহিতা শূন্যের কোটায় পৌঁছানোর অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা। একাজগুলি কোন রকমে শেষ করতে পারলেই রাষ্ট্রের সম্পদ এবং ক্ষমসীনদের সম্পদে আর কোন পার্থক্য থাকেনা। তখন অবস্থা দাঁড়ায়, ‘রাষ্ট্রের সম্পদ আমার সম্পদ, আমার সম্পদও আমার সম্পদ।’ সে অবস্থায় রাষ্ট্রীয় শাসন যখন পৌঁছে যায় তখন ভয়ানক অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। সরকারের মদদপুষ্ট একটি শ্রেণীর কাছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ জমা হতে থাকে। তখন থেকে ধনীদের সম্পদ বাড়তে থাকে এবং দরিদ্রের বাড়তে থাকে দারিদ্রতা। একটি সময় আসে যখন নিষ্পেষিত, বঞ্চিত এবং দরিদ্ররা রাস্তায় নেমে পড়ে আন্দোলনে আয়-বৈষম্যের বিরুদ্ধে। বর্তমানে বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গবেষণা সংস্থা ‘অক্সফেমের’ রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে পৃথিবীর নিম্ন আয়ের অর্ধেক লোকের কাছে যা সম্পদ আছে সে পরিমাণ অর্থ বর্তমানে বিশ্বে মাত্র ২৬ জনের কাছে রয়েছে। বিশ্বের ধনকুবেরদের কাছে প্রত্যেক দিন ২.৫ বিলিয়ন ডলার করে জমা হচ্ছে। বাংলাদেশের মুদ্রায় ইহার পরিমাণ দাঁড়ায় ২১৫০০ কোটি টাকা। কেহ যদি মনে করে ইহা বিশ্ব অর্থনীতির উন্নয়ন তাহলে তারা বোকার স্বর্গেই বাস করে, বরং ইহা বিশ্বের ধ্বংসই অচিরেই ডেকে আনবে।
লেখক : কলামিস্ট