বিশ্ব শিক্ষক দিবস ও শিক্ষকদের প্রত্যাশা

15

কৃষ্ণ শেখর দত্ত

বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষকদের স্মরণ ও সম্মানার্থে আন্তর্জাতিকভাবে পালিত একটি দিবস। ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর ২৬ তম অধিবেশনে ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর তা পালন করা হয়। মূলত শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানকে স্বীকৃতি দিতে ইউনেস্কো বিশ্ব শিক্ষক দিবস চালু করেছে। ১৯৬৬ সালে প্যারিসে শিক্ষকদের মর্যাদা সংক্রান্ত আন্তঃসরকার সম্মেলনে ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা শিক্ষকদের অধিকার, দায়িত্ব এবং মর্যাদা সম্পর্কে একটি যৌথ সুপারিশমালা প্রণয়ন করে। উক্ত সুপারিশমালায় শিক্ষকতা পেশাকে সম্মানজনক অবস্থানে নেওয়া সহ শিক্ষক প্রশিক্ষণ, নিয়োগ ও পদোন্নতি, দায়িত্ব ও অধিকার, চাকরির নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা বিধানের প্রক্রিয়া, পেশাগত স্বাধীনতা, কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন, শিক্ষা সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ, কার্যকর শিক্ষাদান ও শিখনের পরিবেশ এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের উপর গুরুত্ব দিয়ে আসছিল। তারই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে প্রণীত দলিলটি বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর ২৬ তম অধিবেশনের সিদ্ধান্তের আলোকে তৎকালীন ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ড. ফ্রেডারিক এম মেয়রের ঘোষণার মাধ্যমে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের শুভ সূচনা হয়।
প্রথমবারের মত এই বছর বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শিক্ষক সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বিটিএ) এর পক্ষ থেকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। আজকের এই দিনে আমি সর্বপ্রথম বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি আমার প্রাথমিক শিক্ষা হতে সর্বোচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত যাঁদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছি সকল শিক্ষাগুরুসহ বিশে^র সকল শিক্ষককে। সমাজ বিনির্মাণে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষক একজন শিক্ষার্থীকে শুধুমাত্র পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন না। তিনি শিক্ষার্থীকে আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। তিনি শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভাকে প্রষ্ফুটিত করে জীবনে স্ব স্ব অবস্থানে যাতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালান। শিক্ষক সামাজিক বিভিন্ন কুসংস্কার পরিহার করে আধুনিক সমাজ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তিনি প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মধ্যে আদর্শ ও সততার বীজ বপন করে সুনাগরিক তৈরি করতে পারেন। আজকের এই দিনে স্মরণ করতে চাই আমাদের পূর্বসুরীদের যাঁরা মহান ব্রতে থেকে আমাদেরকে শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। তাঁদের দেখানো পথ অনুসরণ করে আমরা জাতি গড়ার কারিগররা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্মার্ট নাগরিক হিসেবে তৈরি করব।
এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘The teacher’s we need for the education we want’ অর্থাৎ আমাদের তেমন শিক্ষক প্রয়োজন যেমন শিক্ষা আমরা চাই। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ব্যবস্থা অনুযায়ী আমাদেরকে শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখতে হবে। টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে যোগ্য নাগরিক সৃষ্টি করতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থার রাষ্ট্রীয় চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার বিস্তরণ ঘটাতে হবে। আর এই শিক্ষা বিস্তরণের মূল কারিগর হলো শিক্ষক। শিক্ষা যদি মানুষের মৌলিক ও জন্মগত অধিকার হয় তবে রাষ্ট্রকে সর্বাগ্রে মানসম্মত শিক্ষা বিস্তরণের মূল দায়িত্ব পালন করতে হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা অনুধাবন করতে পেরে য্দ্ধুবিধ্বস্ত রাষ্ট্রকে ঢেলে সাজাতে ১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে ২৬ হাজার রেজিষ্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন করলেও তা বাস্তবায়নে আলোর মুখ না দেখায় মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ সুবিধার মধ্যে পাহাড়সম বৈষম্য বিদ্যমান। অথচ একই কারিকুলাম একই সিলেবাস ও একই সময়সূচী অনুসরণ করে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়। যে দেশে ৯৪% শিক্ষার্থী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করে সে দেশে ৯৪% শিক্ষককে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে মানসম্মত শিক্ষার বাস্তবায়ন কতটুকু যৌক্তিক? ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রুপান্তরের মূল কারিগর শিক্ষক।
আমরা সাড়ে পাঁচ লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারী ১১ জুলাই হতে ৩১ জুলাই ২০২৩ পর্যন্ত জাতীয় প্রেসক্লাবে অবস্থান ধর্মঘট ও ১ আগস্ট হতে আমরণ অনশনরত অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী মহোদয়ের প্রতিনিধি দলের কাছে দাবি পূরণের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে প্রতিনিধিগণ অনশন ভঙ্গ করে আমাদেরকে শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে দেন। শিক্ষক সমাজ অধীর আগ্রহে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষায় আছি আগামী ৫ অক্টোবর ২০২৩ আমাদের আশা ভরসার একমাত্র আশ্রয়স্থল জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা, মানবতার মা, শিক্ষক দরদী, শিক্ষা বান্ধব সরকারের প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়ে উন্নত, স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে একধাপ এগিয়ে যাবেন।

লেখক : প্রধান শিক্ষক- সানোয়ারা উচ্চ বিদ্যালয় ও দপ্তর সম্পাদক (বিটিএ), চট্টগ্রাম অঞ্চল