বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ঝুঁকিতে কিশোরী স্বাস্থ্যসেবা

93

১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস আজ। বরাবরের মতো এ দিবসের ম‚ল উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা, জেন্ডার সচেতনতা তৈরি করা, নারী পুরুষের সম অধিকার সম্পর্কে অবহিত করা, প্রজননতন্ত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদান, অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান ধারন সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি ও নিরাপদ যৌন স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে যৌনবাহিত মরণব্যাধি হতে রক্ষা পাওয়া। প্রতিবছর বিভিন্ন থিম নিয়ে বিশ্বজনসংখ্যা দিবস উদযাপিত হয়। কিন্তু ম‚ল উদ্দেশ্য থাকে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে ছোট পরিবার গঠন করা।
ইউএনএফপিএ-র দেয়া তথ্য মতে, বর্তমান পৃথিবীর জনসংখ্যা ৭৭১৫ মিলিয়ন। এর মধ্যে ১০ থেকে ২৪ বছরের জনসংখ্যা ২৬%, ০ থেকে ১৪ বছরের জনসংখ্যা ২৬%, ১৫ থেকে ৬৪ বছরের জনসংখ্যা ৬৫% এবং ৬৫+ জনসংখ্যা ৯%। মোট জনসংখ্যার মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণকারীর হার ৬৩%, সক্রিয় ব্যবহারকারীর হার ৫৮%, অপ‚রণীয় চাহিদা ১২% এবং টিএফআর ২.৫। উপরোক্ত জনসংখ্যার চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে এখনও বহু সক্ষম দম্পতি পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির আওতা বহির্ভ‚ত, নির্ভরশীল জনসংখ্যার আধিক্য রয়েছে এবং বয়স্ক মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি যদিও এখনও একটি বড় সমস্যা কিন্তু এটি সকল প্রান্তে একই রকম নয়। অনেক দেশ আছে যেখানে জনসংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে, যেমন জাপান, জার্মানী, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স ইত্যাদি। আবার প্রাচ্যের এই অংশ যেমন চীন, ভারত,পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ জনসংখ্যার ভারে ভারাক্রান্ত। এসব দেশে মানুষের মৌলিক অধিকার বিশেষ করে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার দারুণ অভাব রয়েছে। যদিও চীন পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে তার জনসংখ্যা বিষয়ক নীতিকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
গোটা পৃথিবীর সম্মুখে এখন কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কিশোরী মাতৃত্বসেবা, শিশুমৃত্যুরোধ ও দারিদ্রদ‚রীকরণ। এই মুহ‚র্তে গভীর উদ্বেগের বিষয় এই যে ১.৮ বিলিয়ন যুবক যুবতি প্রজননক্ষম বয়সে প্রবেশ করছে।বর্তমান বিশ্বের ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ১৫ মিলিয়ন কিশোরী সন্তান প্রসব করে এবং ৪ মিলিয়ন অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের কারণে এবরশন করে থাকে। এবং প্রতিদিন ৮০০ জন মা সন্তান জন্মদানকালে মৃত্যুবরণ করে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, শিশুমৃত্যু একটু সচেতনতার মাধ্যমে প্রতিহত করা সম্ভব।
পৃথিবী যখন কিশোরী মাতৃত্ব স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে উদ্বিগ্ন তখন বাংলাদেশের এক শ্রেণির কিশোর কিশোরী চলছে উল্টো পথে। তারা আধুনিকতার নামে স্বাস্থ্য হানিকর বিভিন্ন অভ্যাসের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তারা ধ‚মপান, মদ্যপানসহ বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনের দিকে আসক্ত হচ্ছে।তাদের এই আসক্তি যৌন অক্ষমতাসহ মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে। ইতিমধ্যে বিবিএস কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপে ভেজাল খাদ্য ও নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনের ফলে শহরের ৩০% যুবক যুবতিরা সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়ে পড়ছে।
সা¤প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশ ধ‚মপান – তামাক সেবনের দিক থেকে প্রথম শীর্ষ অবস্থানকারী দেশ হিসেবে রেকর্ড অর্জন করেছে। বাংলাদেশে আইটিসি কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপে ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সালে দেখা গেছে এই তিন বছরে তামাক জাতীয় দ্রব্য গ্রহণের হার ৪২.৪% থেকে ৩৬.৩% এবং সরাসরি তামাক জাতীয় দ্রব্য সেবন এই সময়ের মধ্যে কমে আসলেও যুবক যুবতিদের মধ্যে ধ‚মপানের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এবং সরাসরি ধ‚মপানের এই হার ৭.২% থেকে ১০.৬% উন্নীত হয়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে তামাকজাত দ্রব্য সেবনের এই রেকর্ড অনেক বেশি।
এছাড়াও বর্তমানে ধ‚মপান জনিত বিভিন্ন রোগব্যাধিতে বছরে প্রায় ৫৭০০০ লোক অকাল মৃত্যুর শিকার হয়। এর পরও ধ‚মপানকারীর সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। সংখ্যাগত দিক থেকে যা কিছুই হোকনা কেন আধুনিক যুবক যুবতিদের মধ্যে ধ‚মপানকারীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের মধ্যে ফ্যাশনের নামে ধ‚মপানের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামাজিক চাপ থাকায় এসব ছেলেমেয়েরা প্রকাশ্যে ধ‚মপান করতে না পারলেও বিভিন্ন ফাস্টফুডের দোকান, কোচিং সেন্টার, রেস্টুরেন্টে একত্র হয়ে সংঘবদ্ধভাবে ধ‚মপান করছে। এভাবে তারা সাময়িক আনন্দ পেলেও ধ‚মপানের ফলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। ধ‚মপানে আসক্ত এসব কিশোর কিশোরীরা তাদের নেশা সহজে ছাড়তে পারেনা। যার ফলে পরবর্তী জীবনে বিয়ের পর যখন মেয়েরা গর্ভবতী হয় তখনও তার মধ্যে নেশাটি বিদ্যমান থাকে। গর্ভাবস্থায় ধ‚মপানের ফলে তার গর্ভের শিশু নষ্ট কিংবা বিকলাঙ্গ হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে তার মধ্যে এক্লাম্পশিয়া দেখা দিতে পারে। এছাড়া পুরুষেরাও কম ঝুঁকিতে নেই। ধ‚মপানের ফলে তাদের মধ্যে হৃদরোগ, ফুসফুস, কিডনির সমস্যা ছাড়াও যৌন শিথিলতা দেখা দিতে পারে।
এক জরিপে দেখা গেছে ধ‚মপায়ী দম্পতিদের শিশুরা নানাধরনের শ্বাসকষ্টজনিত রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। গর্ভাবস্থা থেকেই এ সমস্যার শুরু। বাংলাদেশে কিশোরী মাতৃত্ব এখনও একটি বড় ঝুঁকি। এখনও ৬৬% কিশোরী ১৯ এর আগেই বিয়ে হয়ে যায় এবং তারা সন্তানের মা হয়। এ ধরনের কিশোরী মায়েরা নানা ধরনের গর্ভজনিত জটিলতার শিকার হয়। তাই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের মধ্য থেকে ধ‚মপান বিরোধী কাউন্সিল গঠন করে সঠিক পরামর্শ দিতে হবে। এটি করতে না পারলে আগামী দিনের ছেলেমেয়েরা হবে এক বিপদাপন্ন জাতি।

লেখক : সহকারী পরিচালক ( পোর্ট ক্লিয়ারেন্স),
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর