বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ছে

147

যাঁরা অর্থনীতির ছাত্র তাঁরা আমার লেখার শিরোনামটি বিশ্বাস করতে চাইবেন না। কিন্তু বাংলাদেশে আমাদেরকে সেরকম একটি অবাস্তব এবং হাস্যকর অর্থনৈতিক অবস্থা সহ্য করে যেতে হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেক বৎসর ধরে ঊর্ধ্বমুখী। এব্যাপারে দেশি এবং বিদেশি অর্থনীতিবিদগণ এবং বিশ্বব্যাংক, আই.এম.এফ. ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি একমত যে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে এগিয়ে চলেছে বহু বৎসর ধরে। কোন দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে অথচ সে দেশের পুঁজি বাজারের সূচক সবসময় নিম্নগতি হবে তা অর্থনীতির সূত্রের সাথে সামঞ্জস্যহীন। কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজি বাজারে মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর ধরে সে অযৌক্তিক অবস্থায় চলছে। ঐদিকে সরকারের মুখপাত্ররা অহ-রহ দেশের জিডিপি’র বৃদ্ধির হিসাব দিয়ে চলছেন। এতে দেশের পুঁজি বাজারের বিনিয়োগকারীরা শুধু পুঁজি বাজারের উপর নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারেও আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। এক সময় দেশের যে পুঁজি বাজার হাজার কোটি টাকার উপরে প্রতিদিনে বিনিয়োগ হয়েছে, সে পুঁজি বাজারের বিনিয়োগ ৩০০-৪০০ কোটি টাকা টাকায় নেমে এসেছে। এখন যদি সরকারের ঘোষিত জিডিপি বৃদ্ধির হিসাবে মানুষ আস্থা হারিয়ে বসে তাতে মানুষের দোষ দেওয়া যায় না। মনে রাখা উচিত সরকারের দেওয়া দেশের অর্থনৈতিক তথ্যে মানুষের আস্থা-সৃষ্টি তাও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি অতীব অপরিহার্য বিষয়। পুঁজি বাজারের সূচকের সাথে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। পুঁজি বাজারের শেয়ারগুলির অনবরত দরপতন হচ্ছে। আর দেশের জিডিপির সব সময় ঊর্ধ্বগতি চলছে তা একটা অর্থনীতির বাস্তব চিত্র হতে পাারে না। সে জন্য দেশের অর্থনীতিবিদ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে অর্থনীতির এই অস্বাভাবিক এবং হাস্যস্পদ অবস্থার সৃষ্টির কারণ এবং তার সামাধান দ্রæত বের করা প্রয়োজন। ২০১৮-২০১৯ অর্থ বৎসরে বাংলাদেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮.১৩ শতাংশ এবং তখন এই প্রবৃদ্ধির হার অহ-রহ সরকার কর্তৃক প্রচারিত হচ্ছিল আর সে একই সময়ে শেয়ার বাজারে আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা প্রায় ১ ট্রিলিয়ন টাকা হারিয়েছিল শেয়ারের দর-পতনের কারণে। অথচ বিশে^র অর্থনীতিবিদরা বলেন একটি দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কে অবগত হতে সে দেশের পুঁজি বাজারের অবস্থা পর্যালোচনা করলেই যথেষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু দুভার্গ্যরে বিষয় বাংলাদেশের পুঁজি বাজারের জন্মলগ্ন থেকে কোন সময়েই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হয় নাই। এই পুঁজি বাজারে দেখা যায় যে, যে শিল্প কারখানাটি কয়েক বৎসর ধরে উৎপাদন বন্ধ তার শেয়ারের দাম হু হু তরে বাড়ছে অথচ একটি ভাল কোম্পানির শেয়ারের দাম কমছে। এই জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্বারা সম্ভব হয়না। যদি কেহ বলেন যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও এই কুকর্মে জড়িত রয়েছে তা কি তার অপরাধ হবে?
এখন আমাদের শেয়ার বাজারের আসল অবস্থাটা কি? কয়েক মাস ধরে এখন আমাদের ব্যাংকগুলিতে তারল্য সংকট চলছে। আমাদের রপ্তানি আয়ও কিছুটা কমেছে। কাজেই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের তুলনায়, আমদানীতে বেশী ব্যয় করতে হচ্ছে। সে জন্য বর্তমানে আমাদেরকে কিছু তারল্য সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আমাদের উপরোল্লিখিত অবস্থাটি শেয়ার বাজারের বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আমাদের থেকেও অনেক বেশি লক্ষ্য রাখছে। কারণ যদি অর্থনীতি সংকটাপন্ন হয় তখন সে দেশের মুদ্রামান কমে যায়, ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বর্তমান অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক পর্যালোচনা করলে বুঝা যায়, সরকার আমাদের মুদ্রামান অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হচ্ছেনা। এই পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা গত দশ মাসে পুঁজিবাজার থেকে যত শেয়ার কিনেছেন তার বহু বেশি শেয়ার বিক্রয় করে দিয়েছেন। ইহার কারণ হলো কোন অর্থনীতির অবস্থা মন্দা হলো সংশ্লিষ্ট মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটে। তথন শেয়ার বাজারের বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থাহীনতায় ভোগে এবং তাদের কাছে গচ্ছিত শেয়ার বিক্রয় করে দেন। গত কয়েকমাস ধরে বাংলাদেশে শেয়ার বাজারে অনুরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সম্ভবত বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভাবছেন বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ মুদ্রার অবমূল্যায়ন হবেনা বলে বার বার আশ^স্ত করলেও কিন্তু তাঁরা ভাবছেন এই পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষে মুদ্রার অবমূল্যায়ন রোধ করা কিছুতেই সম্ভব হবেনা। সে জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীরা গত দশ মাসে যত শেয়ার কিনেছেন তার চাইতে বহু বেশি শেয়ার বিক্রয় করে দিয়েছেন।
ইহা ছাড়াও শেয়ার বাজারের বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হওয়ার অন্যকারণও রয়েছে। তাঁরা মনে করেন বাংলাদেশে অহরহ শেয়ার বাজারের উপ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ইহা স্থিতিশীল না হওয়ার অন্যতম কারণ। গত বৎসরের শেষদিকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিস এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন হঠাৎ করে মিচুয়াল ফান্ড এর সময়সীমা ১০ বৎসর থেকে ২০ বৎসর করে দিয়েছে। যখন বিনিয়োগকারীরা মনে করেছিলেন কয়েক মাসের মধ্যেই লাভ সহ ঐ ফান্ডগুলির বিনিয়োগকৃত অর্থ তাঁরা ফেরৎ পাবেন। এত বড় একটা সিদ্ধান্তে নেওয়ার সময় এমন কি বিনিয়োগকারীদের সাথে কোন পরামর্শ পর্যন্ত করা হয় নাই। এমনকি একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী বি.এস.ইসি. এর এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা দায়ের করেছেন। বিনা অনুমতিতে অন্যজনের বিনিয়োগকৃত পুঁজির সময়সীমা দশ বৎসর বাড়িয়ে দেওয়া শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব। বিএসইসির শুধু একটি সিদ্ধান্তেই হাজার হাজার বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে পুঁজি বাজারে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারীদের পুঁজি বিনিয়োগে চরম অনীহা সৃষ্টি করছে। পরবর্তীকালে আমাদের পুঁজি বাজারে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগে আগ্রহ থাকে কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
এখানে শেষ নহে, গ্রামীণ ফোন এর বকেয়া বিল এর ব্যাপার নিয়ে টেলিকম্যুনিকেশন রিগোলেটরি সংস্থার সহিত যে বিরোধ তা এখনও শেষ হয় নাই। বর্তমান অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনি গ্রামীণ ফোনের সমস্যাটির সমাধান করবেন কিন্ত চারমাস তিন সপ্তাহের পরও সমস্যার কোন সুরাহা হয় নাই। তাতে বিদেশি কোম্পানীটির বুঝতে অসুবিধা হল না যে এদেশে অর্থমন্ত্রী পর্যন্ত প্রতিশ্রæতি রক্ষা করেন না বা রক্ষা করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু তবু শুধু বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির কারণে শেয়ার মার্কেটে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় নাই। আসলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং ব্যক্তিবিনিয়োগকারী উভয়ের আস্থা পুঁজি বাজার থেকে চলে গেছে।
অনেকের মতে দেশের ব্যাংকিংখাতে তারল্যের সংকটই পুঁজি বাজারের বিনিয়োগ কমে যাওয়ার মূল কারণ। বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইহা অতীব সত্য। এমন কি বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানীগুলিও বিভিন্ন উপায়ে পুঁজি বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারণার আশ্রয় নিতে দ্বিধা করছেনা। অনেকেই প্রতি বৎসর পুঁজি বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ট না দিয়ে রিজার্ভ বৃদ্ধি করছে। অনেক কোম্পানীর মালিক নিজেরাই শেয়ার ব্যবসা আরম্ভ করেছে। এই ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী পুঁজি বিনিয়োগ করেও লাভবান হচ্ছেনা।
দেশের ব্যাংকিং খাতের হতদারিদ্র এবং বিশৃঙ্খলা অবস্থাও পুঁজি বাজারের এই পতনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এখনও পুঁজি বাজারে ব্যাংকিং সেক্টেরই অতীব গুরুত্বপূর্ণ খাত। কিন্তু সে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকিং খাতে বিশাল অংকের খেলাপী ঋণের সমস্যা দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে ধ্বংসের সন্নিকটে নিয়ে এসেছে। বর্তমানে সুদের হার ৬% এবং ৯% নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে সমগ্র ব্যাংকিং ব্যবস্থা একটা বড় রকমের চাপের সম্মুখীন হবে। অবশ্য সরকার নিশ্চয় কোন সুচিন্তিত দৃষ্টিকোণ থেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কাজেই এই ব্যাপারে এখন কিছু বলা সমীচীন নয়। কিছুদিন আগে আফ্রিকার কেনিয়াও এইভাবে সুদের হার সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছিল কিন্ত পরে কেনিয়া এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছিল। তবে একথা সত্য দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যতদিন স্থিতিশীলতা আসবেনা ততদিন দেশের শেয়ার মার্কেটও স্থিতিশীলতা আনা প্রায় অসম্ভব হবে।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ব্যাংকগুলিকে ঋণ নিয়ে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার সুযোগ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। অবশ্য শুধু সিটি ব্যাংক ছাড়া এই সুযোগ অন্য কোন ব্যাংক গ্রহণ করে নাই। শেয়ার বাজার যদি চাঙ্গা করতে হয় তাহলে সুপরিচিত এবং সফল কোম্পানীগুলিকে শেয়ার বাজারে আনতে হবে। রাজনৈতিক লবি থেকে শেয়ার বাজারকে মুক্ত রাখতে হবে। শেয়ার বাজারকে জগাখিচুড়ি বাসানো থেকে মুক্ত রাখতে হবে। সব সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অর্থনৈতিক দিকটাই প্রাধান্য পেতে হবে এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ প্রতিক্ষেত্রেই প্রাধান্য পেতে হবে। শেয়ার বাজারের উপর শতভাগ আস্থা সৃষ্টি করতে না পারলে দেশের অর্থনীতির জিডিপি’র সাথে সমান্তরালভাবে যদি পুজি বাজার চলতে অক্ষম হয় সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে জিডিপি’র হিসাবটাই ত্রুটিপূর্ণ। ভারতের জিডিপি সম্পর্কে অনেক আশাপ্রদ খবর শুনা যেত কিন্তু বর্তমানে ভারতের জিডিপি কি প্লাস না মাইনাস সেটা বের করাই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লেখক : কলামিস্ট