বাঁশখালীতে কোটি টাকার কাজ গোপনে ভাগাভাগি!

113

জুন মাস শেষ হচ্ছে। কাজের টাকা ফেরত যাবে। এমন শঙ্কাকে কৌশল বানিয়ে তড়িঘড়ি করেই অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে নয়টি আশ্রয়ণ কেন্দ্র সংস্কার কাজ হাতিয়ে নিয়েছে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। আর এ ঠিকাদারি সিন্ডিকেটকে বাড়তি সুযোগ পাইয়ে দিতে যতসব অনিয়মের নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বয়ং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা। বাঁশখালীতে নয়টি আশ্রয়ণ কেন্দ্র সংস্কারে দরপত্র আহŸানে এমন অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। কাজও পেয়েছেন পিআইও’র পছন্দের ঠিকাদাররা।
গত মে মাসের শেষদিকে অনিয়মে যুক্ত সিন্ডিকেটকে কার্যাদেশও দেয়া হয়েছে। নজিরবিহীনভাবে তিনদিনের মধ্যে দরপত্রের সব কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। এখন নি¤œমানের কাজ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার স্বাক্ষরে বিল ছাড়িয়ে নিতেও তৎপর সিন্ডিকেটটি। বরাদ্দ অনুযায়ী কাজ না করায় এ নিয়ে স্থানীয়রাও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। আশ্রয়ণ কেন্দ্রে দরপত্রে অনিয়ম ও কাজে দুর্নীতির তদন্ত চেয়ে গত ২৩ জুন জেলা প্রশাসক ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বরাবরে অভিযোগও দিয়েছে এলাকাবাসী। অভিযোগে বলা হয়েছে, নিয়মানুযায়ী বহুল প্রচারিত দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে গোপনে দরপত্র আহŸান করা হয়েছে। বিষয়টি গোপন থাকায় ছয়জন ঠিকাদার নিরবে পুরো প্রকল্পের কোটি টাকার কাজ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। যা অন্যকোনো ঠিকাদার জানতো না।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ কামাল হোসেন পূর্বদেশকে বলেন, ‘অভিযোগের কপি আমি এখনো হাতে পাইনি। অভিযোগ যেহেতু দিয়েছে তদন্তে বেরিয়ে আসবে প্রকৃত ঘটনা। প্রতিবেদন আসুক এরপরই প্রকৃতপক্ষে কি হয়েছে জানা যাবে। অনিয়ম পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি নয়টি সাইক্লোন শেল্টার সংস্কার কাজের বিষয়ে কিছুই জানি না। সেগুলো সরাসরি ঢাকার সাথে যোগাযোগ রেখে উপজেলা অফিস করেছে। কি হয়েছে উনারাই ভালো জানবেন।’
প্রকল্পের তথ্য চেয়ে বাঁশখালী প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবুল কালাম মিয়াজীর কার্যালয়ে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। কয়েকদফা ফোন করলেও তিনি তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। গত ২৬ জুন কথা হলে বাঁশখালী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবুল কালাম মিয়াজী পূর্বদেশকে বলেন, ‘কাজ চলমান আছে। কাজের মান কেমন তা ইউএনও দেখবেন। সব কাজের টেন্ডার হয়েছে। কার্যাদেশ কবে দিয়েছি তা মনে নেই। আপনি অফিসে আসেন। বসে কথা বলবো।’
এদিকে কাজের তথ্য জানতে প্রকল্প এলাকায় খোঁজ নিলে নি¤œমানের কাজ করার অভিযোগ করেন কয়েকজন এলাকাবাসী। ছনুয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুল হক চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘তিনটি সাইক্লোন শেল্টারের সংস্কার কাজ শুরু হয়ে প্রায় শেষের পথে। এরমধ্যে ৭নং ওয়ার্ডের ভবনটি একটু ক্ষতিগ্রস্ত। বাকিগুলোতে তুলনামূলক কম সমস্যা। ৭নং ওয়ার্ডের ভবনটির নিচে ফ্লোর করেছে। চারটি পিলার নষ্ট ছিল তা ভেঙে আস্তর করে দিয়েছে। তবে শিডিউলে কি আছে জানি না। আমি ঠিকাদারের সাথে কথা বলেছি। ঠিকাদার জানিয়েছে তারাও জানে না সংস্কার কাজে বরাদ্দ কত। তবে আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি প্রতিটিতে ১২ লক্ষ টাকা করে বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু সে টাকা অনুযায়ী কাজ করেনি। যতটুকু জেনেছি ৬/৭ জনের একটি গ্রæপ কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। শুনেছি অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে ইউএনও কাজ দেখতে এসেছিলেন। তিনি কাজে সন্তুষ্ট হননি।’
বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওমর ফারুক পূর্বদেশকে বলেন, ‘সাইক্লোন শেল্টারের কাজ এখন শেষের পথে। ঠিকাদাররা ছাদের উপর একটি ঢালাই ও নিচের ফ্লোরে একটি ঢালাই দিয়েছে। ঢালাই কাজে কোনো রড ব্যবহার করেনি। প্লেইন ঢালাই দিয়েছে। আর ৫-৬টি জানালা সংস্কার করেছে। এ কাজের বরাদ্দ কত আমি জানি না। এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে চাই না। যা বলার আমার স্কুলের সভাপতি মোজাম্মেল সিকদার বলবেন।’
বাহারছড়া ১নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ওসমান গণি পূর্বদেশকে বলেন, ১০/১৫ দিন ধরে সাইক্লোন শেল্টারের সংস্কার কাজ চলছে। যেখানে যেখানে স্পট আছে সেখানে প্লাস্টার করা হচ্ছে। রঙও করছে। তবে কাজের বরাদ্দ কত জানি না। বরাদ্দ কত জানলেই বুঝতে পারতাম অনিয়ম হচ্ছে কিনা?
স্থানীয় লোকজন ও কয়েকজন ঠিকাদার জানান, ছনুয়ায় ৯নং ওয়ার্ডে নোয়াপাড়া প্রশিকা সাইক্লোন শেল্টার, ৭নং ওয়ার্ডে তোতকখালী রেডক্রিসেন্ট সাইক্লোন শেল্টার, ৮নং ওয়ার্ডে খুদুকখালী রেডক্রিসেন্ট সাইক্লোন শেল্টার, গন্ডামারায় এসআলম পাওয়ার প্ল্যান্টের পাশে সাইক্লোন শেল্টার, সরলে আমিন চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশের সাইক্লোন শেল্টার, বাহারছড়ায় ১নং ওয়ার্ডের উত্তর বাহারছড়ায় ওসমান মেম্বারের বাড়ির সামনের সাইক্লোন শেল্টার ও ৩নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ রতœপুর বুইদ্দার বাড়ির সাইক্লোন সেল্টার, খানখানাবাদে হিড বাংলাদেশের সাইক্লোন শেল্টার ও শীলকূপে বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয় সাইক্লোন শেল্টার এক কোটি দশ লক্ষ টাকার কাজ করা হচ্ছে। সাত থেকে ১৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে প্রতিটি সাইক্লোন শেল্টার সংস্কার করা হচ্ছে। কাজগুলো পেয়েছে এসএস কর্পোরেশন, আর আহমদ চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ, রনি এন্টারপ্রাইজ, হামিদ এন্টারপ্রাইজ ও সুজাত এন্টারপ্রাইজ। লাইসেন্সের স্বত্ত¡াধিকারীরা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংসদ সদস্যের ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত এক নেতা বলেন, ‘সংসদ সদস্য এলাকার উন্নয়নে বেশকিছু প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। এক শ্রেণির ঠিকাদাররা তা বাস্তবায়ন না করে হরিলুট করছেন। এমন অনিয়ম জানলে সংসদ সদস্য কখনোই প্রশ্রয় দিবেন না। অনিয়ম হলে প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে পারে।’
বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোমেনা আক্তার পূর্বদেশকে বলেন, ‘নয়টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের কয়েকটি আমি ঘুরে দেখেছি। সেখানে কাজ চলছে। সবগুলো কাজের দরপত্র আহŸান করা হয়েছে। শুধু প্রচার নিয়ে অভিযোগ আছে। এরপরেও অন্য কোথাও কোনো সমস্যা আছে কিনা আমি দেখবো। কাজের মান নি¤œমানের হলে কোনো ঠিকাদার চেক পাবে না। আমার স্বাক্ষর ছাড়া কিভাবে ওরা বিল পায় দেখি। কাজ বুঝে নিয়েই চেক দিব।’