বই পড়া ছাড়া কোনো জাতি উন্নত হতে পারে না

160

একুশের বই মেলা শুরু হচ্ছে। বাংলা একাডেমি চত্বরে চলবে সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জীবন নিয়ে নানা আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রতিদিন প্রকাশ পাবে অনেক বই। মানুষ ঘুরে ঘুরে বই দেখবে, কিনবে, পড়বে। ব্যাগে ঝুলিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবে। দেখবে কাগজের বুখে কালো কালির অক্ষরে মুদ্রিত জীবনের রূপ। জীবন বোধের নিমূর্তি প্রকাশ। জীবন ও জগৎকে নতুন করে দেখবে। উপলব্ধি করার নতুন চোখ ও হয়তো খুলে যাবে কোন পাঠকের। এক মাসের জন্য ঢাকা হয়ে উঠবে বইয়ের নগরী। এই মেলায় প্রকাশিত হবে বছরের সর্বোচ্চ সংখ্যক বই। প্রকাশক ও লেখকরা এই মেলা সামনে রেখেই তাদের বই প্রকাশের চিন্তা করেন। কারণ একসাথে এত ক্রেতা ও পাঠক বছরের আর কোনও সময় পাওয়ার সুযোগ নেই। তাই বেশি বই প্রকাশ ও বিক্রির ফলে মানুষের যেটুকু পাঠের অভ্যাস এখনো আছে। তা কিছুটা ঝালাই হবে। সৃষ্টি হবে নতুন লেখক, পাঠক-পাঠিকা। জাতির উন্নয়নের একটি প্রয়োজনীয় শর্ত এভাবেই বাস্তবে রূপাইত হয়ে উঠবে।
আমাদের দেশে সাধারণত এই ফেব্রæয়ারি মাস এলেই বই মেলা আর বই নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন বেশিরভাগ প্রকাশক, লেখক ও পাঠকেরা। বাকি সারা বছর তেমন একটা সাড়া পড়ে না বই নিয়ে। যদিও একুশে বই মেলা ছাড়াও রাজধানীতে বছরের বিভিন্ন সময়ে আয়োজন করা হয় আরো বেশ কয়েকটি বই মেলার। সেগুলোর প্রতি তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায় না পাঠকের। ঢাকা আন্তর্জাতিক বই মেলা হেমন্তের বইমেলা। বর্ষার বই মেলাসহ বছরের যে গোটা পাঁচেক বই মেলার আয়োজন করা হয়, তার খবর ক’জন পাঠকইবা রাখেন।
কিন্তু বই ও বইয়ের মেলা একটি জাতির জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বই পড়া ছাড়া কোনো জাতি উন্নত হতে পারে না। এই পুরনো কথাটা সবাই জানেন। কিন্তু আমাদের সমাজে এর তেমন প্রতিফলন নেই। যেটুকু আছে সেটুকু সৃষ্টিতে একুশে বই মেলার বিশেষ অবদান আছে। এটা বলতেই হবে। এ প্রসঙ্গে আমরা একনজরে একুশে বইমেলার ইতিহাস এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আয়োজিত বইয়ের মেলা নিয়ে জেনে নিতে পারি কিছু তথ্য।
একুশের বইমেলার সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার ইতিহাস। ১৯৫১ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন অনেকে। তাদের স্মৃতি ধরে রাখতেই এই মেলার নাম দেওয়া হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা। ১৯৭২ সালে মুক্তধারা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা ফেব্রূয়ারি মাসের ৮ তারিখে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজের সামনের বটতলায় তার প্রকাশনীর বই বিছিয়ে বসেন। সে সময় মুক্তধারার ছিল মাত্র ৩২টি বই। বইগুলো ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রিত বাংলাদেশের শরণার্থী লেখকদের লেখা। সে বছর বাংলা একাডেমিও একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বিশেষ মূল্য ছাড়ের মাধ্যমে তাদের বই বিক্রি করে। আর এভাবেই ধীরে ধীরে জমে উঠতে শুরু করে বইয়ের মেলা।
১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমির এ মেলার স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি যুক্ত হয় মেলার সাথে। ১৯৭৯ সালে বই মেলার সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। তার পর থেকে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বই মেলা। কিন্তু ধীরে ধীরে মেলা নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়ায় মেলার সময় বাড়ানো হয়। এখন ফেব্রুয়ারি জুড়েই চলে একুশের গ্রন্থমেলা। এবার তৃতীয় বছরের মতো বইমেলা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজন করা হচ্ছে।
বইয়ের ইতিহাস অনেক প্রাচীন হলেও মুদ্রিত বইয়ের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। প্রথম মুদ্রনযন্ত্র আবিস্কৃত হয় ১৫৫৪ সালে জার্মানির ফ্রাংকফুর্টে। আর তখন থেকে ছাপানো বই মানুষের হাতে আসে। ওই বছর বা তার পরের বছর মুদ্রিত বইয়ের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় ওই ফ্রাংকফুর্টে। শহরের এটাই হলো বিশ্বের প্রথম বইয়ের মেলা। ফ্রাংকফুর্ট বই মেলা এটি বিশ্বের প্রাচীনতম বইমেলা। মুদ্রনযন্ত্রের আবিষ্কারক ইয়োহান্সে গুটেনবার্গ তার আবিস্কৃত ছাপাখানার যন্ত্রাংশ এবং ছাপানো বই বিক্রির জন্য ফ্রাংকফুর্টে আসেন। ফ্রাংকফুর্ট শহরের স্থানীয় কিছু বই বিক্রেতাও তাদের প্রকাশিত বই নিয়ে বসতে থাকেন। আর এগুলো কিনতে বিভিন্ন জায়ড়া থেকে মানুষও আসতে শুরু করে। এভাবেই জমে ওঠে ফ্রাংকফুর্টের বইমেলা। বর্তমানে এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বইমেলা। এ মেলার সময়কাল পাঁচ দিন কিন্তু সারা বিশ্বের হাজার হাজার প্রকাশক, বিক্রেতা, লেখক, পাঠক, দর্শক ও সাংবাদিকের অংশগ্রহণে মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা। লন্ডন বইমেলা প্রকাশনার দিক থেকে লন্ডন বই মেলা বিশ্বের সবচেয়ে বড় বই মেলাগুলোর একটি। গত বছর এ মেলায় বিশ্বের একশরও বেশি দেশ থেকে ২৩ হাজার প্রকাশক, বই বিক্রেতা, সাহিত্য প্রতিনিধি, লাইব্রেরিয়ান, সংবাদমাধ্যম কর্মী অংশ নিয়েছিলেন। প্রকাশিতব্য বইয়ের প্রচারের জন্য এবং অন্য প্রকাশক থেকে বইয়ের স্বত্ব অথবা বইয়ের অনুবাদ স্বত্ব কেনা-বেচার জন্য প্রকাশকেরা এ মেলায় অংশ নেন। ফ্রাংকফুর্টের বই মেলার সাথে এ মেলার বড় পার্থক্য হলো এটি আসলে প্রকাশকদের মেলা। এখানে সাধারণ পাঠকের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে।
কলকাতা বই মেলা ফ্রাংকফুর্ট এবং লন্ডন বই মেলার পরের স্থানটি কলকাতা বইমেলার। সে হিসেবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বই মেলা এটি। মেলা শুরু হয় ১৯৭৬ সাল থেকে। মেলা অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারির শেষ বুধবার থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম রোববার পর্যন্ত। সব মিলিয়ে মেলার মেয়াদ ১২ দিন। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, মেলায় প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২০ লাখ মানুষের সমাগম হয়। ফ্রাংকফুর্ট এবং লন্ডন এ দু’টি বই মেলার সাথে কলকাতার বই মেলার পার্থক্য হলো এখানে পাঠকদের গুরুত্ব দেয়া হয় সবচেয়ে বেশি। শুধু ব্যবসা নয়, পাঠক সৃষ্টিই এ মেলার মূল উদ্দেশ্য।
আসলে পাঠক সৃষ্টি, এটাই বই মেলার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। বেঁচে থাকার জন্য খাবার খাওয়া যেমন মানবদেহের জন্য অপরিহার্য কিন্তু খেয়ে বেছে থাকাই মানুষের জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হতে পারে না। স্রষ্টার স্মরণ, মানুষের কল্যাণ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বর্তমান পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যাওয়াই হলো মানব জীবনের লক্ষ্য। তেমনি বইয়ের ব্যবসা নিঃসন্দেহে প্রকাশকের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু বই প্রকাশের মূল লক্ষ্য হলো মানুষ যাতে পড়তে পারে, জানতে পারে, জ্ঞানার্জন করতে পারে সেই সুযোগ করে দেয়া অর্থাৎ পাঠক সৃষ্টি।
বইমেলার কারণেই দেশে বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহের একটা জায়গা ক্রমেই সৃষ্টি হচ্ছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমরা চাই মানুষ বই পড়–ক, মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাক, মানুষ প্রকৃত অর্থে মানুষ হয়ে উঠুক। একজন বিশিষ্ট লেখক একবার কাগজে লিখেছিলেন, ‘আমি বই পড়ি না’। তারপর সেই কাগজটা একটা গরুর গায়ে সেটে দিয়েছিলেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, যে লোক বই পড়ে না, সে গরুর মতোই নির্বোধ, মানুষকে প্রকৃত ‘মানুষ হতে হলে তাকে গুরু-ছাগলের জীবন থেকে উঠে আসতে হবে। বই পড়ার গুরুত্বটুকু উপলব্ধি করতে হবে। বই পড়তে হবে, তাই বই হোক আমাদের নিত্যসঙ্গী, তাই সবাই বই পড়–ন এবং জীবনকে সমৃদ্ধ করুন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট