প্রায়শ্চিত্ত

56


ঘটনার আকস্মিকতায় আচমকা আজব দেশে গিয়ে আছড়ে পড়লেন রবিউল হোসাইন সাহেব। অনাহুত অতিথি তিনি। স্বভাবতই হতভম্ব। শুধু কি তাই, বোকাও যে বনে গেলেন সাথে। বোবা তো হয়েছেনই। কোন রা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। কী থেকে কী হয়ে গেল কিছুই ঠাহর করতে পারছেন না তিনি। পুলিশ আসবে! হাতকড়া পরিয়ে মান-সম্মানের বারোটা বাজিয়ে তাঁকে নিয়ে যাবে থানায়! তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণ চেষ্টার মামলা হবে! তাও নাতিনের বয়সী একটা বাচ্চা মেয়ের অমূল্য সম্পদ কেড়ে নেয়ার চেষ্টা! কী লজ্জা! কী লজ্জা! কী লজ্জা! এই দীর্ঘ জীবনে এত লজ্জার মুখোমুখি কখনো তিনি হননি। কিছুক্ষণ আগে যে অপমান আর যাতনা পেয়েছেন ওটা এখন মনে হচ্ছে এটার তুলনায় কিছুই না, নস্যি। যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ আর তার পাশে বামনতুল্য পেয়ারা গাছ। তাঁর আজ্ঞাবহ হলে তিনি হুকুম করতেন, ধরণী, দ্বিধা হও। তারপর সরীসৃপের মত সুড়সুড় করে ঢুকে পড়তেন অতল গহ্বরে এবং হারিয়ে যেতেন চিরতরে। এই সংকুচিত, কাচুমাচু ও কালিমাখা মুখ সকলকে দেখানোর হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতেন তিনি।
কিন্তু এটা তো সম্ভব নয়। তবে এখন কী করবেন রবিউল হোসাইন সাহেব? কথা না বলে নতমুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবেন? তিনি অবশ্য তাই করছেন। একপাশে সরে এসে সবার দুয়োধ্বনি ও গালমন্দ হজম করছেন। ঘটনা যে অস্বীকার করবেন তারও কোন জো নেই। অবশ্য আত্মরক্ষার্থে যে দুটো কথা বলবেন সেই সময়, সুযোগও হচ্ছে না তাঁর।
ঘটনার শিকার মেয়েটি ভয়ে কুঁকড়ে আছে এখনও। বড় বোন তাকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আগলে রেখেছে পরম মমতায়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আর কোন ভয় নেই বলে সান্ত¡না দিচ্ছে। বুকে জড়িয়ে ধরছে মাঝে মাঝে। ক্ষণে ক্ষণে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে রবিউল হোসাইন সাহেবের দিকে, ষাটোর্ধ যাঁর বয়স। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, সযতেœ ছাঁট দেয়া। বয়স হয়েছে, নামাজ কালামও নাকি পড়ে। অথচ ইয়েটা এখনও যায়নি। বদের বদ, বুড়ো ভাম কোথাকার। মনে মনে বলে বড় বোনটি। তারপর আওড়ায় বহুল প্রচলিত প্রবচন, ঘিয়ে ভাজে নিমের পাত, নিম ছাড়ে না আসল জাত।
মেয়েটির মা ফারজানা হাত-পা ছুঁড়ে সমানতালে তাঁর স্বরে চেঁচামেচি করে যাচ্ছেন। যা তা বলে আক্রমণ করছেন রবিউল হোসাইন সাহেবকে। এদেশীয় মহিলাদের মুখে মানানসই নয় এমন গালি ও অশ্লীল বাক্যও তিনি ব্যবহার করছেন অবলীলায়। ভাবছেন, ভালই জোশ আসবে এতে। এসেছে, তবে তাঁর দায় ও সায় আরও বেশিতে। এবার অসামান্য ফল লাভের আশায় তিনি হিন্দী সিরিয়াল দেখে শেখা বেশ কিছু শব্দ (আক্রমণাত্মক ও নোংরা) কাপড়ে জোড়াতালি যেমন করে দেয়া হয় তেমনি করে জুড়ে দিচ্ছেন এখানে ওখানে।। আর সিরিয়ালীয় ফন্দি আঁটছেন মনে মনে কীভাবে এই ঘটনা থেকে বহুমাত্রিক ফায়দা লোটা যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, জনৈক দুবাই প্রবাসী করিম সিকদারের স্ত্রী ফারজানা, হিন্দী সিরিয়ালের প্রতি যাঁর ভক্তি ও আসক্তি অনেক আগেই ছুঁয়েছে নেশাগ্রস্ততার উচ্চতা ও গভীরতা। এটা তো সেই ভয়ংকর আফিমের মতন যা খেলে তিনি বাঁচেন, না পেলে গড়াগড়ি খান। তার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে তাঁর মন ও মননের গভীরে, রোজকার চিন্তা-চেতনায়, পোশাক-আশাকে ও চালচলনে। এ নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে প্রচন্ড ঝগড়ার ব্যাপার ঘটেছে বেশ কয়েকবার। ফলাফল হয়েছে ঠিক ততটুকু লাউ ও কদুর মধ্যে পার্থক্য আছে যতটুকু। সেই ক্ষোভে বেচারা করিম সিকদার দেশে আসছেন না আজ প্রায় পাঁচ বৎসর। ডেউয়া ফলের স্বাদে তাঁর ধরেছে অরুচি।
কিছুক্ষণ পর ফারজানা দৌড়ে গিয়ে পাশের ফ্ল্যাট থেকে সক্রোধে ডেকে আনলেন আমিনা ও তার মেয়ে, ঘটনার শিকার মেয়েটির সমবয়সী, ছবিকে। পাশাপাশি ফ্ল্যাটে বসবাস যদিও, তাদের মধ্যে গড়পড়তা কোন সম্পর্কই নেই, ভাল সম্পর্ক দূরের কথা, হৃদ্যতার সম্পর্ক তো নয়ই। যে জন যারে দেখতে নারে, তার ছায়া দেখলে লাথি মারেÑ তাদের অবস্থা হয়েছে ঠিক এরকম। জল ও তেলের মতন অবস্থান তাদের। বাইরে লাইট জ¦ালানোর মত বিন্দু ঘটনা নিয়ে সিন্ধু কাজিয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে একবার। একেবারে হাতাহাতির উপক্রম। নেকড়ার আগুনের মতই ধুমিয়ে ধুমিয়ে জ¦লছে এই বিবাদের অনল। ফলে পাশাপাশি দুই পরিবারের মধ্যে চরম রেষারেষি, তিক্ততা, অপ্রীতি। কেউ কারো ছায়া মাড়ায় না, একের কষ্টে অন্যজন পাশে দাঁড়ায় না। বরং আড়ালে-আবডালে খেজুর রসকে জ¦াল দেয়ার মত করে সেটাকে ঘনীভূত করতে সচেষ্ট থাকে। এখন মোক্ষম একটা অস্ত্র পেয়ে মনে মনে বেজায় খুশি ফারজানা। নিজেকে মনে হচ্ছে কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ঝিঙ্গে ফুল।
আমিনা এসে ফারজানাদের বাসায় তার বাবাকে দেখে অবাক তো অবাক, একেবারে হতবাক, স্তম্ভিত। আর ফারজানার কটু মুখে ঘটনার অতি রং-লাগানো বিবরণ শুনে থ বনে গেছে সে। এও কি হয়? এও কি সম্ভব? মাথা ঝিম মেরে থাকে তার। পরে একটু ধাতস্থ হয়ে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। মেয়েকে সামনে আসতে দেখে লজ্জাবতী পাতার মতন একেবারে চিমসে যান রবিউল হোসাইন সাহেব। পারলে ভীরু খরগোশের রূপ ধারণ করে দৌড়ে পালিয়ে বাঁচেন। অথবা দেয়ালের রড-সিমেন্ট-ইট-সুড়কির সাথে মিশে একাকার হয়ে যেতে পারলে স্বস্তি। বা কোন এক যাদুবলে সকলের চোখে ধূলো দিয়ে অজানা ডেরায় চলে যেতে পারলে কতই না ভাল হত। রাগে ক্রোধে বিস্ফোরিত চোখে আমিনা তাঁর দিকে তাকায়। কিন্তু তিনি পারেন না তাকাতে। সেই সাহস ও অবকাশ কোথায় তাঁর?
‘ছি বাবা, ছি!’ মনে হয়, মনের সমস্ত ঘৃণা মিশ্রিত করে কথাগুলো উগরে দিয়েছে আমিনা গায়ের সমস্ত শক্তি জড়ো করে। এগুলো এমনই ভারি আর ওজনদার ঠেকে রবিউল হোসাইন সাহেবের কাছে যে, এদের ঠেলে পথ পরিষ্কার করে মেয়ের কাছে পৌঁছা একদমই অসম্ভব। মেয়ের ঘৃণার অনলে খড়-বিচালি তিনি জ্বলে জ্বলে পুড়ে পুড়ে ভস্ম হচ্ছেন। চোখ বন্ধ করে সেটা সহ্য করে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না তাঁর। এটাও সম্ভব নয় যে, সাপমাসি হয়ে ডানা ঝাপটে উড়াল দেবেন তিনি দূরদেশে। একসময় দেখা যায়, দুই তাওয়া থেকে দুই ফোঁটা তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তাঁর চোখের কোল বেয়ে।
‘ এই যে শোন সোনাচান্দ,’ আমিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেন ফারজানা,‘ ছি ছিতে কাজ হবে না। তোমার বাবাকে পুলিশের রামপ্যাদানি না খাওয়ালে আমার মন শান্ত হবে না। এখনই ফোন করছি আমি।’
ফারজানা সত্যি সত্যি পুলিশে খবর দেন। ওরা এই এল বলে।
আমিনা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে ছবিকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।

‘এই বুড়ো, দেখে চলতে পারিস না? চোখ দুটোকে পায়ের তলায় নিয়ে হাঁটছিস নাকি?’
রবিউল হোসাইন সাহেব তাকালেন মোটরবাইক চালকের দিকে। তার বয়স হবে চব্বিশ কী পঁচিশ। ভদ্রলোকের ছেলে বলেই মনে হয় দেখে। কিন্তু তিনি বিস্মিত হলেন যুবকের হামবড়া ভাব আর মুখের ভাষা দেখে। প্রতিবাদ করলেন তিনি,‘ আমি তো বাবা ঠিক পথেই আছি। তুমিই তো বরং রং সাইডে গাড়ি চালাচ্ছ।’
‘ হোয়াট!’, ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল চালক,‘ তুই আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস বুড়ো!’
‘ আমি জ্ঞান দিচ্ছি না বাবা। যেটা ঠিক সেটাই বললাম শুধু।’
‘ তার মানে, তুই-ই ঠিক। আমি কিচ্ছু না! ওরে কালা, কী বলেরে বুড়া মিয়া!’
কালা বলল,‘ হালায় মাইর খাইবার চায়। বুজতাছে না যে কার লগে কতা কইতাছে।’
‘ তো বসে আছিস কেন? বুঝিয়ে দে তোর তানপুরা বাজিয়ে, আর আমি তা তা থৈ করে মজা লই।’
বসের অনুমতি পেয়ে বাইক থেকে নেমে বীরদর্পে এগিয়ে আসে ছয় ফুট লম্বা শক্ত সমর্থ পেটা শরীরওয়ালা কালা। পাবলিকের সামনে বীরত্ব ফলাতে পারবে, বুড়োকে নিয়ে একটু মউজ করা যাবে ভেবে খুশিতে জ¦লজ¦ল করছে কালার চোখ দুটো। যেন ওগুলো আঁধার রাতে মিটমিট করে জ¦লতে থাকা এক জোড়া জোনাকি পোকা। মৌচাকে ঢিল ছোঁড়া হয়েছে, দেরী করে বুঝতে পারলেন রবিউল হোসাইন সাহেব। তিনি ভয় পেয়ে গেলেন কালার জোশোদ্দীপ্ত চেহারা দেখে।
‘ এই বুড়া, তুই কার লগে কতা কইতাছস জানস? লিডার আমজাদ তালুকদারের পোলা ছাত্রনেতা মিলটন তালুকদারের লগে। সালাম দিয়া আদবের লগে কতা কইবি, তা না, মুখে মুখে তর্ক করতাছস।’
রবিউল হোসাইন সাহেব দুই হাত জোড় করে বললেন,‘ ভুল হয়ে গেছে বাবা, মাফ করে দাও।’
‘ যা, পা ধইরা ক্ষমা চা।’ বলে কষে একটা চড় লাগিয়ে দেয় কালা। রবিউল হোসাইন সাহেব টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যান পিচ ঢালা রাস্তায়। চোখে-মুখে অন্ধকার দেখেন তিনি।
‘ এই পা ধর, মাফ চা।’, ধমকে দেয় কালা।
মোটরবাইকে বসে মিলটন তালুকদার হাসে গরবের হাসি।
ব্যথায় কোঁকড়াতে থাকেন রবিউল হোসাইন সাহেব। এই অবস্থাতেই একটু অগ্রসর হয়ে মিলটনের পা ধরে ক্ষমা চান তিনি।‘ যা, দিলাম ক্ষমা করে।’ বলে ছাত্রনেতা পা দিয়ে সজোরে ধাক্কা মারে বুকে।
শক্ত বুটের বেদম আঘাত খেয়ে মনে হল, প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাচ্ছে বুঝি। জ্ঞান হারাবার মত অবস্থা হয় রবিউল হোসাইন সাহেবের। চাপা আর্তনাদ করে বুক চেপে ধরে পড়ে থাকেন তিনি। বাইক চলে যাওয়ার পর আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন লোক দয়াপরবশ হয়ে পাজাকোলা করে তুলে নেয় তাঁকে রাস্তা থেকে এবং পৌঁছে দেয় গন্তব্যস্থলে। সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছতেই তিনি লোক দুজনকে ধন্যবাদ জানালেন এবং বললেন, একাই যেতে পারবেন তিনি। পারলেন, তবে কোঁকড়াতে কোঁকড়াতে তিন তলা পর্যন্ত উঠতে গিয়ে দুইবার হোঁচট খেলেন তিনি। দ্বিতীয় চোটটা লেগেছে বেশ ভাল মতই। যুৎসই কাবু হয়ে যখন পা রাখলেন তিন তলায় বড় মেয়ের বাসায় যাবেন বলে, হুঁশ ছিল তাঁর না থাকার মতই। দরজা একটা খোলা পেয়ে তিনি হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লেন ভিতরে এবং লম্বা সোফায় চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা মেয়েটির উপর গিয়ে পড়লেন ধপাস করে। মেয়েটি তখন ইমোতে ভিডিও কলে ব্যস্ত ছিল বয়ফ্রেন্ডের সাথে।
>> আগামী সংখায় সমাপ্য ৩
জীবনের প্রথম হাজতবাস। পরদিন বিচারকের ভরা মজলিসে হাজিরা দিতে যাবেন রবিউল হোসাইন সাহেব। তার আগে হাজতে মশাদের বিশ্রীরকম অভ্যর্থনায় তিনি তিতিবিরক্ত। এখন পর্যন্ত কেউ তাঁর সাথে দেখা করতে আসেনি। না বড় মেয়ে, না ছোট মেয়ে, বা তাদের স্বামীদের কেউ। ছেলে তো নেই তাঁর। পতœীবিয়োগ হয়েছে তাও সাত বছর হয়ে গেল প্রায়। কেউ আসবে বলেও মনে হয় না। কোন মুখে আসবে তারা? তিনি যে চুনকালি মেখে দিয়েছেন। পথ বন্ধ করে রেখেছেন।
ছোট্ট ভুল, কিন্তু কত বিরাট মাশুল! রবিউল হোসাইন সাহেব তাজ্জব বনে যান এই ভেবে যে, এমন অনেক কিছু ঘটে যায় জীবনে যেখানে মানুষের কোন হাত থাকে না। অথচ তাকেই কিনা ভোগ করতে হয় এর ভয়ানক পরিণতি! পোহাতে হয় অসহনীয় দুর্ভোগ। পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। কেন এমন হয়, কেন? এই জিজ্ঞাসা তাঁর মনে জাগে বারে বারে হাজার বার। কিন্তু কোন সদুত্তর পান না তিনি। এ এক বিরাট রহস্যই থেকে যায় তাঁর কাছে।
এসব যখন ভাবছেন রবিউল হোসাইন সাহেব তখন জেনেছেন, কেউ একজন তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী। একটু অবাকই হলেন যেন তিনি। কে হতে পারে? আরও অধিক বিস্মিত হয়ে তিনি দেখেন, সেই মহিলা এসে হাজির যিনি সুহাসিনী, কিন্তু কটুভাষিণী। তিনি ফারজানা, তাঁর বড় মেয়ের ঝগড়াপ্রবণ প্রতিবেশিনী।
‘ কলি যুগের পুরুষরা সব এক’, কোন ভূমিকা ছাড়াই দুই ঠোঁটের ফাঁকে ভূবনভুলানো হাসি ঝুলিয়ে বলতে শুরু করেন ফারজানা,‘ তারা সবাই রূপের পাগল। সুযোগ পেলে ছুঁড়ি বুড়ি কাউকেই ছাড়তে চায় না। ঠিক কিনা বলুন রবিউল সাহেব।’
‘ আমি কিন্তু নির্দোষ মেম।’
‘ জানি। আপনার ঘটনার কথা শুনেছি পরে।’
‘ এবার নিশ্চয়ই অভিযোগ তুলে নেবেন। আমি ছাড়া পাব।’
‘ কেন নয়? অবশ্যই আপনি এখান থেকে বের হয়ে সসম্মানে বাড়ি ফিরে যাবেন। কিন্তু আমার যে একটা শর্ত আছে রবিউল সাহেব।’
‘ কী শর্ত?’
‘ আপনি প্রফেসর মানুষ। রিটায়ার করেছেন। বিপতœীক। মরুভূমিতে একা থাকেন। কিন্তু শুকিয়ে যাননি বা ক্ষয়ে যাননি এখনও। আমি চাই আপনি পেয়িং গেষ্ট হিসেবে আমার বাসায় থাকবেন। আমার মেয়ে দুটোকে পড়াবেন। খাওয়া-দাওয়ার সমস্যা দূর হবে। ভাল যতœ-আত্তিও হবে। আমি নিজে আপনার দেখাশুনা করব। তখন দেখবেন কী হয়। মরা গাঙ্গে আসবে ভরা জোয়ার। চাঙ্গা হবে মন। ফুলে ফুলে আবার কানন হয়ে উঠবে আপনার জীবন।’
‘ এই শর্ত কেন মেম?’
‘ প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই রবিউল সাহেব। প্লীজ।’ শরীরী ভাষা, পোশাকী ভাষা, মুখের ভাষা এক করে এমন একটা কিছু তিনি ফুটিয়ে তুললেন অবয়বে বা এমন কিছুর ইঙ্গিত দিতে চাইলেন যা যুগ যুগ ধরে সেই অনাদিকাল থেকে চলে আসছে পুরুষ মানুষের বহুল কাংক্ষিত হিসেবে এবং যা হচ্ছে ইবলিশের প্রধান ও মোক্ষম হাতিয়ার মনুষ্য প্রজাতিকে বিপথগামী করার জন্য।
ফারজানার প্রস্তাবে ‘হ্যাঁ’ বলতে পারেন না রবিউল হোসাইন সাহেব। প্রথম কথা হল, মহিলা যা চান এক কথায় তা হল অনাচার। এতে তাঁর সায় নেই মোটেই। দ্বিতীয় কথা, কারো বাসা-বাড়িতে পেয়িং গেষ্ট হয়ে থাকার কোন ইচ্ছাই তাঁর নেই। তৃতীয়ত, মেয়েদের মান-সম্মান ও সামাজিক অবস্থান আক্রান্ত হবে প্রচন্ডভাবে। ভয়ানক মনোকষ্টে ভূগবে তারা।
কিন্তু ফারজানা নাছাড়বান্দা। তাঁর কথা হল, হয় আমার প্রস্তাবে রাজী হও, নয় তো মামলার ঝামেলা সামলাও। যুৎসই উপঢৌকন পেলে পুলিশ তাঁর কথামতই কাজ করবে। নিয়ম ভেঙ্গে হাজতবাসের সময় নির্যাতন করবে। আর এ কথা তো সকলেরই জানা আছে যে, বাঘে ছোঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছোঁলে…. ঘায়ের শেষ নেই।

রবিউল হোসাইন সাহেব যেদিন প্রথম এলেন এখানে পেয়িং গেষ্ট হয়ে, সেদিনই আমিনারা বাসা নিয়েছে দশ সহ¯্র গজ দূরে এই পাড়ার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে অন্য কোথাও। লাজে ক্ষোভে অপমানে লাল হয়ে আমিনারা যেদিন ছেড়েছে ফ্ল্যাট, সেদিন ফারজানার হাসিটা ছিল দেখার মত। এমন চওড়া হাসি জীবনের প্রথম ছিল সেটি। খুশিতে তিনি ছন্দে ছন্দে উদ্বাহু নৃত্য করেছেন ময়ূরের মতন পেখম মেলে। অন্যদিকে ছোট্ট রুমের দরজা জানালা বন্ধ করে অন্ধকারে আগাপাশতলা ডুবে ছিলেন রবিউল হোসাইন সাহেব। আর উন্মাদের মত পান করেছেন আকন্ঠ, শান দিয়েছেন আজন্ম ভোঁতা ক্রোধের ছুরিকায়। তিনি এখন ফারজানার একান্ত অনুগত ও বিশ^স্ত দাস। ফারজানা যা বলেন, তিনি তাই করেন। ওঁকে দেবী জ্ঞান করেন। তবে মাঝে মাঝে তাঁর বিদ্রোহী মন মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তখন ফারজানা ভয় দেখান, মামলার দেহে প্রাণ সঞ্চারিত করবেন তিনি। অচলকে সচল করে সরিয়ে নেবেন আঁচল। এমন ধমকিতে দমে যান প্রফেসর সাহেব। দেবীর দেখানো রাস্তায় পুনরায় পথ চলতে শুরু করেন তিনি। আর ওঁর দেহাঞ্চলে অনল সৃষ্টি হলে দমকল হয়ে তাতে জল ঢালতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এতে চমৎকার খুশি ফারজানা। তিনিও প্রফেসরের সেবায় ত্রুটি রাখেন না। নিজের হাতে সব করেন। ঘাম ঝরিয়ে তবেই নিবৃত্ত হন।
এসব দেখেশুনে প্রফেসর তো বটেই, আমরাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না প্রায়শ্চিত্ত আসলে করছে কে, দীর্ঘ সময় স্বামীসোহাগ থেকে বঞ্চিত কলিযুগের রম্ভা দেবী ফারজানা, নাকি কিশোরী বালিকার সম্ভ্রম লুটের চেষ্টাকারী বলে অভিযুক্ত বিপত্নীক রবিউল হোসাইন সাহেব, নাকি ঘটনার নায়ক প্রতিনায়ক দুজনেই।