‘প্রাথমিক বিজয়’ হিসেবে দেখছে রোহিঙ্গারা

68

রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলার অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় চারটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত। গতকাল বৃহস্পতিবার নেদারল্যান্ডসের রাজধানী দ্য হেগে বাংলাদেশ সময় বিকেল তিনটায় আইসিজের প্রধান বিচারপতি আবদুল কাভি আহমেদ ইউসুফ এই আদেশ ঘোষণা করেন। এই আদেশকে প্রাথমিক বিজয় হিসেবে দেখছেন রোহিঙ্গারা। দাবিকৃত ছয়টির মধ্যে চারটি তাদের পক্ষে আসায় প্রথম জয়ের স্বাদ পেয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। রায়ের সংবাদ জানতে বৃহস্পতিবার বিকেলে টেকনাফের লেদা, শালবন নয়াপাড়া ও লেদা রোহিঙ্গা
শিবিরগুলোর ছোট ছোট দোকানে টিভি ও রেডিওতে খবর শুনতে ব্যস্ত ছিলেন রোহিঙ্গারা।
আদেশে বলা হয়, রাখাইনে গণহত্যায় দায়ী সেনাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে, গণহত্যার আলামত নষ্ট করা যাবে না, আদেশ বাস্তবায়নে অগ্রগতি জানিয়ে চার মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে মিয়ানমারকে, একই সঙ্গে রোহিঙ্গা হত্যা বন্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে রায়ে।
তাৎক্ষণিক এই রায়ের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে উখিয়ার ময়নারঘোনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মাস্টার নুরুল কবির জানান, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা চালিয়েছে। বিচারবহির্ভূত এই হত্যাকান্ডে অসংখ্য মুসলিম নারী, পুরুষ, শিশুকে হত্যা করেছে। আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ চেয়েছিলাম এই ধরনের একটি রায়। বৃহস্পতিবার গাম্বিয়ার আদালত যে রায় দিয়েছে এতে রোহিঙ্গা জাতির আশার প্রতিফলন হয়েছে।
বালুখালী ২নং ক্যাম্পের বাসিন্দা নুরুল বাশার এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, গণহত্যা বন্ধসহ মিয়ানমারে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দিতে রায়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে। পাশাপাশি আগামি ৪ মাসের মধ্যে রায়ের অগ্রগতি জানিয়ে যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে এতে বুঝা যাবে মিয়ানমারের অবস্থা। যদি আশানুরূপ অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়, তাহলে দ্রুত সময়ের মধ্যে মিয়ানমারের ফিরে যাবে রোহিঙ্গারা।
বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন (ইউকে) প্রধান থুন কিং বলেন, ‘এই রায়ের মাধ্যমে মিয়ানমার আরো বেশি চাপে পরবে। কেননা এই মামলায় মিয়ানমার স্টেট কাউন্সিলর প্রধান অং সান সুচি নিজে উপস্থিত ছিলেন। যদিও বা বিভিন্ন সময়ে স্বাধীন তদন্ত প্যানেলের নামে বার বার রোহিঙ্গাদের উপর পরিচালিত গণহত্যার ঘটনাগুলো এড়িয়ে গিয়ে সরকারি বাহিনীকে রক্ষা চেষ্টা করেছে দেশটি।
রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) সাধারণ সম্পাদক মাস্টার সৈয়দ উল্লাহ বলেন, ছয়টির দাবির মধ্যে চারটি আমাদের পক্ষে এসেছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে অং সান সু চি’র যুক্তি খারিজ করা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে সেখানে গণহত্যা হয়েছে। এজন্য রায়ের দিন সু চি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। এই থেকে সুচির লজ্জা পাওয়া উচিত।
কুতুপালং আন-রেজিস্ট্রার্ড রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা ও রোহিঙ্গা রিফিউজি কমিটির চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার আইসিজের রায়ের পর রোহিঙ্গারা নতুন করে জীবন ফিরিয়ে পাওয়ার মতো খুশি হয়েছে। রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় যে ৪টি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়েছে আইসিজে তা মিয়ানমার রক্ষা করলে ২০২০ সালের মধ্যে সমস্ত রোহিঙ্গা অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে ফেরত যেতে সক্ষম হবে। এ রায়ের মধ্যদিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রাথমিক বিজয় শুরু হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
কুতুপালং ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নেতা ডা. দিপু জাফর রায়ের প্রতিক্রিয়ায় জানান, দীর্ঘদিন পরে হলেও আইসিজের যে আদেশ দিয়েছে, এতে রোহিঙ্গা ছাড়াও পুরো বিশ্বের নির্যাতিত জনগোষ্ঠি আলোরমুখ দেখেছে। তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের পাশাপাশি খাদ্য, চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণে যে ভূমিকা রেখেছে, তাতে রোহিঙ্গারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আজীবন ঋণী থাকবে। এছাড়াও উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় মানুষের ত্যাগ-শিকার ও আন্তরিকতা কখনো ভুলার মতো নয়।
মধুরছড়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা ইলিয়াছ জানান, রায়ের মধ্যদিয়ে রোহিঙ্গাদের উপর চালানো নির্যাতন গণহত্যা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। আর এর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের আপত্তি নাকচ করে দিয়ে গাম্বিয়ার করা মামলা চলবে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের অধীনে পরিচালিত এই আদালত। তিনি বলেন, ২৩ জানুয়ারি রায়কে ঘিরে রোহিঙ্গারা যাতে কোনো প্রকার মিছিল, মিটিং, সভা-সমাবেশ না করে সে ব্যাপারে ক্যাম্প কমিটি পক্ষ থেকে বলে দেওয়া হয়। যার ফলে রোহিঙ্গা শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন, টিভি চ্যানেল খবর দেখেছে। তবে কিছু কিছু মসজিদে দোয়া-মোনাজাত করে বাংলাদেশ ও গাম্বিয়া সরকার এবং রোহিঙ্গাদের ইস্যুতে সহযোগিতাকারী আন্তর্জাতিক বর্হিবিশ্বের প্রতি শোকরিয়া জানানো হয়।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে শূন্য রেখা রোহিঙ্গা শিবিরের চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ বলেন, ‘আইসিজে রায়ে খুশি, এটি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য প্রথম জয়। কেননা যুগ যুগ ধরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নির্যাতনের শিকার হলেও কোনো বিচায় পায়নি। ফলে এই রায়ে মনে হচ্ছে বিচারের স্বাদ প্রথমবার পেয়েছি’।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেন, ‘আইসিজে’র ঘোষিত রায়ের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ক্যাম্পে নজরদারি রাখা হয়েছে’।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার ঘটনায় পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা চালায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। গণহত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৭ লাখেরও বেশি মানুষ। এই ঘটনায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নভেম্বরে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে গাম্বিয়া।
নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের পিস প্যালেসে গত ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর ওই মামলার শুনানি হয়। তাতে গাম্বিয়ার পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির বিচার বিষয়ক মন্ত্রী আবুবকর তামবাদু। অন্যদিকে মিয়ানমারের প্রতিনিধি ছিলেন নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চি।
গাম্বিয়া ও মিয়ানমার দুই দেশই ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ। এই কনভেনশন শুধু দেশগুলোতে গণহত্যা থেকে বিরত থাকা নয়; বরং এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ এবং অপরাধের জন্য বিচার করতে বাধ্য করে।