প্রসঙ্গ: পলিথিন ব্যবহার ও পরিবেশ বিপর্যয়

63

মুহাম্মদ এনামুল হক মিঠু

কিঞ্চিত প্রত্যাগত দিক থেকে আমরা দেখতে পাই, পাট থেকে পলিথিন ব্যাগ উদ্ভাবন করেছেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ জুটমিল কর্পোরেশনের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ড. মোবারক আহমদ খান। এ ব্যাগের নাম দেয়া হয়েছে ‘সোনালী ব্যাগ’। পাট থেকে সেলুলোজ আহরণ করে প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা হয় সিট। তা থেকেই তৈরি হয় ব্যাগ। উদ্ভাবক দাবি করেছেন, পাট থেকে তৈরি পলিথিন ব্যাগ প্রচলিত পলিথিনের তৈরি ব্যাগের চেয়ে অধিক কার্যকর। এ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করার পর ফেলে দিলে সহজেই মাটির সঙ্গে মিশে যায়। উপরন্ত তা মাটিতে সারের কাজ করে। সহজলভ্য উপাদন এবং সাধারণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি এ পলিথিন ব্যাগ বিদেশে রফতানির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে অস্টেলিয়া, জাপান, আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশ সোনালী ব্যাগ আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তিনি জানিয়েছেন, প্রাথমিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে দৈনিক ৩ টন। সরকারীভাবে এ ব্যাগ উৎপাদন হলেও বাণিজ্যিকভাবে এর উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। পাটকলগুলোতেই এর উৎপাদন হতে পারে অতি সহজেই। তাছাড়া যে কেউ ক্ষুদ্র পরিসরে এর কারখানা স্থাপন করতে পারে। স্বল্প পরিমাণে সোনালী ব্যাগ উৎপাদিত হওয়ায় এর বিপনন এখনো সীমিত। প্রতি ব্যাগের দাম ৩ থেকে ৪ টাকা। অধিক পরিমাণ উৎপাদিত হলে দাম প্রতিটি ৫০ পয়সায় নামিয়ে আনা সম্ভব বলে পাট গবেষণা ইন্সটিটিউটের কর্মকর্তারা মনে করেন। বলার অপেক্ষা রাখেনা, সোনালী ব্যাগ প্রচলিত পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হতে পারে। প্রচলিত ‘অক্ষয়’ পলিথিন ব্যাগের কারণে পরিবেশ দূষণ, ভূমির উর্বরতাশক্তি হ্রাস, নদনদী ভরাট, শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি ইত্যাদি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব যদি সোনালী ব্যাগ প্রয়োজন মত উৎপাদন, বাজারজাত ও ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এর ফলে পাটের অর্থনীতিও অনিবার্যভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে।
যে পলিথিন ব্যাগ আমরা বাজারে দেখতে পাই, তার বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ১৯৮২ সালে। কিন্তু যে ইথাইলিন (মলিকিউলাস) থেকে পলিথিন বা পলিথাইলিন উৎপাদিত হয় তা পরিবেশের জন্য ভয়ংকর ক্ষতিকারক। এ পলিথিন ব্যাগ কোনোভাবেই এমন কি পুড়িয়েও ধ্বংস করা যায় না। ফলে জমিতে, পানিতে, ড্রেনে যেখানেই ফেলা হোক না কেন, তা অক্ষত থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জমিতে এই পলিথিন ব্যাগ পড়ার কারণে জমির ফসল উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। নদনদী ও জলাশায়ে পতিত হওয়ার ফলে সেগুলোর বুক ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোর জলাবদ্ধতার সে সংকট, তার পেছনেও রয়েছে এই পলিথিন ব্যাগ। তা ড্রেনে পড়ে তার পানি নিকাষ ক্ষমতা অকর্যকর করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, ভূপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে তোলার পেছনে এর বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। ভূমিকল্প, বজ্রপাত, আট্রাভায়োলেট রেডিয়েশন ইত্যাদির জন্যও এই পলিথিনের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। পলিথিন বা পলিথিন ব্যাগের এই পরিবেশ বিপর্যয়কর নানামুখী প্রতিক্রিয়ার কারণে ২০০২ সালে সংশোধিত পরিবেশ আইনে রপ্তানিমুখী শিল্প বাদে সব ধরনের পলিথিনব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা হয়। এই আইন অমান্য করলে দশ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও দশ লাখ টাকা জরিমানার বিধান করা হয়। পাশাপাশি পলিথিন ব্যাগবাজারজাত করলে ছয় মাসের কারাদন্ড ও দশ হাজার টাকা জরিমানার আইনও করা হয়। ২০১০ সালে পলিথিনের পরিবর্তে প্রতিটি মোড়কে পাটজাত ব্যাগের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেআইন পাস করা হয়। মূল কথা হচ্ছে- আইন আছে কিন্তু তার বাস্তবায়ন নেই। আইন থাকা সত্তে¡ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা এবং সরকারের দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থার কারণেই অবাধে চলেছে পলিথিনের যত্রতত্র ব্যবহার। কে নেবে এর দায়ভার?কাকে দোষারোপ করব আমরা? প্রশ্ন দুটির উত্তর বোধয় এদেশে আদৌ পাওয়া সম্ভব নয়। তাই আমাদেরই (সাধারণজনগণ) এগিয়ে আসতে হবে। নিজেদের স্বার্থে ফিরিয়ে আনতে হবে কিছু পুরনো অভ্যাস। বিগত দশকের গ্রাম-বাংলায় প্রচলিতকিছু ঐতিহ্যের পুনঃপ্রবর্তন এখন সময়ের দাবি। পলিথিন এর বদলে পাটের, কাগজের ও কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করার কথা বলা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ হয়নি। বিকল্প ব্যাগের ব্যবহার তেমনভাবে বাড়েনি। পরিবেশ আন্দোলনের (পবা) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু চট্টগ্রাম ও ঢাকা শহরেই প্রতিদিন ২ কোটি ৬০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। শহরের জলাবদ্ধতার জন্য ৮০ শতাংশ দায়ী এই পলিথিন ব্যাগ। সারাদেশে পলিথিন ব্যাগ কত ব্যবহৃত হয় এবং তার কী ধরনের বিরূপতা পরিবেশ, উৎপাদন ও জীবনযাত্রায় পতিত হয়, তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। নিষেধাজ্ঞা সত্তে¡ও পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার কীভাবে হচ্ছে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাব এবং ব্যবস্থা গ্রহণের অক্ষমতাই এজন্য মূলত দায়ী। এটা ঠিক, পলিথিন ব্যাগ সহজে বহনযোগ্য, হাত বাড়লেই পাওয়া যায়, এবং দামও কম। এ কারণেই মানুষ তা ব্যবহার করছে। তাদের মধ্যে সচেতনতারও অভাব রয়েছে। বলা নিষ্প্রয়োজন, উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ যদি বন্ধ করা সম্ভব হতো তাহলে এর ব্যবহারও আপনা আপনি রহিত হতো। আরও লক্ষ্য করার বিষয়, বাজারে উপযুক্ত বিকল্পও যথেষ্ট পরিমাণে নেই। এমতাবস্থায়, সোনালী ব্যাগ সবচেয়ে উপযুক্ত বিকল্প হতে পারে। একদিকে প্রচলিত পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার ডেডস্টপ করতে হবে অন্যদিকে সোনালী ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার জনপ্রিয় করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ-পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে পরিবেশ ঘাতক পলিথিন ব্যাগের ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব হতে পারে । অন্যদিকে সোনালী ব্যাগ ব্যবহার ব্যাপক বাড়বে এবং বৃদ্ধি পাবে বাংলাদেশের প্রাক্তন গৌরবের পাট শিল্প উৎপাদন । বাংলাদেশের পাট-অর্থনীতি গার্মেন্টর চেয়েও বেশি অবদান রাখতে পারে এবং জনজীবনযাত্রায় আনতে পারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
আমরা এও জানি, বাংলাদেশেরই এক বিজ্ঞানী পাট থেকে ‘মিহিতন্তু’ আবিষ্কার করেছেন। এই তন্তু হতে পারে তুলাজাত তন্তুর বিকল্প। আবিস্ককর্তার দাবী, গুণে-মানে তুলাজাত তন্তুর চেয়ে পাটের মিহিতন্তু উত্তম। এ দিয়ে উত্তম কাপড় তৈরি হতে পারে এবং দেশের পাটকলগুলোতে সামান্য প্রযুক্তিগত পরিবর্তন সাধন করে মিহিতন্তু দিয়ে কাপড় উৎপাদন করা সম্ভব। অত্যন্ত দুঃখজনক, পাটের মন্ড দিয়ে কাগজ তৈরির কথা যেমন আর শোনা যায় না, তেমনি মিহিতন্তু দিয়ে কাপড় তৈরির কথাও শোনা যায়না। আমরা জানিনা, পাটের পলিথিন ব্যাগ তৈরির সম্ভবনাও অবহেলা-উপেক্ষোর শিকার হবে কিনা। পাটকে বলা হয় ‘সোনালী আঁশ’। পাট যে এর চেয়েও অনেক কিছু, বিভিন্ন আবিষ্কারে তার প্রমাণ আমরা পাই। একমাত্র পাটই দেশের অর্থনীতিকে আমূল পরিবর্তন করে দিতে পারে, এবং পরিবেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে । এজন্য যে সচেনতা, সঠিক সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা প্রয়োজন তার অভাব শোচনীভাবে লক্ষ্য করা যায়। পাটের প্রতিও এই অবহেলা, উপেক্ষা আমর্জনীয়।
আমাদের একটা অভ্যাস আর একটু সচেতনতাই পারে পলিথিনের ব্যবহারকে অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করতে। নচেৎ, আগামী প্রজন্মের জন্য এ রকম দূষিত পৃথিবী রেখে যাওয়া অন্যায় হবে। কাজেই- আসুন সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য এই অপচনশীল পলিথিনের বিরূপ প্রভাব থেকে পরিবেশ বিপর্যয়কে রক্ষা কল্পে পলিথিনকে বর্জন করতে সবাই যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করি, এটাই হোক প্রত্যাশা।
লেখক: কলামিস্ট