পর্ব-১৩ পেট্রোদাসী

363

> গত সংখ্যার পর
‘সোনালু, একটা বাসায় কাজ করেছ? বাসায় কাজ করার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। ধরো তোমাকে যদি হাসপাতালে বা মাদ্রাসায় ক্লিনারের কাজ দিই। সেখানেও তোমার ইজ্জত বাঁচাতে পারবে না। তা ছাড়া তোমার পাসপোর্ট নেই। পালিয়ে এসেছে। তুমি এখন আসামি। বাইরে কাজ করতে গেলেই পুলিশে ধরে জেলখানায় ঢোকাবে। সারা জীবন জেলখানায় পচতে হবে। তুমি তো পচবে। মনু মিয়ার কথা বাদ দিলাম, তোমার বাবা-মা?’
‘তাহলে আমি কী করব?’
‘সোনালু, আফাজ তোমাকে বিক্রি করে দিয়েছে। তাহলে বুঝতেই পারছ কী কাজ করতে হবে।’
‘জনতা, এটা কী বলো? আফাজরে আমি আপন ভাইয়ের মতো ভেবেছিলাম।’
‘সোনালু, আফাজ খারাপ লোক না। তোমাকে বিক্রি করা ছাড়া তার অন্য উপায় ছিল না। সে এই কোম্পানিতে জিম্মি। অনেক কাহিনি আছে তার। অনেক স্বপ্ন নিয়ে এদেশে এসেছিল সে। তুমি যেমন ঘটনাচক্রে এ জায়গায় এসেছে। আফাজও কোনো এক কারণে এসব করতে বাধ্য হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশের মানুষ। এই দেশে আমাদের পরিচিতি মিসকিন হিসেবে। ফকির-মিসকিনদেরকে ওরা দয়া করে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে দাসত্ব করার সুযোগ দিচ্ছে। আর দাসীদের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে তা তো উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। ধর্মীয়ভাবে স্বীকৃত। কাজেই গরিবরা সব সময় শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত হবেÑ এটা অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। আমিও তোমার মতো সৎ ছিলাম। সৎভাবে বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাকেও বাধ্য করা হয়েছে এ পথে পা রাখতে। কাজেই ওসব বলে লাভ নেই। তুমি প্রয়োজনের তাগিদে আমাদের পথে হাঁটবে। আমরা বাংলাদেশের মানুষ খুব গরিব। কিন্তু এই স্বপ্নের দেশ দুঃস্বপ্নে ভরপুর। নিজের অস্তিত্ব বাঁচানোর জন্য একেকজন একেক পথ বেছে নেয়। আমিও নিরুপায়। তোমাকে বাঁচানো আমার পক্ষেও সম্ভব নয়। এই কোম্পানির নিয়মমতো চলতে হয়। যদি নিজের ইচ্ছেমতো চলি, তবে আমাকে পুলিশে দেবে। ওই যে মমিন সাহেব, তিনি এ কোম্পানির মালিক। অনেক মেয়ে আছে দেহ বিক্রি করে যে টাকা পায়, সে টাকা তাকে দেওয়া হয় না। যেমন রূপী কাজ করিয়ে নেবে। কিন্তু বেশি টাকা নিজে রাখবে। অল্প কিছু টাকা তাকে দেবে। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা দেব। ওই টাকা তুমি দেশে পাঠাবে। তোমার বাবা-মাকে ভালো করবে। তারা সুখে থাকবে। আর তোমার জন্য দোয়া করবে। তাদের দোয়ার তোমার পাপ মুছে যাবে।’
একটু থেমে জনতা আবার বলে, ‘মমিন সাহেব তোমাকে পছন্দ করেছে। সে পছন্দ করা মানে তোমার ভাগ্যের দ্বার খুলে গেছে। তুমি শুধু তার কথামতো চলবে, তাকে খুশি করবে। এরপর তুমি যখন দেশে যাবে তখন তোমার বাড়িতে দালান হবে। তোমার গাড়ি হবে। তোমাকে সবাই কত সম্মান করবে। তুমি ভেবে দেখো কী করবে? তোমার জন্য দুটো পথ আছে। একটা জেলখানা। আপরটি সুখের সাগর। মমিন সাহেব আজ রাতে আসবে। তুমি তার সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত জানাবে।’
জনতার কথা শুনে সোনালু নিস্তব্ধ হয়ে যায়! কোনো কথা নেই। ভাষাহীন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জানালার ফাঁক দিয়ে। বাইরের প্রকৃতির সমস্ত আয়োজন অস্পষ্ট। চোখের আলো বাংলাদেশের নিভৃতে পড়ে থাকা ক্লান্ত ক্ষুধার্ত দুটো মুখের ওপর পতিত হয়। ছালেতন দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করছে, আর নাটু বাকরুদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। সোনালুর চোখ বেয়ে জলের ধারা নামে। অনেকটা সময় পার হয়। জনতা কখন ওর পাশে এসে বসেছে খেয়াল নেই। আলতো করে চোখের জল মুছে দিতেই বুঝতে পারে।
‘সোনালু কেঁদো না। চোখের জল মোছো। কান্নার কোনো দাম নেই। মনু মিয়ার ঘরে অনেক কেঁদেছ। বিনিময়ে কী পেয়েছ? হ্যাঁ পেয়েছ, ভিখিরি মা আর পঙ্গু বাবা।’
সোনালু চোখ মুছে বলে, ‘ঠিক বলেছ জনতা। মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছি। তার মানে অভিশাপের বোঝা হয়ে পতিত হয়েছি মাটিতে। তার ফল ভোগ করছি।’
‘সোনালু, তোমার কথা মানতে পারলাম না। অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। একটা হাদিস আছেÑ আল্লাহ্ ততক্ষণ পর্যন্ত ভাগ্য পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত নিজে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করে। তৈরি হয়ে নাও। অল্পক্ষণের মধ্যেই মমিন সাহেব আসবে।’
স্বর্গের দেশ। চারদিকে আলোর ঝলক। শুধু সোনালুর ভেতরে জমাটবাঁধা আঁধার। কিছুক্ষণের মধ্যে আঁধারের ঢেউ আরো প্রবল হতে থাকে। মমিন সাহেব ঘরে প্রবেশ করে। ইয়া বড়ো দাঁড়ি, মোচ। ছাগলের মতো কালো। মুখভর্তি বসন্তের দাগ। বড়ো একটা ভুঁড়ি। খুব একটা লম্বা নয়। সব মিলে দেখতে ভীষণ বিচ্ছিরি। সোনালুর ভেতরে আঁধার ভড়কে প্রচন্ড ভূকম্পনে সবকিছু তছনছ হয়ে যাচ্ছে। আঁধারের ছায়া এখন সমস্ত মুখমন্ডলেও। মমিন সাহেব ওর হাতটা আলতো করে ধরে বলে, ‘ভয় পাচ্ছ?’ উত্তর নেই কোনো। ‘ভয় পেয়ো না। আমি তোমার মতো মানুষ। তোমার ভালো ছাড়া খারাপ করব না। তুমি আমার হৃদয়ের গভীরে অবস্থান করছো। জানি, তুমি কেন ভয় পাচ্ছ! তুমি কেন, বাংলাদেশের সব মেয়ে নিজের যৌনাঙ্গটাকে পৃথিবীর চেয়ে মূল্যবান সম্পদ মনে করে। আর তাদের ধারণা, এটা শুধু স্বামীর সম্পদ। সে ছাড়া অন্য কেউ স্পর্শ করলে পাপ। এটা ভুল ধারণা। শোনো, তুমি মুসলিম। সেইদিক থেকেই বলছি। ইসলামে মুতা বিবাহ নামে এক ধরনের বিবাহ আছে।’
সোনালু এতক্ষণ পর মুখ খোলে। জানতে চায়, ‘সেটা আবার কী?’
‘বিবাহ চুক্তিনামা। একজন নারী ও পুরুষ চুক্তি করে যে, তারা উভয়ে সারা জীবন একত্রে বসবাস করবে জীবনসাথি বা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে। তবে প্রয়োজনে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তারা সে চুক্তি ভঙ্গও করতে পারবে। আরেকটি বিষয় হলো স্বামী-স্ত্রী একটানা তিন মাস আলাদা বসবাস করলে অটোম্যাটিক চুক্তি ভঙ্গ বা তালাক হয়ে যায়। সে হিসাবে তুমি এক বছর যাবৎ স্বামী থেকে আলাদা বসবাস করছ। অতএব তুমি এখন তালাকপ্রাপ্ত।’
সোনালু আঁতকে ওঠে, ‘কী আবোল-তাবোল বলছেন?’
‘আবোল তাবোল বলছি না। যা সত্য তা-ই বলছি। আমি তোমাকে মোতা বিয়ে করব। তাহলে আর কোনো সমস্যা থাকল না।’
সোনালু জানতে চায়, ‘কীভাবে?’
মমিন সাহেব উত্তর দেয়, ‘মুতা বিয়ে এক ঘণ্টার জন্য হতে পারে। আবার ছয় মাস, এক বছর বা যত দিন ইচ্ছা তত দিনের জন্য হতে পারে। বিয়ের সময় বলতে হবে কত সময়ের জন্য।’
যতই যুক্তি দ্বারা বোঝায় তাতে সায় দিতে পারে না সোনালু। বেশ কিছুক্ষণ দুজনে নীরব থাকে। সোনালুর ভেতরে এখন প্রচÐ তাÐব। মমিন নামের লোকটির দিকে ভালোভাবে তাকায় সে। না কোথাও ভালো লাগার কিছু খুঁজে পায় না। বুকের ভেতর তার আর্তনাদ করে ওঠে। ভালো লাগার একটি বিষয় পেয়েছে, সেটা তার বাবা মায়ের জীর্ণ শীর্ণ দুটো মুখ। অবশেষে অনেক ভেবেচিন্তে সে রাজি হয়।
জনতা তাকে বুঝিয়ে দেয় মমিন বন্ধু হবে। বন্ধু হিসেবে বরণ করতে ছোট্ট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। সে অনুষ্ঠানে দুজনে মালাবদল করবে। মালাবদল অনুষ্ঠানের দিন ধার্য করা হয় আগামী রবিবার। রবিবার সন্ধ্যায় মেহমানরা আসতে শুরু করেছে। প্রত্যেক মেহমান জুটি বেঁধে আসছে। কোনো বাচ্চা নেই কারো সঙ্গে। ঘরে মেহমানরা এসে বসে।
সোনালু বলে, ‘জনতা, বিষয়টা কী? সবগুলি মেহমান জুটি বাঁধা। দুজন হাত ধরাধরি করে ভেতরে আসছে। নিশ্চয়ই স্বামী-স্ত্রী।
‘সোনালু, এরা কেউ স্বামী-স্ত্রী নয়। এরা সবাই আমার-তোমার মতো প্রত্যেক জুটিবন্ধ। দুজনের মনের সঙ্গে মিলে গেছে। এই যে সুভাষ আমার বয়ফ্রেন্ড। ও হিন্দু, তাতে কী? আমরা দুজন-দুজনকে ভালোবাসি, এনজয় করি। বাংলাদেশে ওর স্ত্রী-সন্তান আছে। আমারও স্বামী আছে এবং চার বছরের একটা ছেলে আছে। ও আমাকে বিপদে-আপদে সাহায্য করে। ভালোবাসা দেয়। কাস্টমার সংগ্রহ করে দেয়। এ বাসার খরচ ও অর্ধেক দেয়। দুজন একসঙ্গে বসবাস করি। কোনো অসুবিধা নেই। আমি টাকা পাঠাই। আমার স্বামী ব্যবসা করছে, অনেক সম্পদ করেছে। বাচ্চাটা সামনের বছর ভালো স্কুলে দেবে। সব ঠিক আছে। দেখছ না? জুটির মেয়েগুলি টাকার মেশিন আর পুরুষরা হলো অ্যাসিসট্যান্ট। কাস্টমার সংগ্রহ করে দেয়। বিপদ-আপদে সাপোর্ট দেয়। মেয়েরা ওদের সঙ্গে একটু এনজয় করে। আর বিনিময়ে পুরুষদের যা বলে, তা-ই করে।’
এভাবেই শুরু হয় জয়তুন ওরফে সোনালুর আঁধার-জীবন। মমিন আলাদা একটা ফ্ল্যাটে সোনালুকে নিয়ে ওঠে। যন্ত্রের মতো হয়ে গেছে সোনালু।
মনু মিয়ার নামে প্রতি মাসে টাকা আসে। দুই বছরের মধ্যে মনু মিয়ার বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। জমি কিনেছে। সুন্দর বাড়ি করেছে। নাটু মিয়াকে চিকিৎসা করানো হচ্ছে, এখন একটু ভালোর দিকে। উঠে বসতে পারে। ছালেতনকে আর ভিক্ষা করতে হয় না। মাসে মাসে বিদেশ থেকে টাকা আসে। একটা জায়গা কিনে বাড়ি করেছে। হরিপুর গ্রামের মানুষের মধ্যে গুঞ্জন। মনু মিয়া করছে কী রে, একটা কামের কাম করছে। একসময় গ্রামের মানুষ জয়তুনকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলত, এখন উলটো জয়তুনের প্রশংসায় গ্রামের সবাই পঞ্চমুখ। মনু মিয়াকে গ্রামের লোকজন সম্মান করে কথা বলে। সবাই বলাবলি করছে, ‘বউডারে বিদেশ পাঠাইয়া ভাগ্যের চাকা ঘুইরা গেছে।’ সবাই এসে খোঁজ নেয়, জিগ্যেস করে। কেউ কেউ মেয়েকে বিদেশ পাঠানোর জন্য রাস্তাও খোঁজে।
আমেনার মা আয়জান মনু মিয়ার বাড়ি এসে বলে, ‘মনু, আসলাম একটা ব্যাপারে। তোর বউয়ের সাথে তো কথা হয়? তার সাথে একটু আলাপ কর, আমেনারে বিদেশ নেওন যায় কি না?’ > চলবে
‘বুজি, আমি জয়তুনের সাথে বিষয়ডা নিয়া আলোচনা করমু।’
মনু মিয়া ফোনে আমেনার ব্যাপারে কথা বললে সোনালু বলে, ‘তুমি এমন কাজে হাত দিয়ো না। এগুলি ঝামেলার কাজ।’ সোনালু ভাবে, ‘নরকে পুড়ছি, আমিই পুড়ি। জেনেশুনে আরেকটা নিষ্পাপ মেয়েকে নরকে ফেলব না।’
জনতাকে বলে, ‘জনতা, মনু ফোন করছিল। আমার গ্রামে আমেনা নামের একটা মেয়ে বিদেশে আসতে চায়। আমি না করেছি। এই পাপের জগতে আর যেন কেউ না আসে।’
জনতা মনে মনে প্ল্যান করে। এ একটা সুযোগ। মেয়েটিকে আনতেই হবে। জনতা মনু মিয়াকে ফোন করে আমেনার বিষয়টা বলে।
মনু মিয়া জানায়, ‘আপা, ওর মায় আমার মাথা খাইল। প্রতিদিন ঘ্যানর ঘ্যানর করে।’
‘নুরু নামে একজন লোক আপনার বাড়ি যাবে। ওর সাথে কথা বলবেন। ও সব ব্যবস্থা করে দেবে। টাকা লাগবে আশি হাজার।’
পরদিন মনু মিয়ার বাড়ি নুরু আসে। আয়জানের সঙ্গেও কথা বলে। কথাও পাকা।
আমেনা ও পাতা একই বয়সের। দুজনের খুব ভাব। আমেনা খুশিতে তিড়িংবিড়িং করতে করতে পাতার কাছে আসে। বলে, ‘পাতা, আমার বিদেশ যাওয়া পাকা হইছে। মনু মিয়ার বাড়ি নুরু নামে এক দালাল আইছিল। মা তার সাথে কথা কইছে। ট্যাহা পয়সা জোগাড় করতে অইবো। হে কইছে ট্যাহা যত তাড়াতাড়ি দিমু, তত তাড়াতাড়ি যাইতে পারমু। আমার কী যে খুশি লাগতাছে! ঐ দেশে গয়না সস্তা। আমি গাও ভর্তি গয়না পিন্দিমু।’
পাতা বলে, ‘আমেনা, শুন, আমার মাইয়া ব্র্যাক থিকা ঋণ তুলছে। হেই ব্র্যাকের আফা আইজ বাড়িত আসছিল। হে কইল ম্যায়াগো বিদেশ যাইতে ২০ হাজার ট্যাহা নাগে। বাসাবাড়ির কামে অনেক ম্যায়া বিদেশ যাইতাছে। তয় যাওনের আগে ঢাকা যাইয়া ট্রেনিং নিতে হয়। ট্রেনিংয়ে শিখায়, কামকাজ কেমন কইরা করণ লাগব। আরবি ভাষা শিখায়। ম্যায়া মানুষের কত সমস্যা হইতে পারে। কোনো সমস্যা হইলে কেমুন কইরা সমাধান করতে অইব? সবকিছু শিখায়। ট্রেনিং দিয়া বিদেশ গেলে খুব ভালা কইরা কামকাজ করণ যায়। বিপদে পড়লে বাংলাদেশের দূতাবাস অফিসে যোগাযোগ করতে অইবো। সেই দূতাবাসের ঠিকানা, ফোন নাম্বার দিয়া দেয়। ঐ আপার কথা শুইনা আমারও যাইতে ইচ্ছা করতাছে। আপারে কইছিও। হে বারবার কইল বিদেশে যাইতে হইলে ঢাকায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ট্রেনিং দিয়ে যাবে। ট্রেনিং ছাড়া গেলে অনেক সমস্যা হয়। অনেক মেয়ে পাচারকারীর হাতে পড়ে। অনেকে খালি হাতে ফেরত আসে। আমেনা যাওনের আগে ঢাকায় ট্রেনিং নিয়ে যাইস।’
‘কাইলকা দালাল আমাগো বাড়ি আইব। পাসপোর্টের ট্যাহার জুন্যে। তখন ট্রেনিংয়ের কথা কইমু।’
মনু মিয়া মাসে মাসে টাকা পেয়ে ইচ্ছেমতো খরচ করে। এখন তার এক ডজন বন্ধু।
যারা আগে তাকে পাত্তা দিত না। এখন তারা বস বস বলে সম্মান দেখায়। পাড়ার কয়েক জন এসে মনু মিয়াকে নিয়ে জুয়া খেলার আড্ডায় যায়। প্রতিদিন রাতে জুয়া খেলার আড্ডায় না গেলে মনু মিয়ার পেটের ভাত হজম হয় না। নেশা ধরে গেছে। মনু মিয়া নুরুর সঙ্গে আদম ব্যবসায় পুরোপুরি নেমে যায়। একদিকে বউ টাকা পাঠায়, অন্যদিকে আদম ব্যবসায় প্রচুর টাকা রোজগার করে। টাকার অভাব নেই তার। মনু মিয়া এখন স্বেচ্ছাচারী হয়ে গেছে। রূপী তাকে হিট দিয়েছে, বউ নেই কাছে। কাজেই নারী এখন তার কাছে খেলনাস্বরূপ। তার বেশিরভাগ সময় কাটে এখন নারী আর জুয়ার আড্ডায়। তার পরও মনু মিয়া সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করার সাহস কারো নেই। কারণ গ্রামের মধ্যে সে এখন প্রভাবশালী। গ্রাম্য বিচার-সালিশে মনু মিয়ার সিদ্ধান্ত সবার সিদ্ধান্ত।
দালাল নুরু এসে আয়জানের সঙ্গে সঙ্গে পাসপোর্টের ব্যাপারে কথা বলে। আয়জান জানায়, সব ট্যাহা তো জোগাড় করতে পারি নাই।
দালাল প্রশ্ন করে, ‘কত টাকা আছে?’
আয়জান উত্তর দেয়, ‘বাজান, ৭ হাজার ট্যাহার জো করছি। বাকি ৩ হাজার ট্যাকা পরে দিলে অইবো না।’
দালাল বলে, ‘৭ হাজার টাকা দেন। বাকি টাকা আগামী বুধবারের মধ্যে দিতে হবে।’
আমেনা জানতে চায়, ‘বিদেশে যাওনের আগে নাকি ট্রেনিং দিতে হয়? ব্র্যাকের আপায় কইছে, ট্রেনিং না দিয়া গেলে নাকি অনেক বিপদ হয়। তা ছাড়া ট্রেনিং শেষে একটি সার্টিফিকেট দেয়। সেই সার্টিফিকেট ছাড়া ম্যানপাওয়ার হয় না।’
দালাল বলে, ‘এসব আবোল-তাবোল কথা রাখো। এনজিও কর্মীদের তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই, এসব ভুয়া কথা বলে বেড়ায়। কোনো ট্রেনিং লাগবে না। ঢাকায় একটা ভুয়া ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছে, টাকা খাওয়ার জন্য। ঢাকায় গিয়ে ট্রেনিং নিতে চার-পাঁচ হাজার টাকা লাগবে। কোনো দরকার আছে? আমি সব শিখিয়ে দেব।’
আয়জান আমেনাকে বলে, ‘তুই মানুষের কথায় কান দিস না। দালালের চাইয়া ভালা আর কারা জানব? ঐসব বাদ দে। এ বেটা যেইভাবে কইবো, আমি সেইভাবে কাম করমু।’
আয়জান ছাগল নিয়ে মাঠের দিকে যায়। মা-ছাগলের সঙ্গে কালো কুচকুচে ছোটো দুটি ছানা, তিড়িংবিড়ং নাচতে নাচতে যাচ্ছে। রাস্তায় জইনদালির সঙ্গে দেখা হয় আয়জানের। জইন বলে, ‘বুজি, আপনার কাছে যাইবার চাইছিলাম, দেখা হইয়া ভালাই হইল।’
‘কেন গো, ভাই?’
‘শুনলাম, আমেনারে বিদেশ পাঠাইতাছেন?’
‘হ বাজান। কথা তো দিলাম। অখন ৮০ হাজার ট্যাহা জো করতে অইবো। জমিজিরাত তো নাই। ১৫ শতাংশ জমি আছে পূর্ব চহে। ৫০ হাজার ট্যাহা বেইচা দিছি।’
‘বুজি, জমি কিনল কারা।’
‘গেটু মাতবরে। কারণ মাতবর ৫০ হাজার ট্যাহা তো জমি বাবদ দিছে। আর বাকি ট্যাহা ঋণ হিসাবে দিব।’
জইন বলে, ‘এত ট্যাহা ঋণ দিল?’
‘হু বাজান। তয় সুদ দিতে অইবো। তা ছাড়া এত ট্যাহা কারা দিব? আর মাতবর ছাড়া জমি অন্য কেউরে দিলে, আমারে গায়ে বাস করতে দিব? তাই জমিডা মাতবররে দিলাম। অবশ্য মনু মিয়া নিতো চাইছিল। কিন্তু মাতবর চাচা কইল, মনু মিয়া তোর আপন? কোনো দিন তোর পাশে দাঁড়াইছিল? আমি গায়ের সবার বিপদে সাহায্য করি। তোর বিয়ার সময় তোর বাবারে ট্যাহা দেই নাই?’
‘বুজি, নুরু দালাল আস্লে আমারে একটু জানাইবেন। আমি দালালের সঙ্গে একটু কথা কইমু।’
‘জইনদালি, ৩০ হাজার ট্যাহা বাকি রইছে। মাতবর চাচা মঙ্গলবারের মধ্যেই দিবো। দালাল কইছে বুধবার ঐ ট্যাহার জুন্যে আইব। হে আস্লে তোমারে খবর পাঠাইমু। তার আগে মনু মিয়ার লগে কথা কও। মনু মিয়া যদি রাজি থাকে তাইলে বিদেশ যাওন পারবা। মনু মিয়া আর নুরু দালাল একলগে কাম করে।’
জইনদালি রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে। মাথায় তার প্রবাস-ভাবনা। নিজের কিছু সঞ্চয় আছে আর বাকি টাকা ধারদেনা করে জোগাড় করতে পারবে। প্রত্যেক গ্রামেই বিদেশে থাকে, এমন ছেলে অনেক। মেয়েরা বিদেশে যাচ্ছে ইদানীং। জইনদালির এটা পছন্দ নয়। টাকা বেশি লাগবে তবু নিজেই যাবে। অন্যমনস্ক হয়ে সে হাঁটতে থাকে। কোনো দিকেই খেয়াল নেই। স্বপ্নের দেশে বিচরণ করছে সে। প্রতি মাসে ভালো বেতন পাবে। সেই টাকা সঞ্চয় করে কালিহাতী স্বর্ণের দোকান কিনবে। কালিহাতী জায়গা কিনে বাড়ি করবে। মিশিগারি পট্টি থেকে চলে আসবে। তার জীবনটা পুরো বদলে যাবে। হঠাৎ কারো সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে থেমে যায় সে।
‘জইনভাই, চোখ দিয়া দেইখা হাটিছ? ভাগ্য ভালো গাড়ির রাস্তা না। তাই বাঁইচা গেছ।’
জইন অবাক হয়! এ তো দড়ি! অবাক হয়ে সে বলে, ‘দড়ি তুমি! কবে দেশে ফিরছ?’
‘কইল রাইতে ফিরছি, ভাই।’
‘দড়ি, মনে মনে তোমারেই খুঁজছিলাম। হয়তো দুই-এক দিনের মধ্যে তোমাগো বাড়ি যাইতাম। ফোনে কথা কইবার চাইছিলাম। ভালোই হইল তোমার সাথে দেখা হইয়া। আগে কও, বিদেশ গিয়া কেমন সুবিধা করলা? টাকাপয়সা আনছ কেমুন?’
‘জইন, কী যে মাটি খাইছি। দেশে কামলা খাটছি। তাই ভালো আছিল। দুই বছর দোজখে আছিলাম। দোজখ থিকা ছাড়া পাইছি, জান নিয়া ফিরা আইছি, যেটুকু জমি-ভিটা আছিল সব বিক্রি কইরা গেছি। এখন পথের ফকির। আগের যে কামলা আছিলাম এখনো তা-ই। জইন, রাইতে আমার বাড়ি যাইবা। সব কাহিনি কইমু। বাড়িতে কেউ কিছু জানে না। অখন যাই।’
জইন চিন্তায় পড়ে যায়। বিদেশে গিয়ে কতজনে বাড়ি-গাড়ি কত কিছু করেছে। মনু মিয়ার বউ মেয়ে হয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাঠাচ্ছে। আসলে দড়ি সম্ভবত ভালো দালাল ধরে যেতে পারেনি। প্রায় প্রতিদিন মানুষ বিদেশে যাচ্ছে। ভাগ্যেরও ব্যাপার। ভাগ্য ভালো থাকলে ভালো হবে। আর যদি খারাপ থাকে, তবে খারাপ হবে। এ সময় রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল এনজিও কর্মী সাহারা। জইন দেখে সালাম জানালে সাহারা উত্তর দেয়। জইন পাশ কেটে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই সাহারা থামতে বলে। ‘জইন, তোমার বাড়ি থেকে ফিরছি। পানসির কাছে শুনতে পেলাম তুমি বিদেশে যেতে চাইছ?’ জইন খুব বিনীতভাবে হ্যাঁ-সূচক উত্তর জানায়। ‘জইন, বিদেশের খবর জানো। যারা বিদেশে গেছে তাদের অবস্থা কী জানো?’
‘আপা, কত কিছুই তো শুনি। ভালো-মন্দ দুইটাই আছে। সব ভাগ্য।’
‘তোমার কথা মানতে পারলাম না, জইন। “ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না।” কোন দেশে যাওয়ার জন্য চিন্তা করছ?’
‘আপা, মধ্যপ্রাচ্যের যে-কোনো দেশে।’
‘শোনো জইন, মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার অস্থির। গণধরপাকড়ের মুখে হাজার হাজার বাঙালির সোনালি স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। অনিশ্চয়তার মধ্যে তাদের দিন কাটছে। শত শত মানুষ গ্রেফতার হয়ে কারাগারে দুর্বিষহ দিন পার করছে। জীবনের নিরাপত্তা আর নির্যাতন ও গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেকের বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্তে¡ও পুলিশ মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। আরেকটি প্রতারক চক্রকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করছে পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। অনেক লোক লাশ হয়ে ফিরছে। কাজেই আমি পরামর্শ দেব বিদেশ না যাওয়ার জন্য। যদি শ্রমবাজার ভালো হয় তখন জেনেশুনে সঠিকভাবে নিয়মকানুন মেনে যাওয়ার চিন্তা করবে। অনেক কথা হলো জইন, চলি।’
জইন ভারাক্রান্ত মনে নিজের ঘরে ঢোকে। পানসি রোদে ধান নেড়ে দিচ্ছে। মুরগি এসে ধান খায় তাই লম্বা লাঠি হাতে ছায়ায় বসে মুরগি তাড়াচ্ছে সে। আর পুতি ও আমেনার সঙ্গে গল্প করছে। কিছুক্ষণ আগে ওরা এসেছে। হরিপুর থেকে বইলামপুরের দূরত্ব আধা মাইল। ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে আসা যায়। আলোচনার মূল বিষয় আমেনার বিদেশ গমন। পুতির আফসোস। তার সমবয়সি খেলার সাথি আমেনাও স্বপ্নের দেশে যাচ্ছে।
অথচ তার এমন ভাগ্য খারাপ যে, তার যাওয়া হচ্ছে না। কারণ টাকাপয়সা নেই। তা ছাড়া ঋণ নেওয়ার মতো ক্ষমতাও তার মায়ের নেই। আমেনা জানায় যে রূপী জয়তুনকে বিদেশ নিয়েছে, তার মাধ্যমে অনেক মেয়ে বিদেশে যাচ্ছে। তার কারণ মহিলাদের যেতে কম টাকা লাগে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ, সৌদি আরব, দুবাই, বাহরাইন, লেবাননে গৃহপরিচারিকার কাজে বিপুল পরিমাণ নারী বিদেশে যাচ্ছে। দরিদ্র নারীর ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততি রেখে নতুন স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। তিন জনে গল্পে মশগুল। গল্পের এক পর্যায়ে পাতা বলে, ‘বড়ো বু, দুলাভাই সেই যে ঘরে ঢুকল, আর কোনো সাড়াশব্দ নাই!’
‘ঠিক কইছিস পাতা। হে তো এতক্ষণ চুপ কইরা থাকার মানুষ না। মনডা ভার মনে হইল। তোরা বস। আমি ঘরে গিয়া দেখি কী করে। ‘কি গো, এই অসময়ে তুমি শুইয়া রইছ যে? কিছু হইছে?’
পানসির হাত ধরে বসতে বলে জইন, ‘আমার মনডা খারাপ হইয়া গেল। ভাবছিলাম বিদেশে যাইমু।’
‘তা যাইবা। অ বুজছি আমার জুন্যে তোমার মনে কষ্ট লাগতাছে। চিন্তা কইরো না। দেখতে দেখতে সময় কাইটা যাইবো। প্রথম প্রথম কষ্ট অইবো। পরে আস্তে আস্তে ঠিক অইয়া যাইবো।’
‘আরে রাখো তোমার মনে কষ্ট। আমার তো যাওয়া অইব না। পানসি, তোরে ভালা একটা শাড়ি দিতে পারি না। তোরে মনের মতন কইরা সাজাইতে চাইছিলাম রে, তা মনে হয় অইব না। দেখি পশ্চিমপাড়ার দড়ি দেশে ফিরছে। ওর কাছ থিকা ভালা কইরা সব জাইনা নিই। পরে দালালের সাথে কথা কইমু।’
‘আমি পাতার সাথে বিকালে হরিপুর যাইমু। মায় আইবার কইছে।’
‘হু পানসি। আমারেও বারবার কইছে। যাও। আমি রাইতে দড়ির বাড়ি যাইমু। ফিরনের সময় তোমারে নিয়া আইমু।

পানসি বাহিরবাড়ি দাঁড়িয়ে সবুজ মাঠের দিকে তাকায়। দুই গাঁয়ের মাঝে এই সবুজ মাঠটি গহর ও পানসির ভালোবাসার সেতু। তাই মাঠটাকে অনেক আপন বলে মনে হয়। নিয়মের মারপ্যাঁচে পানসি আজ বন্দি। কিন্তু মনকে তো সে বন্দি করতে পারেনি। মনের দুয়ারে গহর আগের মতোই ওড়াউড়ি করে। চোখের দেখা হয় না দুজনের। কিন্তু হৃদয়ের গহিন সাগরে প্রতিনিয়ত ডুবসাঁতার খেলে দুটি হিয়া। হঠাৎ পানসির চোখ আটকে যায় সেই আকাক্সিক্ষত মানবছায়া দেখে। মনের গহিনে যাকে লুকিয়ে রেখেছে, সেই প্রিয় মানুষটিকে বাস্তবে দেখতে পাবে সে! এদিকেই আসছে সে। পুতির কাছে জেনেছে, গহর এদিকে মোটেই আসে না। সামনে এসে দাঁড়ায় হৃদয়ের মানুষটি। গহর বিমুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে পানসির মুখের দিকে। দুজনেই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। লাবণ্যময় বিকেলের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দুজন-দুজনকে দেখতে থাকে। এই প্রথম এমন সামনাসামনি মনের ভাব বিনিময়। পানসির মুখটি আগের চেয়ে আরো উজ্জ্বল। মুখ জুড়ে ঝিলমিল করছে রুপালি চাঁদ। যেন হাজার বছরের রূপকথার রাজকন্যা। বিজন রাতে গহরের ঘরে যে রহস্যময় রমণীর আগমন ঘটে, তার সঙ্গে পানসির হুবহু মিল। গহর বিহŸল হয়ে পড়ে। পানসি লজ্জায় ঘরে ফিরে আসে। গহর মূর্তির মতো সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। আজানের সুর ঘোষণা দেয় সন্ধ্যার। অনেক দিন পর গহর অনেক কাছ থেকে পানসিকে দেখতে পেল। এটাই যেন তার সান্ত¡না।

চাঁদনি রাত। বর্ষাকাল! চারদিকে থইথই পানি। উঠানে পাটি বিছিয়ে তিন বোন আর মা গল্পে মশগুল। ঘুরেফিরে গল্পের মধ্যে জয়তুন ও আমেনার কথা উঠে আসে। চারদিকে রুপালি শামিয়ানা ঝিকমিক করছে। এর মধ্যে মনু মিয়া হাজির হয়। দুধজান মনু মিয়াকে দেখে প্রশ্ন করে, ‘কিগো মনু মিয়া, কিছু কইবা?’
‘হু চাচি, জয়তুন বিদেশ থেইকা ছবি পাঠাইছে। আর পুতি ও পাতার জন্যে একটা মেকআপ বক্স পাঠাইছে। চামুরিয়ার একজন সৌদি থিকা আইছে। তার কাছে পাঠাইছে।’ পুতি তো মহা খুশি।
পাতা মেকআপ বক্স হাতে নিয়ে মনু মিয়াকে বলে, ‘ভাবি আমারে আর পাতারে খুব ভালোবাসে, তার প্রমাণ এই উপহার। মনুভাই, ভাবির ছবি দেখাও।’ মনু ছবিটা পুতির হাতে দিতেই পাতা খপ করে ছিনিয়ে নেয়। ‘আমি আগে দেখি, পুতি আর বড়ো বু পরে দেখবা। ওমা! কী সুন্দর! ভাবিরে সিনেমার নায়িকার মতো লাগতাছে!’
‘মা, পাতার স্বভাবটা পরিবর্তন হইল না। সব সময় বাড়াবাড়ি করে। আমারে দেখবার দেয় না।’
দুধজান পুতির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘থাক মা, সবার ছোটো পাতা। তাই আবদার সব সময় ওর বেশি। মন ভইরা ওরে দেখবার দে। ওর দেখা শেষ হইলে তোরা পরে দেখ।’
দুধজানের মনে প্রশ্ন জাগে, জয়তুন সেই রূপীর মতন ছেলেদের পোশাক পরেছে। কিন্তু সাহস হয় না কিছু বলার। মনু মিয়া এখন হরিপুর গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে ধনী। তার সামনে কথা বলার সাহস কারো নেই।
পুতি ছবিটা পাতার কাছ থেকে কেড়ে নেয়। ‘দে, তোর দেখা শেষ হইছে। অখন আমি দেখুম।’
‘ভাবির অবস্থা দেইখা আমার ভীষণ লোভ লাগতাছে রে পাতা। দালাল যে কইল বিদেশ হইল স্বর্গ। সত্যি সত্যি স্বর্গ। ভাবিরে স্বর্গের হুরপরির মতো লাগতাছে।’
এ কথা শুনে মনু মিয়ার ভেতরে যে খুশির ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে তা তার চেহারাতেই ফুটে ওঠে। যদিও মনু মিয়া টাকাপয়সা অপব্যবহার করে। জুয়া খেলে নারীবাজি করে। গ্রামের সবাই গোপনে সমালোচনা করে। কিন্তু সামনাসামনি কিছু বলতে পারে না।
মনু মিয়া হাসি হাসি মুখে জানতে চায়, ‘পানসি, তোমার স্বামী তো বিদেশ যাইতে চায়। সত্যি সত্যিই যাইবো?’
‘হু ভাই।’
‘জইন আমারে কইছে। আমি তাইলে দালালের সাথে কথা কইমু?’
‘আইজ রাইতে সে দড়িভাইয়ের বাড়ি যাইবো। তার কাছ থিকা বিদেশের ব্যাপারে খবর নিবো,’ জানায় পানসি।
‘আমিও খবর পাইছি। দড়ি কাইল বাড়িতে আইছে। ও নিজেই আমার কাছে আইবো। যাই চাচি।’

‘জইনভাই, চলো বাইরে গিয়া বসি। বাড়িতে সব কথা কওন যাইব না।’ মনের ভেতর একবুক কষ্ট নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে দড়ি। সে তার বিদেশজীবনের বৃত্তান্ত জানায় :
ইরাক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। সুরম্য ভবন আর আধুনিক ডিজাইনে নির্মিত রাস্তাঘাটের বেশিরভাগ ভেঙে গেছে। বাগদাদ, কুর্দিস্তান, নাজাফ আর বসরাÑ সব জায়গার চিত্র ভাঙাচোরা, ছেঁড়াফাটা। ইরাকে পুনর্গঠনের কাজ চলছে। এখানে অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন। ইরাকে এখনো মাঝে মাঝে আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়। এ কারণে ইরাক নিরাপদ নয় বলে বাংলাদেশ সরকার শ্রমিক পাঠানো নিষেধ করেছে। এর পরও একশ্রেণির রিক্রুটিং এজেন্সি দুবাই, কাতার অথবা ওমানে চাকরির লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে ইরাকে লোক পাঠাচ্ছে।
তেমনি বাহাচ নামের এক দালালের খপ্পরে পড়ে দড়ি। তার সঙ্গে আরো সাত জন। এই আট জন না জেনেই প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়। বাহাচের বাড়ি সাগরদীঘি।
বাহাচ জানায়, দুবাই শ্রমিক নিচ্ছে। প্রতি মাসে বেতন ৬০০ ডলার। ওভারটাইম আছে, থাকা-খাওয়া ফ্রি। এত সুযোগ-সুবিধার প্রত্যাশায় দড়িসহ অনেকেই তাড়াহুড়ো করে পাসপোর্ট করার উদ্যোগ নেয়। জমি বিক্রি করে সেই পাসপোর্ট ও অন্যান্য খরচ বাবদ ৩০ হাজার টাকা বাহাচের হাতে তুলে দেয়। মাসখানেক পর বনানীর একটা এজেন্সিতে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মেডিক্যাল পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর দড়িসহ আট জনে প্রত্যেকে ১ লাখ করে টাকা বাহাচকে দিলে সে এজেন্সিতে জমা দেয়।
এক সপ্তাহ পরে তাদের ফ্লাইটের তারিখ ঠিক হয়। সময়মতো ওদেরকে বাহাচ নিজে বিমানবন্দরে নিয়ে যায়। তখন হাতে কাগজপত্র দেওয়া হয়। তাদের পাসপোর্টে ওয়ার্ল্ড ফেমাস ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরস আল-নাহাল ট্রেডিংয়ের সিল দেওয়া হয়। এরপর ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট জমা দেওয়া হয়। দুবাই বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গে জহির নামে এক দালাল ওদের আট জনকে রিসিভ করে।
পাশেই একটি খেজুরবাগানের ভেতর তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। ওদের দেখাশোনা করে লালমোহন নামে একজন। বাহাচ ওদের বলে দিয়েছে, দুবাই বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গে লালমোহন এসে তোমাদের জায়গামতো নিয়ে যাবে। সেখানে এক সপ্তাহ কেটে যায় তাদের শুয়েবসে। এরপর দড়ি জানতে চায়, ‘ভাই কাজ দেন না কেন? আমরা কি এখানেই থাকব? এই খাবার খেয়ে কি থাকা যায়? এতগুলা টাকা দিয়েছি। বাড়ি জমি সব বেচে নিঃস্ব হয়ে গেছি। আইজ সাত দিন হয়ে যায়।’
লালমোহন বলে, ‘মাথা গরম করবেন না। এই কয়দিনে সবকিছুই ঠিকঠাক করেছি। আজ তোমাদের জায়গায় পাঠাব।’
বিকেল ৪টায় ওদের ইরাকের একটা ফ্লাইটে তুলে বলে দেয়, ‘নাজাফ বিমানবন্দরে নামবে। এখানে একজন ড্রাইভার তোমাদের গ্রহণ করবে।’
‘লালমোহনভাই, আমাগো দুবাই কাম দেওয়ার কথা। ইরাকে ক্যান?’
‘এই ব্যাটা চুপ! কথা বললে, ধরা খাবি।’
নাজাফ বিমানবন্দরে নামার পর একটা গাড়ি এসে থামে। তার হাতে ওদের ছবি। ছবি মিলিয়ে একজন একজন করে নাম বলে গাড়িতে তুলে নেয় ওদের। গাড়ি চলছে। রাস্তার বিভিন্ন স্থানে আমেরিকান সৈন্যরা তল্লাশি চালায়। এটা ওদের নিয়ম। নিয়মমতো এক জায়গায় গাড়ি থামানো হয়। আমেরিকান সৈন্যরা তল্লাশি করে। দড়ি ভয়ে জড়সড়ো। তাদের কথা কিছুই বোঝে না সে। কিন্তু চোখমুখের অবস্থা দেখে বুঝতে পারে যে ওদের প্রতি সৈন্যদের খুব রাগ। গাড়ি থেকে নামিয়ে ওদেরকে সৈনিকদের ক্যাম্পে নেওয়া হয়।
একজন মোটামুটি শিক্ষিত। সে ইংরেজি কথা কিছুটা বুঝতে পারে। সে বলে, ‘দড়ি, এতটাকা খরচ কইরা স্বপ্নের দেশে আইলাম। আমরা তো অবৈধ। আমাগো আটক করছে। শয়তান দালাল দুই নম্বরি করছে।’
ঐ ক্যাম্পে সাত দিন থাকার পর এক ইরাকির হাতে তুলে দেওয়া হয় ওদের। ঐ ব্যক্তি এক হোটেল মালিকের কাছে ওদেরকে ২০০ ডলারের বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়। হোটেল মালিক ওদের আট জনকে কাজ ভাগ করে দেয়। দড়ির দায়িত্ব হোটেলের মেঝে পরিষ্কার করা। থাকার ব্যবস্থা ছাদে। কাজ শুরু প্রতিদিন সকাল ৮টার এবং শেষ হয় রাত ১২টায়। হোটেলের বাইরে বের হওয়া নিষেধ। প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে করতে শরীরের অবস্থা কাহিল। টাকাপয়সার বালাই নেই। এর পরও একটু এদিক-সেদিক হলেই মারধর করা হয়।
দড়ি তার বিদেশ-জীবনের ভয়াবহ কষ্টের কথা বলে একটু থামে। তারপর জইনের কাঁধে হাত রেখে করুণ কণ্ঠে বলে, ‘জইন, সাত মাসের কাহিনি, কঠিন সময় পার কইরা আইছি। টাকাও শেষ। শরীরডা শেষ। কোনোদিন আর কোনো ভারী কাজ করতে পারমু না গো।’
দুজনে কিছুক্ষণ নীরব হয়ে বসে থাকে। তারপর দড়ি আবার বলে, ‘আমার কাম আছিল হোটেলের মেঝে পরিষ্কার করা। প্রতিদিন সকল ৮টায় শুরু কইরা রাত ১২টা পর্যন্ত। মালিকের কড়া নিষেধ, হোটেলের বাইরে যাওন যাইব না। প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা কাম কইরা শরীরডা এমনিতেই কাহিল। তারপর আবার একটু কামের হেরফের হইলেই মারধর করত।’ দড়ির চোখ ফেটে জলের ধারা নামে! ‘একদিন ময়দার বস্তা মাথায় নিয়া সিঁড়ি দিয়া উঠতাছি। শরীর দুর্বল, বোঝাটাও ভারী। হঠাৎ মাথা ঘুরাইয়া বস্তাসহ পইড়া গেছি। মালিক আইসা কয়েকটা ঘুসি দিয়া দোতলার সিঁড়ি থেকে নিচতলায় ফালাইল। তখন বুকের মধ্যে এমন আঘাত পাইছি। আজও সেই ব্যথা যায় নাই। ছাদে তিন দিন অজ্ঞান ছিলাম। খুব খারাপ অবস্থা। আমার সাথিরা সেবাযতœ কইরা জ্ঞান ফিরাইছে। চিকিৎসা করায় নাই। একজনের কাছে ব্যথার অষুদ আছিল। তাই খাইয়া একটু কমলো। এক মাস পর বেতন দিল দেড় শ ডলার। আমরা প্রতিবাদ করলে মালিক কইল, বেশি বাড়াবাড়ি করলে তালেবান পরিচয় দিয়া আমেরিকান সৈন্যদের হাতে তুইলা দিব। এইভাবে দুই মাস থাকলাম, আর সহ্য হয় না। আমরা পালাইবার বুদ্ধি করলাম। হোটেলের পাশে নতুন চারতলা বিল্ডিং হইতাছে। আমরা হোটেলের ছাদ থিকা ঐ নতুন বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নাইমা একটা আমেরিকান ক্যাম্পে যাই। যে ছেলে শিক্ষিত। সে ইংরেজিতে সব কথা বলে। তখন আমেরিকান সৈন্যরা আমাগো একটা থানায় পাঠাইল। সেখান থেকে কারাগারে পাঠাইল। ছয় মাস জেল খাটার পর ছাড়া পাইয়া দেশে আইছি।’
দড়ির কষ্টের কথা শুনে জইনের চোখেও পানি আসে। ‘দড়ি, তোর কথা শুইনা মনডা ভাইঙা গেছে। সেদিন এনজিওর আপাও অনেক কথা শুনাইল। না রে, বিদেশ যাইমু না।’
‘জইন, জানি না জীবনে কী পাপ করছিলাম। অখন আমি পথের ফকির। মাথায় বোঝা নিতে পারমু না। আমারে তোমার সাথে কামে নিবা!’
‘দড়ি, আমি মানুষ। তোর কথা শুইনা সহ্য হয় না। কয়দিন বিশ্রাম কর। পরে ধীরেসুস্থে আসিস। অহন ম্যায়ারা দলে দলে বিদেশ যাইতাছে। তাদের কী অবস্থা?’
‘হু, মায়ারা নাকি ভালা করতাছে। আমি তো বিদেশের কিছুই দেখি নাই। সাত মাস বন্দি আছিলাম।’
বিদেশের পোকা জইনের মাথায় ঢুকেছে। নিজে যেহেতু যেতে পারবে না সেহেতু পানসির বিষয়টাই তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। মহিলারা ব্যাপক হারে বিদেশ যাচ্ছে। আশপাশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, পানসিকেই বিদেশে পাঠাবে সে। তাতে টাকাও কম লাগবে। বেতনও ভালো পাবে। তিন বছর বিদেশে থেকে কিছু টাকাপয়সার নিয়ে আসলেই চলবে।

পুতি ও পাতা কাঁঠালগাছে দড়ি বেঁধে ঝুলুনি খেলছিল। ওদের পাশ কেটে কোনো কথা না বলে ভেতরবাড়ির দিকে চলে যায় বিষণœ জইন। অন্যদিন হলে ওদের সঙ্গে হাসি-তামাশা করত। আজ তার মন খারাপ। দুই বোন চিন্তিত হয়ে পড়ে। পুতি ভেতরে যাওয়ার জন্য পাতাকে তাড়া দেয়। বিষয়টা কী জানা দরকার। পাতা সায় দেয়। দুজনেই দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকে। উঠানে টুলের ওপর বসা জইন। পাশে পানসি ও দুধজান। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যে কথা হচ্ছে তা পরিবেশটাই বলে দিচ্ছে।
দুধজান বলে, ‘বাবা জইন, আমি গরিব মানুষ। আমার কোনো ক্ষমতা নাই। তোমাগো সংসার কী করলে ভালা অইবো, তা তোমরা বুইঝা সিদ্ধান্ত নিবা। তোমরা কথা কও,’ বলে দুধজান উঠে যায়। পানসির মুখ ভার।
জইন প্রশ্ন করে পানসির উদ্দেশে, ‘মানুষ কত বড়ো বড়ো স্বপ্ন দেখে। তোমার ইচ্ছা করে না? ভালা একটা ঘর অইবো, জমি অইবো। বড়ো দোকান অইবো।’
পানসির স্বর ভেজা। বিনীতভাবে বলে, ‘আমরা ভালাই তো আছি। পেট ভইরা খাইবার পারি। আর কী চাই গো। আমার মন যে টানে না গো।’ পুতির ভেতর খুশি। পানসির মুখে ‘হ্যাঁ’ শোনার জন্য সে উদ্গ্রীব। পাতা ও পুতি দুজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। পাতা ইশারায় পানসিকে উৎসাহ দেয় ‘হ্যাঁ’ বলার জন্য।
পানসির হাতটা নিজের হাতে নিয়ে অনুনয়-বিনয় করে রাজি হওয়ার জন্য তাড়া দেয় জইন। শেষ পর্যন্ত স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘আমি তোমার স্বামী, স্বামীর কথার অবাধ্য হওয়া মহা পাপ। স্বামীকে খুশি করার জন্য স্ত্রী সব করতে পারে।’ শেষ পর্যন্ত বুকের ভেতর পাথর চাপা দিয়ে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দেয় পানসি। পানসির মতো গরিব ঘরের মেয়েকে স্বামীর কথার বাইরে যাওয়া মানে নিজের এবং পরিবারের সর্বনাশ ডেকে আনা, তাই পানসি আর নিজের সিদ্ধান্তে স্থির হতে পারে না। জইন খুশিতে ছুটে যায় আয়জানের কাছে দালালের খোঁজ নেওয়ার উদ্দেশ্যে।
‘বুজি, পানসিরে বিদেশ পাঠাইবার চিন্তা করতাছি। আমি যাইবার চাইছিলাম। কিন্তু অহন পুরুষ গো সৌদি যাইতে ট্যাহা লাগে ২ লাখ। তা ছাড়া বেতনও তেমন ভালা না। তাই ভাবলাম, পানসিরে পাঠাইতে পারলে ভালা হইত। কিছু ট্যাহা আছে। আর কিছু ঋণ করতে অইবো। আপনি যে দালাল ধরছেন, আমারেও ধরাইয়া দেন।’
আয়জান বলে, ‘আগামী বুধবার আইবো। হে আস্লে তোমারে খবর পাঠাইমো।’
‘বুজি, তাইলে যাই।’

পানসির বিদেশ যায়ার কথা শুনে গহরের ভেতরে বোনা স্বপ্নের ছেঁড়া তার আরো ছিঁড়তে থাকে। কারণ এত দিন সে প্রায়ই ছল করে পানসির বেদনাবিধুর বিষণœ সুন্দর মুখটি দূর থেকে দেখে আসছে। সেই দেখাটাও হিংসুক দানব কেড়ে নেবে? আজ গহরের মনে হচ্ছে সমস্ত রাত্রির নির্ঘুম ভোরে লাল সূর্যটাকে ছিঁড়ে বেদনার বাঁকা ঠোঁটে ঠোঁট রাখে। পরাধীন রোদ ঝিমিয়ে পড়ে উঠানের কোণে। সমস্ত আসমান জুড়ে দুঃস্বপ্নের ধোঁয়া ছেঁয়ে আছে। সে ধোঁয়ায় ক্ষতবিক্ষত গহরের হৃদয়।

‘বড়ো গেদি, জামাই তোরে বিদেশ পাঠাইবার জন্য পাগল হইছে। তয় বিদেশ যাওনের আগে ঢাকায় নাকি ট্রেনিং করতে হয়? জামাইরে খোঁজ নিতে কইবি।’ বলে দুধজান।
‘মাইয়া, দালালরে তোমাগো জামাই ট্রেনিংয়ের কথা কইছে। দালাল কইছে, ট্রেনিংয়ের দরকার নাই। হে তো পাগল হইছে। আমার বিদেশ যাইতে ইচ্ছে করে না। কী করমু? মাইয়া, আমরা তো কাঠের পুতুল, যেদিকে নিবো, হেইদিকেই যাইতে অইবো। হে মাতবরের কাছে থেকে সুদে ৩০ হাজার ট্যাহাও নিছে। সবকিছুই ঠিক। এখন খালি তারিখ পড়ব। আমি আর আমেনা একসাথেই যাইমু।’
পাতা পানসির গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘বড়ো বু, আমার খুব খুশি লাগতাছে। তুমি যাইয়া আমারে নিবা।’
পানসির মুখে মেঘের ঘনঘটা।
পুতি বলে, ‘বড়ো বু, তুমি বেজার ক্যা? বুঝছি, দুলাভাইরে রাইকা যাইতে মন চায় না?’
‘পুতি, যা এইখান থিকা। আমারে একা থাকবার দে।’
পানসির ভেতরের পাঁজর ভেঙে যাচ্ছে। তার বেশি পীড়া হচ্ছে এই ভেবে যে, গহরকে আর দেখতে পারবে না। প্রায়ই গহর তার সামনে এসে চেয়ে থাকত কী আপন মায়াবী চোখে! মনে হচ্ছে তার পাশে কেউ নেই। শুধু অন্ধকার। শুধু ধুলোজমা লতাগুল্মের ভেতরে জীর্ণ হাড় পড়ে আছে। অতন্দ্র দুটো চোখ চেয়ে আছে জীর্ণ-শীর্ণ রুক্ষ হাড়টির দিকে, পানসির চোখ ছেয়ে যায় প্লাবনে।

কয়েক মাস হলো আমেনা-পানসি এক বুক স্বপ্ন নিয়ে উড়াল দিয়েছে স্বপ্নের দেশে। ছয় মাস চলে যায়। আমেনা ও পানসির কোনো খোঁজ নেই। আয়জানের বাড়িতে গেটু মাতবর ঘন ঘন লোক পাঠায় ঋণের টাকার জন্য। আয়জান মাথায় হাত দিয়ে সারাক্ষণ কাঁদে। সে ভেবেছিল, মেয়ে বিদেশ যাওয়ার পরই টাকা পাঠাবে আর সেই টাকা নিয়ে দ্রæত ঋণ শোধ করে দেবে। কিন্তু এ কী হলো! তার মাথার ওপর আসমান টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে।
এদিকে জইনও কাউকে কিছুই বলতে পারে না। লোভ করে পানসিকে বিদেশ পাঠিয়েছে। একা একাই ভাবে, এত সাধের বউটাও গেল, নিজেও পথে বসলাম। জইনের মা শোলাকি এসে বলে, ‘কইছিলাম, বউরে বিদেশ পাঠাইস না। মনুর বউ কাঁড়ি কাঁড়ি ট্যাহা পাঠায় দেইখা তোর লোভ ধরল। আমাগো এইসবের কী দরকার আছিল। ভালাই তো আছিলাম। আমার সংসারটা বানে ভাসাই দিলি। আহা রে, বউটা যাইবার চায় নাই গো। তুই জোর কইরা তারে পাঠাইলি।’
ব্র্যাকের কর্মীর কাছে দুধজান কেঁদে কেঁদে পানসির কথা বললে সে বলে, ‘আমি তো আগেই বলেছিলাম বিদেশ যাওয়ার আগে ট্রেনিং দিয়ে যেতে হবে। দালালরা প্রতারণা করে বিধায় বাংলাদেশ সরকার একটা নিয়ম করছে। সেটা হইল যদি মেয়েরা হাউজমেড হিসেবে বিদেশে যেতে চায় তাদেরকে “হাউজকিপিং” ট্রেনিং করে যেতে হবে। দালালরা জাল কাগজপত্র দিয়ে যাতে না পাঠাতে পারে তার জন্য ট্রেনিং শেষে সার্টিফিকেট দিবে। সেই সার্টিফিকেট ছাড়া ম্যানপাওয়ার করতে পারবে না। তা ছাড়া কাজটাও ভালোভাবে শিখতে পারবে। বিদেশ যাওয়ার নিয়মকানুন সব শিখিয়ে দেবে। এতে দালালদের প্রতারণা খাটবে না। যা শুনলাম, পানসি, আমেনা, জয়তুন হাউজমেড হিসেবে গেছে। হাউজকিপিং সার্টিফিকেট ছাড়া তো হাউজমেড হিসেবে বিদেশে যেতে পারবে না। ওদেরকে নিশ্চয়ই জাল ভিসার মাধ্যমে পাঠিয়েছে। পানসি ও আমেনা কী অবস্থায় আছে সেটা একমাত্র ওপরওয়ালা জানে। আর জয়তুনকে কী কাজে দিয়েছে? হাউজমেড হলে এত টাকা পাঠাতে পারত না সে। এখন আর এসব বলে লাভ নেই। যে দালালের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন, সেই দালালকে ধরেন।’
দুধজান আঁচলে চোখে মুছতে মুছতে বলে, ‘দালাল নিরবুংশা যে ঠিকানা দিছে, হেই ঠিকানায় গিয়া জামাই তারে পায় নাই।’
‘আপনারা দালালের পরিচয় জানেন না! হঠাৎ করে আগমন করল একটা লোক আর তার কথা বিশ্বাস করেই ম্যায়া দিয়ে দিলেন। আপনাদের মতো মূর্খরা এভাবেই মরে। আমার কথা বিশ্বাস হয়নি। দালালের কথা খুব বিশ্বাস করেছেন!’

অমেনাকে জনতার বাসায় তোলা হয়েছে। এমন ঘর আসবাবপত্র সে কোনোদিন দেখেনি।
জনতা আমেনাকে আশ^স্ত করে, ‘আমেনা, তুমি দুখিনী মায়ের একমাত্র মেয়ে। তোমাকে এমন একটা জায়গায় কাজ দেব। সেখানে টাকা ওড়ে। তার আগে এখানে কিছুদিন ট্রেনিং নিতে হবে। বিশ্রাম নাও। আমি খাবার রেডি করছি।’ জনতা চাকু দিয়ে টেবিলের ওপর মাছ কাটতে থাকে।
‘বঁটি কই আফা? আপনি চাকু দিয়া মাছ কাটতাছেন ক্যা?’
‘আমেনা, এদেশে চাকু দিয়ে মাছ, মাংস ও সবজি কাটে। বঁটি দিয়ে নয়।’
‘আফা, চাকু দিয়ে আপনে কী সুন্দর কইরা কাটলেন। কিন্তু আমি তো পারমু না।’
‘মানুষ পারে না, এমন কিছু নেই। তুমি চেষ্টা করো, সব শিখে যাবে।’
জনতা আদা বেøন্ড করার জন্য মেশিন নিয়ে আসে। আমেনা বলে, ‘আফা, পাটা-পুতা দেন। আমি আদা বাইটা দেই।’
‘আমেনা, পাটা-পুতা লাগে না। এইটা বেøন্ডার মেশিন। এই মেশিনেই মিহি হবে তুমি দেখো।’
চুলায় একটা সুইচ মোচড় দেয় জনতা। আমেনা বলে, ‘আফা, কী জাদুর খেলা! মেশিনে কত তাড়াতাড়ি মসলা করলেন। আবার চুলা কী আজব! একা একা আগুন জ্বলতাছে।’
‘আমেনা, এই জন্যই তো এটা স্বর্গরাজ্য। যাও ঘুমিয়ে পড়ো। কাল থেকে আমি যেভাবে যা করতে বলব, তা-ই করবে।’
আমেনা ভোরে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। মনে মনে ভাবে, আমাদের দেশের দিকে তাকালে মায়া লাগে। কিন্তু এই দেশটা কেমুন যেন, চাইলে মায়া লাগে না। এই দেশটা কেমুন রুক্ষ মনে হয়। মায়াদয়া নাই।
জনতা তাড়া দেয়, ‘আমেনা গোসল সেরে নাশতা করে নাও। আজ তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাব। কাজে যোগদান করলে বেড়ানোর আর সুযোগ পাবে না। গোসল সেরে এই ড্রেসটা পরবে। এক সপ্তাহে তোমার বেশ উন্নতি হয়েছে। ভাষা আরো সুন্দর করতে হবে। নিজে সুন্দর সাজগোজ করা শিখবে। বাংলার পাশাপাশি আরবি ভাষাও শিখবে। আর তোমার নাম হবে, শ্রাবণী।
‘আপা, আপনের কথামতো সবই শিখতাছি। কিন্তু এই গেঞ্জি আর প্যান্ট পরতে পারব না!’
‘শ্রাবণী, অসুবিধা কী? বোরকা পরা থাকবে তো।’
‘আপা, তাইলে ঠিক আছে।’
‘শ্রাবণী ভুল হয়েছে। তাইলে না, তাহলে।’
‘ঠিক আছে আপা আর ভুল হবে না।’
রাস্তায় বের হবে, এমন সময় জনতা বলে, ‘ইস, পেটটা কী ব্যথা! আমার যাওয়া হবে না। শ্রাবণী, তুমি সুভাষের সাথে যাও।’
‘না আপা। তাহলে আমিও যাব না।’
‘শ্রাবণী, তোমাকে যেতেই হবে। দু-এক দিনের মধ্যেই তোমার ইন্টারভিউ হবে। ইন্টারভিইতে পাশ করতে হলে তোমাকে আজ যেতেই হবে। কিছু জিনিস আছে জানতে হবে। সুভাষের সাথে যেতে অসুবিধা আছে?’
‘তা না আপা, আপনাকে ছাড়া ভালো লাগে না।’
‘শ্রাবণী, তোমাকে একাই কাজ করতে হবে। কাজেই অভ্যাস করো।’

সুভাষ গাড়ি ড্রাইভ করছে। পাশে শ্রাবণী বসা। গাড়ি চলছে। কোথাও বড়ো গাছ নেই।
ছোটো ছোটো গাছ, বালি আর পথের ভ‚মি। জায়গায় জায়গায় উন্নত মানের যাত্রীছাউনি।
সুভাষ একটি টার্মিনালে গাড়ি পার্ক করে। কয়েকটা বোরকা পরা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কেউ কারো সঙ্গে কোনো কথা বলে না। কিছুক্ষণ পরপর ট্যাক্সি এসে থামে আর মেয়েদের সঙ্গে কী যেন বলাবলি করে।
তারপর গাড়ির দরজা খুলে দিলে মেয়েটা ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসে।
‘সুভাষদা, এইটা কী? মেয়েরা এমন করে দাঁড়িয়ে থাকে কেন? আবার দু-একজন ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলার পরে গাড়িতে করে চলেও যাচ্ছে। আবার কোনো মেয়ে কথা বলার পরও যায় না। কেন?’
‘শ্রাবণী, এখানে যে মেয়েগুলি দেখছ সবাই দেহ বিক্রেতা। দাম করে চুক্তি করে। যার দামে বনে সে চলে যায়।’
‘দাদা, ওদের নিয়ে যায় কোথায়?’
‘ওদের সুবিধামতো নিরিবিলি জায়গায়। শ্রাবণী, তোমাকে একটা সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাব এখন।’
একটি বড়ো গেটের সামনে গাড়ি পার্ক করে সুভাষ। গেটে লেখা দম্পতি বিনা গেটে প্রবেশ নিষেধ। সুভাষ কাউন্টার থেকে দুটি টিকিট কিনে ভিতরে ঢোকে।
‘সুভাষদা, এত বড়ো বাগান! কিন্তু জঙ্গলের গাছ ছোটো ছোটো ঝোপের মতো কেন?’ শ্রাবণী অবাক হয়ে দেখে। গেট দিয়ে প্রবেশ করছে হাত ধরাধরি করে অনেক জুটি। জঙ্গলটি কৃত্রিম। প্রতিটি ঝোপের গোড়া পরিষ্কার করে দম্পতিদের বসার আসন তৈরি করেছে। আবার কো