নোনা ইলিশের চাহিদা বেশি, সরবরাহ কম

534

রূপালী ইলিশের পাশাপাশি নোনা ইলিশের চাহিদাও ব্যাপক। বিশেষ করে চট্টগ্রামবাসীর পছন্দের তালিকায় শীর্ষে এ মাছ। নগরীর আছাদগঞ্জ শুঁটকি পল্লীতে নোনা ইলিশের চাহিদা প্রচুর হলেও সরবরাহ খুবই কম। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার পিস। তাছাড়া অন্যান্য দিন বিক্রি হয় দুই থেকে আড়াই হাজার।
নগরীর কাট্টলি সমুদ্রতীরে রাসমনি ঘাট এলাকায় লবণ দিয়ে ইলিশ সংরক্ষণ করা হলেও আছাদগঞ্জের শুঁটকি পল্লীর নোনা ইলিশগুলো আসে পটুয়াখালীর কলাপাড়া এবং বরগুনার পাথরঘাটা থেকে। মৎস্য ব্যবসায়ীরা প্রতি বছর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের দিকে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করেন। এসব ইলিশ পাঁচ থেকে ছয় মাস ওই অবস্থায় রেখে তারপর এক বছর পর্যন্ত বিক্রি করা যায়। অনেক বছর ধরেই এ প্রক্রিয়ায় মৎস্য ব্যবসায়ীরা ইলিশ সংরক্ষণ করছেন বলে জানালেন আছাদগঞ্জ শুঁটকি আড়তদাররা।
সরেজমিনে আছাদগঞ্জ শুঁটকি পল্লীতে দেখা যায়, প্রায় এক থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ মাছগুলোকে গুদামে ঝুড়ির মধ্যে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে। প্রতি ঝুড়িতে মাছ থাকে ২০০ থেকে ৩০০টি।
একজন পাইকারী ব্যবসায়ী নোনা ইলিশগুলো দেখে দাম জানতে চাইলে আড়তদার বললেন ১০০ পিস ২০ হাজার টাকা। তখন পাইকারী ব্যবসায়ী বললেন, ১০ হাজার হবে না? আড়তদার বলেন, না।
তখন পাইকারী ব্যবসায়ী অনেক দর কষাকষি করার পর ১৫ হাজার টাকায় গিয়ে থামলেন। এতে স্পষ্ট হয়, ওই বড় সাইজের ইলিশগুলো প্রতিটির দাম পড়েছে ১৫০ টাকা। সেগুলো খুচরা ব্যবসায়ীর কাছে যেতে যেতে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা আর ভোক্তা পর্যায়ে যেতে প্রতি পিসের দাম পড়বে ২৫০ টাকায়।
আড়তদার বাপ্পী বড়ুয়ার সাথে কথা বলে জানা যায়, পটুয়াখালী এবং বরগুনা থেকে কাভার্ডভ্যানে করে ঝুড়িতে করে আনা হয় এসব নোনা ইলিশ। প্রতি ঝুড়িতে মাছ থাকে ২০০ থেকে ৩০০টি। প্রত্যেকটি যত দামে বিক্রি হবে, তার এক একটির কমিশন পাবে আড়তদাররা। অর্থাৎ প্রতি পিস নোনা ইলিশে তিন থেকে পাঁচ টাকা করে কমিশন পাওয়া যায়, সুতরাং প্রতি একশ পিস ইলিশে ৫০০ টাকা করে পাওয়া যায়।
মেসার্স আবুল হাশেম সওদাগরের স্বত্বাধিকারী মো. হোসেন (খোকন) বলেন, বরিশাল, পটুয়াখালী এবং বরগুনার মৎস্যজীবীরা ছোট-বড় আকারের ইলিশ লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে থাকেন। কারণ তাদের এলাকায় সমুদ্রের আশেপাশে কোন বরফকল নেই। যার কারণে বড় বড় ইলিশ মাছ জালে ধরা পড়া সত্তে¡ও বিক্রি করতে পারেন না। আবার দূরে পাঠাতে গেলেও মাছগুলো পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে এসব চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন আড়তদারদের কাছে পাঠান।
আছাদগঞ্জের শুটকি পল্লী থেকে কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, ফেনী ও কুমিল্লাসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় এসব মাছ সরবরাহ করা হয়। এছাড়া দেশের চাহিদা মিটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশেও নোনা ইলিশ রপ্তানি করা হয় বলে জানান মৎস্য ব্যবসায়ীরা।
পাইকারী ব্যবসায়ী নিমাই লাল দাশ বলেন, আমরা আড়তদারদের কাছ থেকে প্রতি একশ পিস নোনা ইলিশ কিনলে, সেখানে তিন থেকে চারটি মাছ কাটা এবং ছেড়া পড়ে। তাই আড়তদাররা আমাদেরকে প্রতি ১০০ পিসের মধ্যে ৯৫টি নোনা ইলিশের দাম বরাবর রাখলেও বাকি পাঁচটির দাম ধরেন অর্ধেক। সুতরাং আমাদের আর তেমন লস হয় না।
আছাদগঞ্জ শুঁটকি ব্যবসায়ী আড়তদার সমিতির সভাপতি হাজী মো. ইব্রাহিম বলেন, বাজারে নোনা ইলিশের চাহিদা প্রচুর রয়েছে। যতটুকু চাহিদা ততটুকু সরবরাহ নেই। তবে শুঁটকি বাজারে নোনা ইলিশের পাশাপাশি অন্যান্য শুঁটকিরও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পুরো আছাদগঞ্জ শুঁটকি পল্লীতে সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবারে ২০ থেকে ২৫ হাজার পিস নোনা ইলিশ বিক্রি হয়। তাছাড়া অন্যান্য দিন দুই থেকে আড়াই হাজার পিস বিক্রি হয়।
শুটকি বা নোনা ইলিশে কীটনাশক ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এক সময় নোনা ইলিশ এবং অন্যান্য শুঁটকিতে কীটনাশক বা পাউডার ব্যবহৃত হতো। তবে এখন প্রশাসনের ভয়ে ব্যবহার করা হয় না। আর আমাদের সমিতি থেকে কড়া নির্দেশনা রয়েছে, যাতে শুঁটকি বা নোনা ইলিশে কৃত্রিম রং বা কীটনাশক না মেশায়। আমরাও মানুষকে বিষ খাওয়াতে চাই না।
তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লবণ দিয়ে ইলিশ সংরক্ষণের কারণে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ দেখা দেয়। যার কারণে ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা থেকে শুরু করে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।
এদিকে সঠিক নিয়মে সংরক্ষণ করা না গেলে লবণাক্ত ইলিশ মানবদেহের জন্য অনেক ক্ষতিকর বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী। তিনি বলেন, নোনা ইলিশ সংরক্ষণের পাঁচ থেকে ছয় মাস পর খেলে তা থেকে পেটের অসুখ, ডায়রিয়াসহ চর্মরোগ হতে পারে। এছাড়া যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের জন্যও নোনা ইলিশ ক্ষতিকারক। জনসাধারণের প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে, যতদিন টাটকা ইলিশ আছে সেটি খান। নোনা ইলিশে অনেক মৎস্যজীবী বেশিদিন টিকিয়ে রাখার জন্য নানা কেমিক্যাল ব্যবহার করেন। যেটি সহজে আমরা বুঝি না। পরে আমরা নানা অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হয়ে পড়ি।
উল্লেখ্য, এক সময় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ নোনা ইলিশ খেতো। এখন উপকূলীয় বাদে অন্যান্য অঞ্চলের মানুষেরও প্রিয় হয়ে উঠেছে। যদিও বর্তমান বর্ষা মৌসুমে বাজারে প্রচুর ইলিশের চাহিদা থাকায় নোনা ইলিশের চাহিদা নেই। শীতকালে এর চাহিদা বাড়তে থাকে। লাউ ও মিষ্টি কুমড়া পাতা দিয়ে মুড়িয়ে রান্না করে এটি পরিবেশন করা হয়। তাছাড়া নোনা ইলিশের ভাজি, ভুনাসহ নানা পদের রেসিপি তৈরি করা হয়ে থাকে।