নির্বাচনী প্রচারণা তুঙ্গে

120

আর মাত্র ৮ দিন পরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রচারণা চলবে আরও এক সপ্তাহ। প্রার্থী-কর্মী কারো চোখে ঘুম নেই। ছুটছেনতো ছুটছেন। দম ফেলার ফুরসৎ নেই কারো। চলছে ক্লান্তিহীন প্রচারণা। বিশেষ করে নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীরা চষে বেড়াচ্ছেন এলাকা। শীত উপেক্ষা করে গভীর রাত পর্যন্ত ভোটারের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। চাইছেন ভোট। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা তাদের প্রার্থীর পক্ষে একাট্টা। তবে প্রচারণায় এগিয়ে আওয়ামী লীগ। বিএনপি অনেকটা পিছিয়ে। গতকাল বৃহস্পতিবার নৌকার পক্ষে ভোট চাইতে মাঠে নেমেছেন এক ঝাঁক তারকা। তারা বিভিন্ন এলাকায় গেছেন। উৎসুক মানুষ ভিড় করেছেন তাদের দেখতে।
দিন যতই যাচ্ছে প্রচারণার গতি ততই বাড়ছে। সভা-সমাবেশ, পথসভা-উঠান বৈঠক, মাইকিং, গণসংযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রার্থীরা। তাদের পাশাপাশি নেতাকর্মীরাও নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আবারো আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা দরকার। বিএনপি জোট ক্ষমতা আসলে দেশে আবারো জঙ্গি উত্থান হবে। বিএনপি নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগের আমলে দুর্নীতি-লুটপাট হয়েছে। দেশে আইনের শাসন নেই।
সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর তিনটি আসনের মধ্যে চট্টগ্রাম-৯ আসনে প্রচারণা চলছে বেশি। আওয়ামী লীগ প্রার্থী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ছুটে চলেছেন নেতাকর্মীদের নিয়ে। বিএনপি’র ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বাকলিয়ায় প্রতিদিনই যাচ্ছেন। বৈঠক করছেন নেতাকর্মীদের সাথে। সংখ্যালঘুদের সঙ্গেও একের পর এক বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন তিনি। তার পক্ষে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ছাত্রলীগ নেতারাও প্রচারণা চালাচ্ছেন। তারা প্রতিটি ওয়ার্রের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। বিশেষ করে নারী ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন নেতা-কর্মীরা। দিচ্ছেন এলাকার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি । বিএনপি প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন জেলে আটক থাকায় প্রচারণায় অংশ নিতে পারছেন না। তার পক্ষ হয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। তারা দলবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ডে যাচ্ছেন। ধানের শীষে ভোট প্রার্থনা করছেন।
চট্টগ্রাম-১০ আসনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির দুজনই হেভিওয়েট প্রার্থী। এ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাবেক মন্ত্রী ডা. আফসারুল আমিন ও বিএনপি প্রার্থী সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান।
ডা. আফসারুল আমিন দিন রাত সমানতালে প্রচারণা চালাচ্ছেন। নেতাকর্মীরা জানান, আফসারুল আমিন ভোরেই ঘর থেকে বের হয়ে যান। ফিরেন গভীর রাতে। নির্বাচনী এলাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাচ্ছেন। সাথে থাকছেন শতাধিক নেতাকর্মী। নেতাকর্মীরাও প্রচারণা চালাচ্ছেন।
অপরদিকে বিএনপি প্রার্থী আবদুল্লাহ আল নোমানও কম যান না। তিনিও ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাসা থেকে ভোরেই বের হয়ে যান নেতাকর্মীদের নিয়ে। মামলা-গ্রেপ্তারের ভয় উপেক্ষা করেই প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন নেতাকর্মীরা।
চট্টগ্রাম-১১ আসনেও একই অবস্থা। আওয়ামী লীগ প্রার্থী বর্তমান সাংসদ এম এ লতিফ ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন। বিশেষ করে পোশাককর্মীদের কাছে বার বার যাচ্ছেন। সভা-গণসংযোগ করছেন। এলাকায় আরো উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
একই আসনে বিএনপি প্রার্থী সাবকে মন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীও সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। তার পক্ষে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন এলাকায় পথসভা-গণসংযোগ করে ভোট চাইছেন ধানের শীষ মার্কায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ তিনটি ছাড়াও বাকি ১৩ আসনেও একই অবস্থা। চট্টগ্রাম-১ মিরসরাই আসনে গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে পথসভাও করেন। তার পক্ষে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এ আসনে বিএনপি প্রার্থী নুরুল আমিনও প্রচারণা চালাচ্ছেন। দলীয় নেতারা তার সঙ্গে থাকছেন।
চট্টগ্রাম-৮ চান্দগাঁও-বোয়ালখালী আসনে মহাজোট প্রার্থী মইন উদ্দিন খান বাদল, বিএনপি প্রার্থী আবু সুফিয়ানও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এছাড়া রাউজান আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী, সীতাকুন্ড আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী দিদারুল আলম, বিএনপি প্রার্থী ইসহাক কাদের চৌধুরী, ফটিকছড়িতে মহাজোটের সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, বিএনপির আজিম উল্লাহ বাহার, স্বতন্ত্র প্রার্থী এটিএম পেয়ারুল ইসলাম, হাটহাজারীতে মহাজোটের ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ২০ দলীয় জোটের মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম, রাঙ্গুনিয়া আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ড. হাছান মাহমুদ, ২০ দলীয় জোট প্রার্থী নুরুল আলম প্রচারণা চালাচ্ছেন। আনোয়ারায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, বিএনপি প্রার্থী সরোয়ার জামাল নিজাম, পটিয়ায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সাংসদ শামসুল হক চৌধুরী, বিএনপি প্রার্থী এনামুল হক এনাম, চন্দনাইশে ২০ দলীয় জোট প্রার্থী কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, আওয়ামী লীগ প্রার্থী বর্তমান সাংসদ নজরুল ইসলাম, সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নদভী, জোট প্রার্থী জামায়াত নেতা আ ন ম শামসুল ইসলাম প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
নৌকার পক্ষে মাঠে তারকারা :
নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়ে প্রচারণায় নেমেছেন একঝাঁক তারকা অভিনয় শিল্পী। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে ট্রাকে চড়ে তারা প্রচারণা শুরু করেন। নৌকা মার্কায় ভোট চেয়ে তারা গেছেন নগরীর বিভিন্ন এলাকায়। এ সময় সেখানে বক্তব্য দেন রাঙ্গুনিয়ার আওয়ামী লীগ প্রার্থী ড. হাছান মাহমুদ। উপস্থিত ছিলেন কোতোয়ালী আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম।
তারকারা আসবেন এ খবর শুনেই প্রেস ক্লাবের সামনে সকাল থেকে মানুষের ভিড় জমে যায়। কল্পনার জগতের তারকারা যখন এলেন সাধারণের মাঝে, ভিড় যেন আর সামলানোই যায় না! জামালখানে একপাশের সড়কে গাড়ি চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কেউ দূরে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখেছেন স্বপ্নের নায়ক-নায়িকাদের। আর সেলফি প্রতিযোগিতা তো ছিলই!
অভিনয় তারকা রিয়াজ-ফেরদৌসও এসেছিলেন নৌকার প্রচারণায়। রিয়াজ এসেই ‘নৌকা নৌকা’ বলে স্লোগান ধরেন। অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ, শাহরিয়ার নাজিম জয়, সায়মন সাদিক, শাকিল খানরাও ছিলেন তাদের সঙ্গে।
আশি-নব্বই দশকে যার অভিনয় দেখে বাঙালি রমণীদের চোখের কোণে জল জমতো, সেই অরুণা বিশ্বাসও ছিলেন নৌকার প্রচারণায়। এসেছিলেন হাল আমলের জনপ্রিয় অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতিও। অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী, তারিন, তানভীন সুইটি, বিজরী বরকতউল্লাহসহ আরও কয়েকজন ছিলেন এই যাত্রায়।
শুরুতে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বক্তব্য রাখেন। রিয়াজ সমবেতদের উদ্দেশে বলেন, ‘মায়ের কোলে শিশু যেমন নিরাপদ, তেমনি শেখ হাসিনার কাছে বাংলাদেশ নিরাপদ। আমরা একঝাঁক তরুণ শিল্পী আপনাদের কাছে এসেছি একটাই আবেদন জানাতে আপনারা শেখ হাসিনার কাছেই বাংলাদেশটাকে রাখবেন। এই দেশ নিরাপদে থাকবে, আপনারা নিরাপদে থাকবেন।’
অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি বলেন, ‘এই বীর চট্টলায় আসতে পেরে আমরা শিল্পীরা অনেক খুশি। চট্টগ্রামের উন্নয়নের বেশিরভাগই হয়েছে জননেত্রী শেখ হাসিনার আমলে। এই দেশের উন্নয়ন হয়েছে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে। সুতরাং উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে শেখ হাসিনাকেই আবারও প্রধানমন্ত্রী করতে হবে। নৌকায় ভোট দিতে হবে।’
অভিনেত্রী অরু বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা যেখানেই যাচ্ছি নৌকার পক্ষে জোয়ার দেখতে পাচ্ছি। সারাদেশে নৌকার পক্ষে গণজোয়ার উঠেছে। দেশের ৯০ শতাংশ শিল্পী, আমরা নৌকার পক্ষে আছি। জনতাও নৌকার পক্ষে আছে।’
ফেরদৌস বলেন, ‘সারাদেশে, জেলায়-জেলায়, গ্রামে-গ্রামে জনউচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে এখন একটাই স্লোগান, নৌকা, এই মার্কা জনগণের মার্কা।
রোকেয়া প্রাচী বলেন, ‘এই চট্টগ্রাম থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা হয়েছিল। এই চট্টগ্রাম বীর চট্টগ্রাম। ৩০ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের মানুষ নৌকার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাবে, এই বিশ্বাস আমাদের আছে।’
তারিন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুঁড়ির অপবাদ থেকে মুক্ত করেছেন। আমরা সবাই চাই দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাক। আসুন, আমরা সবাই শপথ নিই, ৩০ ডিসেম্বর আমরা সবাই নৌকা মার্কায় ভোট দেব।’
শাকিল খান বলেন, ‘উন্নয়ন মানে নৌকা। আমি বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিকল্প কাউকে দেখি না। আমরা শিল্পীসমাজ, আমরা শেখ হাসিনার হাত ধরে অনেক দূর এগিয়ে যেতে চাই।’
ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘১৯৭০ সালে দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক-অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যেভাবে নৌকার পক্ষে রাস্তায় নেমে গিয়েছিল, এখনো সেভাবেই সবাই নেমে গেছেন। নৌকার পক্ষে সারাদেশে গণজোয়ার তৈরি হয়েছে। আগামী নির্বাচনে সত্তরের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে।’
মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘আজ শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছেন বলেই দেশে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এ জন্য দেশের শিল্পীসমাজ আজ শেখ হাসিনার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, এবার নৌকার জয় হবেই।’
জামালখান থেকে প্রচারণা শুরুর পর তারা নগরীর অর্ধশতাধিক স্পটে গেছেন। এর মধ্যে রয়েছে, চেরাগী মোড় হয়ে মোমিন রোড, আন্দরকিল্লা, সিরাজদৌল্লা রোড, সাব এরিয়া, চন্দনপুরা, চকবাজার, কাপাসগোলা, বহদ্দারহাট মোড়, চান্দগাঁও, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, মোহরা, কালুরঘাট, অক্সিজেন কুয়াইশ সড়ক হয়ে অক্সিজেন মোড়, মুরাদপুর মোড়, ২নং গেট, জিইসি মোড়, ওয়াসা মোড়, লালখান বাজার, টাইগার পাস, দেওয়ানহাট, চৌমুহনী, বাদামতলী, আগ্রাবাদ মোড়, বারেক বিল্ডিং মোড়, ৩নং ফকিরহাট মোড়, সল্টগোলা ক্রসিং, ইপিজেড মোড়, বন্দরটিলা, স্টিল মিল ও কাঠগড়।
এসব স্পটে গাড়ি থামিয়ে তারকারা সাধারণ মানুষের হাতে লিফলেট তুলে দিয়ে নৌকা মার্কায় ভোট চেয়েছেন। এর আগে বুধবার সড়কপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসেন তারকা শিল্পীরা। আসার পথে বিভিন্ন জেলা শহরে তারা প্রচারণায় অংশ নেন।