প্রতিবেশির হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলো ৯ বছর বয়সী রাকিব (ছদ্মনাম)। এরপর থেকেই তার আচরণ অস্বাভাবিক হয়ে যায়। সারাদিন চুপচাপ থাকে। অপরিচিত কাউকে দেখলেই ভয় পায়। ঘটনার তিন মাস পর রাকিবের বাবার সঙ্গে যখন কথা হয়, তখনো তার চিকিৎসা চলছিলো। রাকিবের বাবা বলছিলেন, তার আরেকটি কন্যা সন্তান আছে। যাকে নিয়ে তার পরিবার সবসময়ই সচেতন থাকতো।
কিন্তু তার ছেলেরও যে বিপদ হতে পারে সে বিষয়ে কোনো ধারণাই ছিলো না তার। তিনি বলেন, ‘ঘটনার দিন আমার ছেলেটাকে এক প্রতিবেশি তার বাড়িতে ডাইকা নিয়া যায়। আমরা জানতাম না। লোকটা তারে খাবারের লোভ দেখাইছিলো। সারাদিন ছেলেটার কোনো খোঁজ পাই নাই। সন্ধ্যায় যখন ছেলেটা বাড়িতে আইলো তখন কেমন জানি করতেছিলো। চুপচাপ ছিলো। কিন্তু ওর প্যান্টের পিছনে রক্ত দেখে সন্দেহ হয় ওর নানির। ওরে আমরা জিগাইছি কি হইছে? কোনো কথা বলে না। পরে যখন মাইরের ভয় দেখাইছে, তখন সে নির্যাতনের কথা কইছে। লোকটা ওরে মাইরা ফেলার ডর দেখাইছে। সেইজন্যে সে কথা কইতে চায় নাই। কিন্তু আমরা ওর প্যান্টে রক্ত দেইখ্যাই ঘটনা বুঝতে পারছিলাম’।
এই ঘটনায় রাকিবের পরিবার থানায় একটি মামলা করেছিলো। গ্রেপ্তার করা হয়েছে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে। রাকিবের (ছদ্মনাম) বাবা বলছেন, তার ছেলে সন্তান যে কোনো পুরুষ দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে সে বিষয়টি কখনোই তার ধারণায় ছিলো না।
কিন্তু এরকম অনেক যৌন নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের ঘটনায় মামলা দায়ের হওয়া দূরে থাক অনেক সময় ঘটনা প্রকাশই হয় না। এরকমই একজন সুমন আহমেদ (ছদ্মনাম)। ১৪ বছর বয়সে যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও পরবর্তী ১৫ বছর ধরে সে ঘটনা তিনি গোপনেই রেখেছেন। তিনি জানান, ‘আমার বয়স তখন ১৪ বছর। বেড়াতে গিয়েছিলাম কাজিনের বাসায়। সেখানে রাতে আমাকে থাকতে দেয়া হয় আমার চেয়ে ১৫ বছরের বড় একজনের সঙ্গে। রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়, দেখতে পাই ফিজিক্যালি আমি তার পুরো কন্ট্রোলে। সে প্রচন্ড জোরে কিস করছিলো, শরীরের বিভিন্ন অংশে টাচ করছিলো। আমি চেষ্টা করেও তার কব্জা থেকে বের হতে পারছিলাম না। ভয়ে আমি কোনো চিৎকারও করতে পারিনি। এই ঘটনার কথা আমি কখনোই কাউকে বলিনি। আমার বা তার পরিবারকেও না। কারণ, পরিবারে তার একটা ভালো অবস্থান ছিলো। আর এ ধরণের ঘটনা যে ঘটতে পারে বা ঘটলে কি করতে হবে সে বিষয়েও আমার কোনো ধারণা ছিলো না’। খবর বিবিসি বাংলার
বাংলাদেশে এরকম ছেলেশিশুর উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা বিভিন্ন সময়ই শোনা যায়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের হিসেবে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১১ জন ছেলেশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে সংখ্যাটি ছিলো ৯ জন। আর ২০১৭ সালে ১৫ জন।
কিন্তু বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ বলেই মনে করে শিশু অধিকার সংগঠনগুলো। বেসরকারি শিশু সংগঠন ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’র নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা মনে করেন, বাংলাদেশে সামাজিকভাবেই ছেলে শিশুদের যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের বিষয়ে একধরণের নিরবতা কিংবা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা আছে। বাংলাদেশে ছেলেশিশুদের উপরও যে যৌন নির্যাতন হয়, সেটাই তো আমাদের সমাজ এখনো গ্রহণ করতে পারেনি। এখানে পথশিশুরা নির্যাতনের শিকার হয়, আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এধরণের ঘটনা আমরা পেয়েছি। তবে সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতনের ঘটনা হয় পরিবারে। কারণ, সেখানে অপরাধীদের জন্য শিশুদের কাছে পাওয়াটা সহজ। ছেলেশিশুদের কাছে পাওয়াটা আরো সহজ। আমরা এখনো শুধু মেয়েশিশুদের নিয়েই সচেতন, ছেলেশিশুর যৌন নিরাপত্তা আমাদের মাথাতেই নেই। এমনকি এরকম ঘটনা ঘটলেও সেটা গোপন করার প্রবণতা বেশি’।
ছেলেশিশু ধর্ষণের মামলা কোন আইনে?
রাকিবের বাবা তার ছেলেশিশুর ধর্ষণের ঘটনায় থানায় যে মামলাটি করেছিলেন সে মামলাটি দায়ের হয়েছিলো দন্ডবিধির-৩৭৭ ধারায়। অথচ মামলাটি হওয়ার কথা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। কারণ ৩৭৭ ধারায় শিশুর উপর যৌন নির্যাতনের বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই। ধারাটি মূলত: প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে স্বেচ্ছায় যৌন সঙ্গম বা সমকামিতার অপরাধ বিষয়ে। গত কয়েকমাসে এরকম আরো দু’টি ছেলেশিশু ধর্ষণের ঘটনায় কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের দু’টি থানায় খোঁজ-খবর নেয়া হয়। দেখা যায়, দু’টি থানাতেই মামলা দায়ের হয়েছে দন্ডবিধি’র ৩৭৭ ধারায়।
কিন্তু শিশু ধর্ষণের অপরাধের মামলা কিভাবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে না হয়ে দন্ডবিধি’র ৩৭৭ ধারায় হচ্ছে এমন প্রশ্নে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র মো. সোহেল রানা বলেন, অসাবধানতাবশতঃ এমনটা হচ্ছে। তবে এ ধরণের মামলার সংখ্যা খুবই কম।
তিনি বলেন, ‘২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন হওয়ার আগে ছেলে শিশু ধর্ষণ বা নির্যাতনের ঘটনায় মামলা দায়ের হতো দন্ডবিধিতে। দীর্ঘদিনের প্রচলিত রীতির কারণে কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তা অসাবধানতাবশতঃ এখনো দন্ডবিধিতেই মামলা নিচ্ছেন। তবে এ ধরণের ঘটনা খুবই কম। এবং অভিযোগপত্র তৈরির সময় এই ভুল সংশোধন করা হয়’।
ধর্ষণের সংজ্ঞা নিয়ে আইনে অস্পষ্টতা
ছেলেশিশু ধর্ষণের মামলা যে ভুল আইনে রুজু হচ্ছে তার আরেকটা বড় কারণ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ছেলেশিশুর যৌন নির্যাতনের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। দন্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা দেয়া আছে। এই সংজ্ঞাটিই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে গ্রহণ করা হয়েছে। সেই সংজ্ঞায় স্পষ্টভাবেই পুরুষের মাধ্যমে নারীর ধর্ষণের শিকার হওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ‘শিশু’র কথা বলা হলেও সেটা যে ছেলেশিশুর নির্যাতনকেও অন্তর্ভুক্ত করছে সেটা বুঝতে পারেন না অনেকেই। ফলে আইনে কিছু পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তা দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমীন।
তিনি বলেন, ‘ধর্ষণের সংজ্ঞায় নারীর পাশাপাশি শিশুকেও অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এবং একইসঙ্গে শিশুর সংজ্ঞাতেও ছেলেশিশুর বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। তাহলে ধর্ষণ মানেই যে সেটা নারী কিংবা মেয়ে শিশু ধর্ষণ, সে ধারণার অবলুপ্তি ঘটবে’।
