ধর্ষণের শাস্তি : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

360

মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম

ইহকাল ও পরকালে শান্তি ও কামিয়াবি অর্জনের জন্যই মানুষ নিজেদেরকে বৈধ ও অবৈধতার সীমারেখায় আবদ্ধ রাখে। আর এ গুণটিই মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় আসীন করেছে। দিয়েছে “আশরাফুল মাখলুকাত” উপাধি। তাদের রয়েছে সুশৃঙ্খল ও পরিপাটি জীবনব্যবস্থা। বাকহীন প্রাণীর মতো লাগামহীনভাবে যৌন চাহিদা নিবারণ সভ্য মানুষের বৈশিষ্ট্য নয়। কিন্তু একজন মানুষ যখন মনুষ্যত্বহীন হয়ে পড়ে, তখন কি তার শ্রেষ্ঠত্ব আর বজায় থাকে? ধর্ষণ, ব্যভিচার ও সমকামিতা প্রভৃতি নৈতিকতা বিরোধী জঘন্যতম অপরাধ। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, অফিস, রাস্তা-ঘাট, বাস কোথাও আজ নারী নিরাপদ নয়। যেখানেই সুযোগ মিলছে সেখানেই বিকারগ্রস্থ পুরুষদের দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছে নারী ও শিশু। প্রতিদিন কত মেয়ে যে ধর্ষিত হচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই। তনু, আফসানা, খদিজা, পূজা সহ আরও নাম না জানা কত শত ধর্ষিত নারী সেই সাক্ষ্যই বহন করছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ৩৯৬ জন নারী-শিশু হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৩৯টি। চাইল্ড পার্লামেন্টের জরিফে এসেছে-গত বছর ৮৭ শতাংশ শিশুই কোন না কোন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আলোচ্য নিবন্ধে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনার প্রয়াস পেলাম।
কোন ব্যক্তির অনুমতি ব্যতিরেকে তার সঙ্গে যৌনসঙ্গম বা অন্য কোন ধরনের যৌন অনুপ্রবেশ ঘটানোকে ধর্ষণ বলা হয়। আরবিতে একে বলা হয় ‘ইগতিসাব’। ইসলামে জোরপূর্বক যে কোনো যৌন সম্পর্ক স্থাপন কিংবা স্থাপনের চেষ্টাকারীকে দেখা হয় ‘মুহাররিব’ হিসেবে, বলা যেতে পারে- অর্থাৎ রাষ্ট্র ও আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী, তা ধর্ষণ অথবা সমকাম কিংবা বিষমকাম যা-ই হোক না কেন। ধর্ষণের ক্ষেত্রে এক পক্ষ থেকে ব্যভিচার সংঘটিত হয়। আর অন্য পক্ষ হয় মজলুম বা নির্যাতিত। তাই মজলুমের কোনো শাস্তি নেই। শুধু জালিম বা ধর্ষণকারীর শাস্তি হবে। ধর্ষণের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় সংঘটিত হয়- এক. ব্যভিচার, দুই. বল প্রয়োগ, তিন. সম্ভ্রম লুণ্ঠন। এ প্রসঙ্গে হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে এক মহিলাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হলে হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কোনরূপ শাস্তি দেননি, তবে ধর্ষণকারীকে হদ্দের শাস্তি দেন।” (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২৫৯৮, সুনানে তিরমিযি, হাদীস:১৪৫৩) অন্যত্র প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, অর্থাৎ অবিবাহিতের ক্ষেত্রে শাস্তি এক শত বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর। আর বিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে একশত বেত্রাঘাত ও রজম (পাথর মেরে মৃত্যুদÐ)। ( সহীহ মুসলিম,হাদিস:১৬৯০)
উপরোক্ত হাদীসের আলোকে ইমাম আবু হানাফি, শাফেয়ি ও আহমদ বিন হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহিম বলেন, ধর্ষণের জন্য ব্যভিচারের শাস্তি প্রযোজ্য হবে। তবে ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি নিম্নোক্ত আয়াতের আলোকে বলেন, যেহেতু ধর্ষণের মধ্যে ব্যভিচারের পাশাপাশি মুহারাবাও (বল প্রয়োগ/ ভীতি প্রদর্শন) পাওয়া যায়, তাই ধর্ষণের অপরাধে ব্যভিচারের শাস্তির পাশাপাশি ‘মুহারাবা’র শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। ‘মুহারাবা’ হলো অস্ত্র দেখিয়ে বা অস্ত্র ছাড়াই ভীতি প্রদর্শন করে ডাকাতি করা কিংবা লুণ্ঠন করা। এককথায়, ‘মুহারাবা’ হলো পৃথিবীতে অনাচার সৃষ্টি, লুণ্ঠন, নিরাপত্তা বিঘিœতকরণ, ত্রাসের রাজ্য কায়েম করা ইত্যাদি। সমাজ থেকে ধর্ষণ নির্মূল করার লক্ষ্যে এই শাস্তি প্রয়োগ করা জরুরি। (আল মুগনি : ৮/৯৮;বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন,১/ধারা-১৩৪) ‘মুহারাবা’র শাস্তির প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, অর্থাৎ ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায়, তাদের শাস্তি হচ্ছে : তাদের হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে বা তাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে কিংবা দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। এটি তাদের পার্থিব লাঞ্ছনা, আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।’ ( সূরা মায়িদা, আয়াত : ৩৩) আর যদি ধর্ষণের সঙ্গে হত্যাজনিত অপরাধ যুক্ত হয়, তাহলে ঘাতকের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদন্ড।
বর্তমানে ধর্ষণ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার একাধিক কারণ আছে। এর মধ্যে তথ্যানুসন্ধান করে দেখা গেছে ধর্ষণ প্রবণতা বৃদ্ধি পাবার মূল কারণগুলো হলো- নগ্নতা, অতৃপ্ত যৌন আকাক্সক্ষা, বেহায়াপনা, অবাধ যৌনাচার, রাস্তার পাশে দেয়ালে নগ্ন পোস্টার, ফুটপাতে অশ্লীল ছবি সম্বলিত যৌন উত্তেজক অবৈধ বইয়ের রমরমা ব্যবসা, অশ্লীল পত্র-পত্রিকা,অশ্লীল ছায়াছবি প্রদর্শন, বাংলা চলচ্চিত্রে খলনায়ক কর্তৃক নারীকে জোরপূর্বক ধর্ষণের দৃশ্য, ইন্টারনেটে অশ্লীল সাইটগুলো উম্মুক্ত করে দেয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, নেশাজাত দ্রব্য সেবন, বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেলেও ছেলে-মেয়েদের বিবাহ না দেওয়া, প্রশাসনের উদাসিনতা ইত্যাদি কারণে আজ যুবসমাজের মধ্যে দিন দিন ধর্ষণ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কথা সাহিত্যিক ও মনোবিজ্ঞানী মোহিত কামাল বলেন, আমাদের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের বিবেক। বিবেককে চাপিয়ে যখন প্রবৃত্তি প্রভাব বিস্তার করে তখন ভোগবাদী সত্তা আধিপত্য বিস্তার করে। ধর্ষকরা শুধু নারীলোলুপ নয়; তাই যদি হতো তাহলে তারা শিশুদের ধর্ষণ করত না। প্রথমত: তারা অবদমিত কাম চরিতার্থ করতে চায়। দ্বিতীয়ত: নারীর প্রতি প্রভুত্ব বা ক্ষমতা দেখাতে চায়, তৃতীয়ত: নারীকে ভোগের বস্তু মনে করে। নারী যে বোনের মমতা, মায়ের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় মেশানো একজন মানুষ, সেটা এদের মন থেকে সরে গিয়ে শুধু ভোগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
অনুরুপভাবে ব্যভিচারকেও ইসলাম অশ্লীল ও নিকৃষ্ট কাজ ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি এর জন্য পার্থিব ও অপার্থিব শাস্তি রয়েছে। শরিয়তে ব্যভিচারী বিবাহিত হলে তার শাস্তি রজম বা পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদন্ড। আর অবিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীকে ১০০ বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে-
অর্থাৎ “ব্যভিচারিণী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ; তাদের প্রত্যেককে একশ’ করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর করণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।” ( সূরা নূর,আয়াত: ২) তবে এই শাস্তি প্রয়োগ করবে ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার ও প্রশাসন। আর কোনো কারণে যদি এই শাস্তি আরোপিত না হয় তবে দুনিয়ায়ই কোনো না কোনোভাবে এর শাস্তি এসে যেতে পারে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘ব্যভিচারের মন্দ পরিণাম ছয়টি। তিনটি দুনিয়ায় আর তিনটি আখিরাতে। দুনিয়ার তিনটি হলো- ১. চেহারার সৌন্দর্য নষ্ট হওয়া, ২. দারিদ্রতা, ৩. অকাল মৃত্যু। আর আখিরাতের তিনটি হলো-১. আল্লাহর অসন্তুষ্টি, ২. হিসাব-নিকাশের কঠোরতা ও ৩. জাহান্নামের কঠিন শাস্তি। (ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ, ই.ফা. পৃ:১০৯)
আর সমকামিতার নামে আজ বিশ্বব্যাপি যে কুপ্রথা চালু হয়েছে- এটা নিতান্তই অসামাজিক, অমানবিক ও অসুস্থ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ বৈ অন্য কিছু নয়। এটা ব্যভিচারের চেয়েও জঘন্য পাপ। যেখানে বন্য জন্তু-জানোয়ারও তাদের যৌন চাহিদা মিটানোর জন্য স্বাভাবিক নিয়মে বিপরীত লিঙ্গের দ্বারস্থ হয়, সমলিঙ্গের কারো সঙ্গে যৌন চাহিদা পূরণে সামান্যতম আগ্রহী নয়। অথচ শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ এ ঘৃণ্য কাজটিকেই ‘আধুনিকতা’ এবং ‘অধিকারের’ কথা বলে অব্যাহতভাবে পাপাচারকে প্রসারিত করছে! ইরশাদ হচ্ছে, তারা (সমকামীরা) চতুষ্পদ জন্তু-জানোয়ারের মতো, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট। ( সূরা আরাফ, আয়াত: ১৭৯) অভিশপ্ত জাতি লুত সম্প্রদায় এ অপরাধে ধ্বংস হয়েছিল। হযরত লুত আলাইহিস সালাম তাদেরকে বারংবার হালাল পন্থায় নারীদের সঙ্গে যৌন চাহিদা পূরণ করার নির্দেশ দেয়া সত্তে¡ও তারা তাঁর কথা শুনেনি, আল্লাহ তায়ালা হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালামকে পাঠিয়ে তাদেরকে শাস্তি দিলেন। ধ্বংস করে দিলেন একটি জনপদ। ইরশাদ হচ্ছে, অতঃপর যখন আমার হুকুম এসে পৌঁছলো এবং আমার সিদ্ধান্ত কার্যকর হলো, তখন আমি জনপদের উপরিভাগ নিচে এবং নিম্নভাগ উপরে উঠালাম এবং তার উপর স্তরে স্তরে কাঁকর-পাথর বর্ষণ করলাম। ( সূরা হুদ,আয়াত: ৮২) কওমে লুতের বস্তির ধ্বংসপ্রাপ্ত রূপই আজকের ‘ডেডসি’ বা মৃত সাগর। সমকামিতা ও অবাধ যৌনতাই এইডসের মতো প্রাণঘাতি রোগ বিস্তরের মূল কারণ। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, তারা প্রকাশ্যে অশ্লীলতায় লিপ্ত হতে থাকে- তখন তাদের মধ্যে এমন রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়বে যা তাদের পুর্বপুরুষদের মধ্যে ছিল না। (সুনানে ইবনে মাজাহ,২/১৩৩২) নবীজি আরো ইরশাদ করেছেন,যে পুরুষ পুরুষের সাথে নোংরা কাজে লিপ্ত হয়, উভয়ে ব্যভিচারকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে। আর যে নারী আরেক নারীর সঙ্গে কুকর্মে লিপ্ত হয় উভয়ে ব্যভিচারকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে। ( শুয়াবুল ঈমান) এ অপরাদের শাস্তির বিষয়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা যদি কাউকে পাও যে লুতের স¤প্রদায় যা করত তা করছে, তবে তাকে হত্যা করো। যে করছে তাকে আর যাকে করা হচ্ছে তাকেও। ( সুনানে আবু দাউদ , হাদীস: ৪৪৪৭) ঐ ব্যক্তি অভিশপ্ত যে কোন পশুর সাথে সেক্স করে, কিংবা সেটা করে যা লুত স¤প্রদায় করত। ( মুসনাদে আহমদ, হাদীস:১৮৭৮) তিনি আরো বলেন, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁর শাসনামলে ২জন সমকামীকে পুড়িয়ে দিয়েছেন। আর হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সমকামীদের উপর দেয়াল ধ্বসিয়ে দিয়েছেন।
ধর্ষিতার করণীয়:
কোনো ব্যক্তি যদি ধর্ষণের শিকার হয়, তাহলে তার সর্বপ্রথম করণীয় হলো, সম্ভব হলে তা প্রতিরোধ করা। এমনকি যদিও তা ধর্ষণকারীকে হত্যা করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে, তাতেও ইসলাম সায় দিয়েছে। ইমাম আহমদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এমন নারীর ব্যাপারে বলেন, যদি সে নারী জানতে পারে যে, এ ব্যক্তি তাকে উপভোগ করতে চাচ্ছে এবং আত্মরক্ষার্থে মেয়েটি তাকে মেরে ফেলে তবে সে নারীর উপর কোন দায় আসবে না। …” –(আল মুগনী ৮/৩৩১) এ প্রসঙ্গে হযরত সাঈদ ইবনে জায়েদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে যে ব্যক্তি নিহত হয়েছে, সে শহীদ। জীবন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সেও শহীদ। দ্বীন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সে শহীদ। আর সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সেও শহীদ। ( সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৭২, সুনানে তিরমিযি, হাদিস : ১৪২১)
ধর্ষণের প্রতিকার:
ইসলাম যৌন নির্যাতন নিরোধকল্পে মূলত প্রতিরোধ ও প্রতিকার উভয় পন্থাই অনুসরণ করে। এ দুটি পদ্ধতির কোনো একটিরই ব্যত্যয় ঘটলে মূলত ইসলামের যে সুরক্ষা প্রস্তাবনা, তা অকার্যকর হয়ে পড়ে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে, নারীর জন্য পর্দার বিধান। সফরকালে সুরক্ষার জন্য মুহরিম পুরুষ রাখা। ঘরে অবস্থানের পরামর্শ। আর পুরুষদের জন্য দৃষ্টিকে অবনত রাখা। নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই সংযমের চর্চা করা। ইরশাদ হচ্ছে, হে হাবীব! আপনি মুমিন পুরুষদের বলে দিন, তারা যেন (বেগানা নারীদের থেকে) তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে।….. আর আপনি মুমিন নারীদেরকেও বলে দিন, তারা যেন (বেগানা পুরুষ থেকে) তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে এবং তাদের সৌন্দর্য পর পুরুষের সামনে প্রকাশ না করে। ( সূরা নূর, আয়াত : ৩০-৩১)
প্রতিটা শিশুর সামাজিকীকরণের প্রথম প্রতিষ্ঠান হলো তার পরিবার। এটিই তার আচরণ, মূল্যবোধ, ধারণা, বিশ্বাস, নৈতিকতা, সাহস, শিক্ষা ইত্যাদির ভিত্তি তৈরি করে দেয়। এই ভিত্তিই তার সারা জীবনের আচরণের মূল চাবিকাঠি। এখান থেকে সে যা শিখবে, সারাজীবন তারই প্রতিফলন ঘটাবে। পরিবারে সে ভালো কিছু শিখলে সে ভালো হবে, না হলে খারাপ। তাই ছোটবেলা থেকে আমাদের উচিত আমাদের শিশুদের প্রতিবাদ করতে শেখানো। কখনো যেন তারা কোনো অন্যায় মেনে না নেয়। তাহলে তারা ভয় পাবে না, কিছু গোপন করবে না, সাহসী হবে, যে কোনো অন্যায়ের শুরুতেই প্রতিবাদ করতে শিখবে।
আর প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা বলতে মূলত আইনি প্রতিকারকে নির্দেশ করে। যেখানে দ্রæত সময়ের মধ্যে অপরাধীর উপযুক্ত সাজা নিশ্চিত করা হয় প্রকাশ্য দন্ড কার্যকরের মাধ্যমে। যেন তা সম্ভাব্য অপরাধপ্রবণ মনোবৃত্তির লোকদের জন্য নজির হয়ে থাকে। ইসলাম প্রকাশ্য ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বলে। ইসলামি বিচার ব্যবস্থায় যৌনাপরাধ মূলত দুই ধরনের। একটা হচ্ছে বিবাহবহির্ভূত ইচ্ছাকৃত যৌন সম্পর্ক যা একটা নির্দিষ্ট বয়স পেরুনোর পর বাংলাদেশে অঘোষিত বৈধ। ইসলাম এটাকে যেনা বা ব্যভিচার বলে, এর শাস্তি প্রয়োগ জটিল। ফলত ব্যক্তির স্বীকারোক্তি ছাড়া সাধারণত এর শাস্তি প্রয়োগ কঠিন। নতুবা চারজন পুরুষ চাক্ষুস সাক্ষী প্রয়োজন ( বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন,১/ধারা-১৩৩; দ্য পেনাল অব ইসলাম, পৃ:৪৪;হানাফি আইন হেদায়া, পৃ: ৩৫৩) (যেন অভিযুক্ত ব্যক্তি সংশোধনের দিকে আগায়)। কেননা, অনেক সময় নিরাপরাধ ব্যক্তি শাস্তি পেতে পারে। তবে যদ্্ি সাক্ষী না পাওয়া যায়, তাহলে ডিএনএ টেস্টের প্রমাণ দ্বারা অপরাধীকে শাস্তি দেয়া যেতে পারে। বিবাহিত হলে এর শাস্তি মৃত্যুদন্ড আর অবিবাহিত হলে একশ বেত্রাঘাত। অন্যটা হচ্ছে ধর্ষণ (ৎধঢ়ব) অর্থাৎ জবরদস্তিমূলক যৌন সম্পর্ক। প্রচলিত আইনে ধর্ষণের সাজা তুলনামূলক কম এবং ধর্ষণচেষ্টার সাজা যৎসামান্য। কিন্তু ইসলামি আইনে ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণের জন্য উদ্যত হওয়া, এমনকি শারীরিক আক্রমণ ছাড়া হুমকি প্রদান করলেও সেটার সাজা ইসলামি আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি (ঈধঢ়রঃধষ চঁহরংযসবহঃ)। বিবাহিত, অবিবাহিত যাই হোক, গ্রহণযোগ্য ও উপযুক্ত প্রমাণ পেলে দ্রæততম সময়ে দন্ডারোপ করা হবে। এর জন্য চারজন সাক্ষীরও বাধ্যবাধকতা নেই।
মোদ্দাকথা হচ্ছে, বাংলাদেশে অধুনা ধর্ষণ, বলাৎকারের মতো ঘটনা বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ পর্দাহীনতা বা অশ্লীলতা। বরং আইনি প্রতিকার ও ন্যায়বিচার না থাকাটাই এর জন্য দায়ী। একশ্রেণীর অর্থলোভী পুলিশ ও শক্তিশালী ধর্ষকদের দাপটে অস্থির হয়ে উঠেছে দেশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গনে ধর্ষণের সেঞ্চুরী হয়। তারপরও ধর্ষক বুক ফুলিয়ে রাস্তা-ঘাটে হাঁটে। অথচ এদেশের সরকার ও প্রধান বিরোধী দলসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীদের অবস্থান হওয়া সত্তে¡ও সরকার পারেনি ধর্ষণকারীদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে। তাহলে কিভাবে এ দেশের অসহায় নারীরা ধর্ষণের হাত থেকে রেহায় পাবে? আদতে এই যে অপরাধ দমনে ব্যর্থতা, তা মূলত শাসনযন্ত্রের। যদি এই শাস্তিগুলো প্রকাশ্যে দেয়া হয় (রজম ও বেত্রাঘাত), সমাজে এর একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়া হয়। মানুষ প্রকাশ্যে এই শাস্তি প্রত্যক্ষ করে একটা বার্তা পায় যে, এই অপরাধ করলে এভাবেই প্রকাশ্যে ভয়াবহ শাস্তি পেতে হবে। শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি তো সাজা পাচ্ছেই, তার নাম-পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ফলে এটি তার পরিবারের জন্যও অপমানজনক একটি ব্যাপার। ইসলামী শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত এই হদ (শাস্তি) বাস্তবায়ন হলে সমাজ থেকে ধর্ষণ ও ব্যভিচারের মত অপরাধগুলো নির্মূল হয়ে যেতে বাধ্য।
পরিশেষে বলা যায় যে, ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার প্রতি আমাদের ছেলে-মেয়ে ও যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং গড়তে হবে আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া ভিত্তিক সমাজ।

লিখক: আরবি প্রভাষক
রাণীরহাট আল আমিন হামেদিয়া ফাযিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসা