দেশ, জনগণ ও প্রাকৃতিক সম্পদ

63

একটি ইংরেজি দৈনিকে ১৭ জুন তারিখে খবর ছাপা হয়েছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর স্ত্রী সারা অসৎ কর্মকান্ডের জন্য অর্থদন্ডে দন্ডিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে সরকারি বেতনে বাবুচি থাকা সত্ত্বেও সরকারি টাকায় খাদ্য কিনে খাওয়ায় তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আরো কয়েকটি অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। তার স্বামী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নাকি ঘুষ, দুর্নীতি ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত। এর আগে একই পত্রিকায় ১২ জুন প্রকাশিত সংবাদ ছিল সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ-বিন-সলমান তার বিলাসবহুল প্রমোদতরীতে সাজিয়ে রাখতে ৪৫ কোটি ডলার, বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় তিন হাজার সাত শত কোটি টাকায় লিউনার্দো দা ভিঞ্চির আকা ‘সেলভেটর মুন্ডি’ নামে একটি তৈলচিত্র ২০১৭ সালে বিলেতের ‘কৃষ্টি’ সংস্থা থেকে কিনেছেন। এমন খবর কেন যে বিশ্বাস করতে মন চায় না, তা সহজবোধ্য। মুসলিম উম্মার পবিত্র ঘর মসজিদুল হারামের ভবিষ্যৎ তত্ত্বাবধায়ক এ ব্যক্তি এমন কাজ করবেন যে, আল্লাহর দেয়া সম্পদ তেল বিক্রি করে পরিত্যাজ্য দ্রব্যাদি কিনে আল্লাহর নিয়ামতের অপচয় করছেন ? তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, খ্যাতিমান সাংবাদিক জামাল খাশোগির খুনের সাথে তিনি জড়িত। খাশোগির কথা লিখতে গিয়ে মনে পড়ে আরেক খাশোগির কথা। বেশ কয়েক বছর আগে পরলোকগত আদনান খাশোগি নামে আরেক সৌদির কাহিনী পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তারও নাকি একটা প্রমোদতরী ছিল, যে তরীর বাথরুমে ব্যবহৃত হাতলগুলি ছিল স্বর্ণের তৈরি। তাহলে কী ধরে নিতে হবে তাদের হাতে ক্ষমতা, ধনদৌলত আসলেই তারা ভোগ বিলাসিতায় মত্ত ?
আগে তা ছিল না, আমেরিকার নিউজউইক বুক ডিভিশন থেকে ১৯৭২ সালে প্রকাশিত উড়সব ড়ভ ঃযব জড়পশ বইটি মূলত জেরুজালেম নগরীর ইতিহাস। এত সমৃদ্ধ ইতিহাস সংবলিত স্থান হয়তো পৃথিবীতে আর একটিও নেই। এ গ্রন্থে একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ আরবের একটি মনোমুগ্ধকর ঐতিহাসিক কাহিনী লিপিবদ্ধ রয়েছে ; যা এখানে তার অংশবিশেষ তুলে ধরছি প্রায় পৌনে চৌদ্দশ বছর আগে ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম বাহিনী যখন জেরুসালেম নগরীর দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হলো যুদ্ধ করে নগরীর দখল নিতে, তখন খ্রিস্টান অধ্যুষিত সেই নগরীর কর্তাব্যক্তি ছিলেন পার্দি সফ্রোনিয়াস। মুসলিম সেনাবাহিনী চার মাস ধরে জেরুসালেম অবরুদ্ধ রাখার পর সফ্রোনিয়াস একদিন নগরীর একটা প্রান্তের দেয়ালে এসে মুসলিম বাহিনীকে বললেন, যদি হজরত ওমর রা. নিজে এসে কর্তৃত্ব নেন, তা হলে তিনি তার কাছে আত্মসর্ম্পণ করবেন। হজরত ওমর রা. খবর পেয়ে এসে জেরুসালেম অধিবাসীদের আত্মসর্ম্পণ গ্রহণ করলেন এবং সফ্রোনিয়াসকে আশ্বাস দিলেন। তাদের জনগণ, সম্পদ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সব কিছু নিরাপদে থাকবে। কোনো অত্যাচার করা হবে না তাদের প্রতি। তখনকার একজন খ্রিস্টান ঘটনাপঞ্জি লেখক লিখেছেন (ওপরে উল্লিখিত গ্রন্থে) হজরত ওমর রা. ছিলেন ্একজন মিতব্যয়ী, দৃঢ়চিত্ত, সুশৃঙ্খল চরিত্রের অধিকারী এবং অতি সুন্দর মনের মানুষ। তিনি যখন জেরুসালেম নগরীর দখল নিতে এলেন ; তখন তার গায়ে ছিল জোড়াতালি দেয়া জামা কাপড়; তিনি ঘুমালেন একটি খেজুর পাতার চাটাইতে। নামাজের সময় হলে হজরত ওমর রা. নামাজ আদায় করতে চাইলেন ; সফ্রোনিয়াস তাকে আহŸান করলেন গির্জার ভেতরে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করতে। খলিফা এতে অস্বীকার করলেন এবং বাইরে গিয়ে নামাজ আদায় করলেন। পর তিনি সফ্রোনিয়াসকে বললেন, ‘জানেন কেন আমি গির্জার ভেতরে নামাজ পড়লাম না ? আজ যদি এখানে নামাজ পড়তাম তাহলে আমি চলে যাওয়ার পর এ স্থান অপনাদের বেহাত হয়ে যেত’।
এ ছিল তখনকার মুসলিম জাহানের খলিফা হজরত ওমর রা. এর চরিত্র। একের পর এক এমন আদর্শ চরিত্রের নেতাদের উপস্থিতির কারণে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল সারাবিশ্বে। আর আজ আদর্শচ্যুতির কারণে মুসলমানেরা নিগৃহীত হচ্ছে দেশে দেশে।
এমনকি, মাত্র কয়েকশ বছর আগেও এ উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের আগে কোনো কোনো পাঠান, মোগল, বাদশাহ রাষ্ট্রীয় তহবিলের টাকা সংসারে ব্যয় করতেন না। সুলতান নাসিরউদ্দীন নাকি টুপি তৈরি করে। আর মোগল বাদশাহ আলমগীর নিজ হাতে লেখা কুরআন শরিফ বিক্রি করে সংসারের ব্যয়ভার বহন করতেন। মুসলমানেরা যে ব্যাপক হারে বিলাসে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। এ কারণে অনেকেই অসাধুতায় জড়িয়ে পড়তেন। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু আর তার স্ত্রী সারা যে অপরাধ করেছেন, তা অমুসলিম দেশগুলোতে খুব একটা দেখা যায় না। মুসলিমদের জন্য হালাল হারামের কঠিন বিধান থাকা সত্ত্বেও তাদের অনেকেই দুর্নীতি, অপরাধ করছেন আর অপমানিত হচ্ছেন।
আরো একটি সংবাদ পড়ে ব্যথিত না হয়ে পারা যায় না। মুসলিম অধ্যুষিত মিসরের প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান ও সৎ শ্রদ্ধেয় জননেতা ড. মোহাম্মদ মরসি আদালতের কাঠগড়ায় ইন্তেকাল করেছেন। তিনি ছিলেন মিসরের জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রথম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি, যিনি মাত্র বছর খানেক স্বপদে বহাল থাকার পর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। মৃত্যুর সময় আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অবস্থায় অচেতন হয়ে ঢলে পড়ে ইন্তেকাল করেন। দেশটির সেনাপ্রধান আবদুল ফাত্তাহ সিসি জোর করে রাষ্ট্রপতি হওয়ার খায়েশে তাকে সরিয়ে পদটি দখল করেন। তার আগে ঘটেছিল ইরানের স্বৈরাচারী সম্রাট রেজা শাহ পাহলভির বিতাড়ন। ইরান এরপর একটা জনগণের সরকার পেয়েছে। সিরিয়া, ইয়েমেন দুর্বিপাকে। সৌদি আরব আর সহযোগী মিসর, আমিরাত জোটবদ্ধ হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বিভেদ ও অশান্তি জিইয়ে রেখেছে। মুসলিম দেশগুলোর অনৈক্যের দরুন নিগৃহীত মুসলিমদের কোনো সহায়তা করতে পারছি না আমরা অথচ ধর্মীয় নির্দেশ হচ্ছে আমাদের একতাবদ্ধ থাকতে হবে।
মুসলিম দেশগুলো যাদের কাছ থেকে কেনা অস্ত্র দিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে একে অন্যকে ধ্বংস করছে। কখনো কি ভেবে দেখেছে এসব অস্ত্র নির্মাণকারী দেশ কখনো মুসলিম দেশগুলোর একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উন্মাদনা থামাতে চাইবে না! কারণ তা হলে তাদের অস্ত্র কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। শ্রমিকেরা বেকার হয়ে আন্দোলনে নামবে। বৈদেশিক মুদ্রার আয় বন্ধ হয়ে যাবে, সৌদি আরব হোক আর তুরস্কই হোক, কেউই অত্যাচারি ইসরাইলের বিরুদ্ধে আমেরিকা, রাশিয়ায় কেনা যুদ্ধ সরজাম ব্যবহার করে সাফল্য লাভ করতে পারবে কি ?
এবার পাঠকদের অনুরোধে অন্য একটি প্রসঙ্গ। ‘অপ্রদর্শিত আয়’ হিসেবে গণ্য, কালো টাকার অত্যন্ত স্বল্পসংখ্যক মালিক স্বেচ্ছায় তাদের টাকা ‘সাদা’ করেছেন। সাধারণত এমন অর্থের অধিকারীরা নিয়মিত কর ও জরিমানা দিয়ে তা বৈধ করার আগ্রহী নন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানানো হয়, ২০১৬-১৭ অর্থ বছর থেকে গত তিন বছরে সারা বাংলাদেশে মাত্র ২২৩ জন করদাতা তাদের সর্বমোট ১৯৭ কোটি টাকার অপ্রদর্শিত অর্থের কথা প্রকাশ করেছেন। এ বাবদ সরকারের কোষাগারে আয় হয়েছে মাত্র ৩৭ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন, এই পরিমাণ অর্থ অত্যন্ত নগণ্য হতে পারে, কালো টাকার মালিকেরা বিষয়টাকে হালকাভাবে নিয়েছেন, কারণ একের পর এক বিভিন্ন সরকার তাদের মার্জনা করে দিয়েছে।’
কালো টাকা ‘ভালো’ বা ‘সাদা’ করার জন্য সরকার যত সদিচ্ছা ব্যক্ত করুক না কেন, কিংবা এর ঘোষিত উদ্দেশ্য যত মহত হোক, অপ্রিয় বাস্তবতা হলো অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকায় যারা ধনাঢ্য হয়েছেন, তারা টাকার রঙ ‘কালো’ থেকে ‘সাদা’ করতে তেমন আগ্রহী নন। ফলে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ কালো টাকা বেআইনিভাবে বিদেশে পাচারের আশঙ্কা দূর হচ্ছে না। এ অবস্থায় সরকার আর কত দিন এ ক্ষেত্রে কঠোরতার বদলে উদারতা প্রদর্শন করে যাবে। সেটা জনমনে এক বিরাট প্রশ্ন। কালো টাকার মালিকদের সেই প্রবাদের সত্যতাই প্রমাণিত হচ্ছে ‘কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না’।
লেখখ : সাংবাদিক ও কলামিস্ট