দুই শহরের জানালা

80

কর্মস্থলে যোগদানের প্রথম দিন থেকেই এই শহরটার প্রতি আমার একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। কেবল নেতিবাচক ধারণাই নয়, চাকরিতে ঢোকার অল্পদিন আগে জাপানি কথাকার হারুকি মুরাকামির ‘বেড়ালের শহর’ শীর্ষক শিরোনামের যে গল্পটা পড়েছিলাম; আনকোরা এই শহরের চেহারা-সুরত, অঙ্গপতঙ্গ অনেকটা সে গল্পের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় প্রথম-দর্শনেই হতাশ হয়ে পড়েছিলামÑ স্বাভাবিক হতে সময় লেগেছে ঢের।
আমার জন্মশহর থেকে কর্মশহরের দূরত্ব যতটা না বেশি, তারচে বহুগুণ বেশি মনের দূরত্ব। ফলে এখানকার মানুষজন, পশুপাখি, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে ওঠা দুষ্কর হয়ে পড়লো। সমস্ত শহরে আতশ কাচ লাগিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজলেও একটা পরিচিত মুখ আর বিশ্বস্ত হাসি চোখে পড়বে কিনা সন্দেহ হয়! স্বভাবতই প্রশ্ন জাগেÑ অচেনা-অজানা মানুষের ¯্রােত এবং ধূসর পৃথিবীকে আঁকড়ে ধরে রাখা এই নির্দয় ভূমিখানা কি জাপানি কিংবদন্তি হারুকির চোখে পড়েছিলো কখনো? এটাই তাঁর ‘বিড়ালের শহর’ নয়তো!
অনেক ভোগান্তি শেষে, অনাত্মীয় শহরে একটুখানি আত্মীয়ের সন্ধান পেলাম, অপরিচিতের ভিড়ে পেলাম পরিচিতের ঘ্রাণ; পরিচিত সেই বস্তুটি হলোÑ দক্ষিণের জানালা! অফিসের দ্বিতীয় তলায়, পেছন-কোণের দক্ষিণপাশে যার অবস্থান।
এখানে আসার পর থেকে মন খারাপ হলেই জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। কাপড়ের পর্দা ঠেলে পৃথিবী দেখি। দেখি মানুষ ও পশুপাখি। বাতাস মাখি গায়ে। নীচে তাকালে চোখে পড়ে কোলাহলময় ঘন বসতবাড়ি। শোনা যায় মানুুষের খিস্তি, শিশুর চিৎকার, গরুর হাম্বা-রব। এরই-মধ্যে আলাদা একটা দৃশ্যে আমার চোখ আটকে যায়…
পেছনপাশ হলেও, দক্ষিণধারের নিরিবিলি কক্ষটি আমার ভালো লেগে যায়। ভালো লাগে দীর্ঘ জানালাটিও। বলা যায় অচেনা শহরে এই জানালাখানি আমার একমাত্র বন্ধু ও আপনজন হয়ে ওঠে। তারই সূত্রধরে খুঁজে পেলাম অন্য একটি মুখের দেখা… যে কেবল গোপনেই পুষ্পিত হয়েছে এবং আড়ালেই পড়েছে ঝরে!
জানালা গলিয়ে বাইরে চোখ নিলে দেখা যায়, অফিসের সীমানা-পাঁচিল এবং পাঁচিল লাগোয়া সরু-পাকা রাস্তা। কতোরকম মানুষের যে আনাগোনা ওখানে! বস্তির ভেতর দিকে রাস্তাটি চলে যাওয়ায় গাড়িঘোড়ার ঝক্কিঝামেলাও কম। লোকজনই বেশি। রাস্তাধরে হেঁটে যাওয়া মানুষের মুখগুলো দেখতে দেখতে এতোদিনে প্রায় মুখস্ত হয়ে গেছে। দেখার মধ্যে ক্লান্তি আসে না তবু। ভালো লাগে। কেন লাগে? ব্যাখ্যা জানি না। শুধু জানি, নিভৃতে; এই জানালায় দাঁড়িয়ে এক মায়বতীর মুখ দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি। দূর থেকে দেখেছি তার হাতের চঞ্চলতা, কাজলহীন দরদি চোখের আল্পনা, উচ্ছল হাসি আর বাহুল্যবর্জিত কোমল-সজীব মুখশ্রী। মেয়েটি কখনো আমাকে দেখছে কি? জানি না। পৃথিবীর কেউ জানে না তার নজর আদৌ আমার দিকে পড়েছে কিনা।
তরুণীর নামধাম জানি না। সকালে নির্দিষ্ট একটা মুহূর্তে জানালায় দাঁড়ালে তাকে দেখা যায়, এটুকের বাইরে আর কোনো তথ্য জানি না আমি। জানবোই-বা কি করে, আমার গোপন চোখ যে আড়ালে দাঁড়িয়ে চায়, এসব কি আর বলে বেড়ানো যায়?
ইতিউতি দিনের অন্যান্য সময় দুএকবার যে সে হাঁটাচলা করে না, এমন নয়। করে। কালেভদ্রে। তবে অনিবার্য রুটিন হলো, সকালে দীর্ঘসময় সে রাস্তায় থাকবেইÑ ব্যস্ত। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীতে, যে কোনো ঋতুতে; প্রতিদিন একই সবসময়ে, একই কাজে নিয়োজিত থাকে সে। কাজটি হলোÑ এক যুবকের সহযোগী হয়ে তুমুল আবেশে ভ্যানগাড়িতে শাক-সবজি এবং তরিতরকারি প্রজাতির কাঁচামাল সাজিয়ে দেয়া।
ধীরুস্নিগ্ধ হাতে মেয়েটি যখন ভ্যানের উপর তরকারি সাজায়, তখন নরোম হাতের ছোঁয়ায় তরকারির সজিবতার সঙ্গে গাড়িটিও যেন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পাশের ছেলেটি খুশি হয়। হাসে। সম্পর্কে ওরা ভাইবোন। ‘ভাইয়া আইজগা একটু তাড়াতাড়ি আহিছ, একখানো যামুনে’ মাল বিক্রির উদ্দেশ্যে ভ্যান হাঁকিয়ে যাওয়ারকালে, দূর থেকে একদিন এজাতীয় একটা বাক্য ভেসে আসায় নিশ্চিত হওয়া গেলোÑ ওরা ভাইবোন।
মালামাল সাজানোর আদতে আস্ত একটা সকালকেই যেন সে মুখরিত করে রাখেÑ এটা কোরো, ওটা কোরো না; হাজার-কিসিমের নির্দেশনা! ভাইটি বড় সহজ-সরল, বোনের কথাকে কর্তব্য মনের করে।
জানালায় দাঁড়িয়ে প্রায়শ দৃশ্যটা দেখি। মুগ্ধতা কুড়াই। হররোজ একই দৃশ্য দেখেও ভালোলাগায় ছেদ পড়েনি। এসব দেখতেই কি ইদানিং একটু আগেভাগে অফিসের দিকে ছুটি? কখনো দীর্ঘসময় লাগিয়ে চায়ের কাপে চুমু বসাতে বসাতে দৃশ্যটার সমাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকি। দিনেদিনে মুহূর্তটা বড় প্রিয় হয়ে ওঠে।

দুই.
কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ একদিন বদলির আদেশ হাতে পেলাম। আদেশটা পূর্ব-তদ্বিরের গুণে হয়েছে কিনা জানি না। ইদানিং এসব চিন্তা মাথায় ওঠেনি। তবে পছন্দের একটি জেলাতেই পোস্টিং হলো। অপছন্দের জেলাতে হলেই বা কী। পাততাড়ি গুটিয়ে চলে আসতে হয় নতুন কর্মক্ষেত্রে। কয়েকদিনের প্রাতিষ্ঠানিক ঝামেলা, চার্জ বুঝিয়ে দেয়া, নানাবিধ বিষয়াশয়ের ধকল কম সামলাতে হয়নি। ফলে অনেক কিছুই খেয়ালে আসেনি। হুট করে চলে আসায়, স্বল্পসময়ের জন্যে ভ্যান সাজানো মেয়েটির কথাও বেমক্কা ভুলে গিয়েছিলাম।
নতুন শহরেও আমার জন্যে যখন দক্ষিণের জানালাঘেঁষা অফিসকক্ষটি সেট করা হলো তখন ভেতরে ভেতরে কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম। তারা আমার মনের কথা অনুবাদ করতে পেরেছে জেনে প্রথম কর্মদিবসেই মন ভালো হয়ে গেলো। পুরোদস্তুর কাজে মন দিলাম। পুরনো অভ্যাসের কারণেই হয়তো, অফিসে ঢুকলে এখানেও দক্ষিণের জানালা আমার মন টানে। দাঁড়াই গিয়ে। কিন্তু সেই সবজিকন্যা, সরলসোজা যুবককে আর দেখা যায় না। হঠাৎ মন খারাপ হয়, পরক্ষণেই স্মরণ হয়Ñ আমি তো অন্য শহরে।
অনেকবার লক্ষ করছি, দক্ষিণের জানালার মায়া আমি ছাড়তে পারছি না। জানি মেয়েটি এখানে নাই, নেই তার ভাইটিও; প্রত্যাশিত কোনো সবজি-ভ্যানও এখানে সাজানো হয় না; তবুও চুম্বকের মতো জানালা আমাকে টানে। যাই। মৃদুশ্বাস ফেলি। এবং দূর থেকে দেখি, নেশায় বুদ হয়ে থাকা যুবকদের মাতলামি, সন্দেহভাজন মানুষের আনাগোনা, গণিকাদের ইতস্তত চলাফেরা। বুঝতে পারি, এখানকার জানালা আর ওখানকার জানালার মধ্যে বিস্তর তফাৎ! ভাইবোনের মধুময় সংসার, পবিত্র খুঁনসুটির কথা এখানে কল্পনা করা বৃথা। আড্ডাবাজ কিছু ছেলেপেলের শিস শোনা ছাড়া আর কিছুই এখানে আশা করা যায় না। শুধু কী তাই, সারাক্ষণ ঝগড়াঝাটি, হৈহুল্লোড় আর রক্তপাত! পুরো এলাকাটাই অস্থির! পৃথিবীর কোনো জানালা দিয়ে এমন দৃশ্য দেখে আমি অভ্যস্ত নই। তবুও কর্মের তাগিদে, পেটের দায়ে মেনে নিতেই হলো সব। দিন যত গড়ায়, প্রিয় শহর থেকে মন তত উঠে যায়। সাদামাটা পোশাকের সবজিকন্যা আর নির্ভেজাল যুবকের স্মৃতি আমাকে ধাক্কা মারে। অর্থহীন ঠেকে পৃথিবী, অসহ্য লাগে সব। কাজে বসে না মন। সারাক্ষণ মনের পুকুরে চিতল-মাছের মতো পিঠ জাগিয়ে রাখে পুরোনো একটি শহর। একপ্রকার অধৈর্য হয়ে, বুদ্ধি-কৌশল খাটিয়ে, চেষ্টা-তদ্বির চালিয়ে, উপরে অর্থ-উপঢৌকন ঢেলে পুনরায় আগের শহরে বদলি হলাম। অনেকদিন সময় গেলেও উৎফুল্লচিত্তে ছুটে এলাম পুরনো অফিসে।

তিন.
গেলো ক’দিন মেয়েটির দিকে কল্পনার জাল যে কতোটা বিস্তার হয়েছে তার কোনো হিসেবনিকেশ নেই। প্রথম কর্মদিবসেই তাড়াহুড়ো করে অফিসে ছুটলাম। জানালায় দাঁড়ালাম। আশ্চর্যÑ মেয়েটি নাই! যুবক ভাইটি একা একা গাড়ি সামলাচ্ছে। মাল তুলছে। তার শরীর ও মন ভীষণ ক্লান্ত, মুখটা বিধ্বস্ত! কপাল ঘেমে একাকার। হাত দুটো নড়ছে না। তার অনভ্যস্ত হাতের ছোঁয়ায় শাকসবজিসমেত ভ্যানগাড়িটিও আগের মতো উজ্জ্বলতা পায়নি। নির্জীব দেখাচ্ছে সবকিছু। ভাবলাম, মেয়েটি বোধহয় বেড়াতে গেছেÑ আজকালের মধ্যেই ফিরবে।
না। পরের দিনও একই অবস্থা, সে নেই! যুবক-ভাইটি আজও নিজে-নিজে গাড়ি সাজাচ্ছে। ঘামছে। মুখে এক-গ্লাস পানি তুলে দেবারও কেউ নাই। তার চোখেমুখে ভারি এক পাথুরে ছায়া। গামছায় সে কি ঘাম মোছে, নাকি অশ্রু মোছে; দূর থেকে ঠাহর করা কঠিন। তবে এটাই নিশ্চিত যে, কর্মসহযোগী বোনটি তার আশেপাশে কোথাও নাই!
সপ্তাহ পার হলো, মেয়েটির দেখা নেই। খোলা জানালার ঘ্রাণ ম্লান হয়ে আসছে। সবই আগের মতো ঠিকঠাক আছে : মেয়েটি কোথায়? ঘুরেফিরে জানালার দিকে উকিঝুকি মারি। আবারও সপ্তাহ ফুরায়। মাস ছুঁই ছুঁই করে। দিনদুনিয়া ঠিকঠাক চলে, মেয়েটি ফিরে না। ধীরেধীরে ভারি হয়ে ওঠে মন, ভারি হয় নিশ্বাস। অসহ্য লাগে সব। করুণ একটা মায়া-টান ভেতরটা চুরমার করে দেয়। চৌচির হয়ে যায় অন্তরাত্মা। যে দৃশ্যের টানে এতো দৌড়ঝাঁপ, অর্থ-শ্রম-মেধা অপচয়- শেষপর্যন্ত সেটাই রহিত হয়ে গেলো! বারবার হতাশ হয়ে জানালার কাছ থেকে সরে আসার আগেও বহুবার ভেবেছি, এই বুঝি মেয়েটি টুক করে এসে পড়লো! না। আসেনি। আগের মতো গাড়িটিও সাজেনি নিখুঁত ঢঙে। যুবকের বিষন্ন হাত মেয়েলী হাতের মতো ততটা দক্ষ নয়।
ভেতরের যন্ত্রণাবোধ যখন বেপরোয়া হয়ে ওঠলো তখন অফিসের বয়স্ক সহকর্মী কাশেম পিয়নকে ডাকলাম, কাশেম ওখানেই বাসাবাড়ি নিয়ে থাকে। লাজলজ্জা উপেক্ষা করে মেয়েটির কথা জিজ্ঞেস করলাম। কাশেম ভয়ানক এক উত্তর দিলো- যা শোনার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। থ মেরে রইলাম। স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার খেই হারানোর অবস্থা! দীর্ঘপ্রতীক্ষার চোখ হঠাৎ জল-ছলছল হয়ে ওঠে। মুখ ফুটে কথা বেরোয় না। বহুকষ্টে উচ্চারণ করলাম-‘উফ্!!! মানুষ এতো নৃশংস্য হয়!’
কাশেম কী বুঝলো জানি না। ভেজা-সুরে একবার বলতে শুনেছি- মাইয়াডা বড় ভালা আছিল স্যার! অত্র এলাকাত এমন মাইয়া দুইখান হয় না…মাইঝরাইতে বইন বইন কইয়া অখনও পোলাডা কাইন্দা ওটলে চক্ষের পানি রাখুন যায় না…মা-বাপ তো কবেই মরলো..বইনডাই আছিলো সম্বল…শেষমেশ…
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে কাশেম পাশ কাটিয়ে চলে যায়। বুকটা ধকপক-ধকপক করতে থাকে। কথা না বলা, নাম না জানা ক্ষণকালীন প্রজাপতির মতো একটি মেয়ের জন্যে আমার চোখ কেঁপে ওঠে। হাত-পা কেঁপে ওঠে। বুক কাঁপে। যে দৃশ্যের টানে ছুটে এলাম বহুদূর পাড়ি দিয়ে, যে আশায় বুকবেঁধে অর্থ-শ্রম-মেধা আর আরামপদ জীবন বির্সজন দিতে আমি সদা প্রস্তুতÑ কখনোই আর দেখা হবে না তা!

চার.
এখানে থাকলে যন্ত্রণাই বাড়বে। ভ্যান সাজানো একটি মেয়ে, হাস্যোজ্জ্বল কোনো যুবক আমার স্মৃতিকে বারবার ভারাক্রান্ত করবে। তাই বদলির আদেশ প্রার্থনা করে কর্তৃপক্ষ বরাবরে আবার দরখাস্ত মারলাম। যতদ্রুত সম্ভব এই শহর ছাড়তে হবে। প্রয়োজনে মফস্বলে গিয়ে থিতু হবো, আর নয় এখানে।
কিন্তু বিধিবাম! কর্তৃপক্ষের সাফসাফ জবাব, সদ্যবদলি অর্ডার জারি হওয়ার পর, নতুন করে এতো তাড়াতাড়ি বদলির সুযোগ নেই। আপাতত এখানেই থাকতে হবে। সুযোগ বুঝে পরে কোথাও ঢুকিয়ে দেয়া যাবে…
এমন সংবাদে, আরো কিছু যন্ত্রণা কুড়ানোর প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কিইবা করার আছে!