তৃতীয় দফায় মেয়াদ বাড়ানোর কৌশল!

110

তৃতীয় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর কৌশল হিসেবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বহুল আলোচিত বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত নতুন খাল খনন কাজ আজ (মঙ্গলবার) আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হচ্ছে। নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল ৬ বছর আগে।
শুরু থেকে নানা বিড়ম্বনায় প্রকল্পটি দীর্ঘদিনেও আলোর মুখ দেখেনি। এরই মধ্যে দুই দফায় মেয়াদ বাড়ানোর ফলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় চারগুণ। অন্যদিকে দ্বিতীয় দফার মেয়াদ শেষ হতে বাকি মাত্র আর চার মাস। আগামী মার্চেই তৃতীয় দফায় মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করবে চসিক।
সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে দ্বিতীয়বার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিনমাস আগেই মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করতে হয়। অর্থাৎ আগামী মার্চেই তৃতীয় দফা মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করবে চসিক। এরই কৌশল হিসেবে প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন হচ্ছে। আজ দুপুর ১২টায় ওয়াজ্জারপাড়া বিদ্যালয়ের মাঠে প্রকল্পের কাজ উদ্বোধনের কথা জানিয়েছে চসিকের জনসংযোগ শাখা।
প্রকল্পটি অনুমোদিত হয় ২০১৪ সালের জুন মাসে। প্রথমবার প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত। ওই সময়ের মধ্যে প্রকল্পের ভৌত কাজ শুরু করা যায়নি। কারণ ছিল ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা। অবশ্য এই জটিলতা তৈরির নেপথ্যে রয়েছে চসিকের দায়িত্বরত প্রকৌশলীর অদূরদর্শীতা ও দায়িত্বে চরম গাফিলতি। বাস্তব অবস্থা অবলোকন ছাড়া সিডিএ মাস্টারপ্লান অনুসারে প্রকল্প প্রস্তাবনা দিয়ে অনুমোদিত হয় প্রকল্প। বাস্তবায়ন করতে গেলে শুরু হয় এলাইনমেন্টের ঝামেলা। তারপর আবারও দ্বিতীয় দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এরই মধ্যে সরকার মৌজা মূল্যের তিনগুণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে ঘোষণা দেয়। ফলে দেরি করার মাশুল হিসেবে চারগুণ বেড়েছে প্রকল্প ব্যয়। সেবারও ব্যয় বাড়িয়ে অনুমোদন দেয় সরকার। কিন্তু অধিগ্রহণের ধীরগতির কারণে এখনও মাত্র দুইটি এলএ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি রয়েছে আরও তিনটি। ফলে নিস্পত্তি হওয়া এলাকায় টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করে কাজে নেমে পড়তে চাচ্ছেন প্রকল্প পরিচালক। অন্যথায় তৃতীয়বার মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে নতুন ঝামেলায় পড়তে হতে পারে।
তবে এই সময়ের মধ্যে প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কেননা সিডিএ জলাবদ্ধতা নিয়ে মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। একইদিনে সময়ের সাথে আবারও ব্যয় বাড়ার শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এই বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক চসিকের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, মঙ্গলবার দুপুরে প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন হচ্ছে। দুইটি এলএ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এরমধ্যে আমরা ৬টি দরপত্রের বিপরীতে কার্যাদেশ দিয়েছি। এসব ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানই কাজ শুরু করবে। মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে বলেন, আমাদের তৃতীয় দফা মেয়াদ বাড়াতে হবে। তাই তিনমাস আগে মার্চেই আমরা আবেদন করবো। এখন যদি কাজই শুরু না হয়, তাহলে আমাদের মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে ঝামেলা পড়তে হতে পারে।
এক নজরে বারইপাড়া খাল খনন প্রকল্প : চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ১৯৯৫ সালে যে ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করেছিল, তাতে তিনটি খাল নতুন খননের প্রস্তাব ছিল। এর মধ্যে একটি বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত। অপর দুটি হলো নয়াখাল থেকে শীতলঝর্ণা এবং মুরাদপুর থেকে বহদ্দারহাট। পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে ওই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা থাকলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। ২০১৪ সালে নগরের বহদ্দারহাটসহ আশপাশে প্রধান সড়ক-উপসড়ক ও এলাকা ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে চসিক বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্ষন্ত একটি নতুন খাল খননের উদ্যোগ নেয়। এরজন্য সরকার (ভূমি অধিগ্রহণের ২২৪ কোটি টাকাসহ) ৩২৬ কোটি ৮৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়। প্রকল্পে ২৪৫ কোটি ১৩ লক্ষ টাকা সরকার এবং ৮১ কোটি টাকা চসিকের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে। ২০১৪ সালের ২৪ জুন প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পেয়েছিল। তবে প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় ২০১৫ সালের ১৩ আগস্ট। ওই সময় প্রকল্পের সময়সীমা ধরা হয়েছে ২০১৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, নতুন খালটি নগরীর বারইপাড়াস্থ চাক্তাই খাল থেকে শুরু করে শাহ্ আমানত রোড হয়ে নুর নগর হাউজিং সোসাইটির মাইজপাড়া দিয়ে পূর্ব বাকলিয়া হয়ে বলির হাটের পাশে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়বে। খালটির দৈর্ঘ্য হবে আনুমানিক ২ দশমিক ৯ কিলোমিটার এবং প্রশস্ত ৬৫ ফুট। খালটির মাটি উত্তোলন, সংস্কার ও নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টির লক্ষ্যে খালের উভয় পাশে ২০ ফুট করে ২ টি রাস্তা ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ করার কথা রয়েছে।
এই প্রকল্পের প্রধান অংশ ভ‚মি অধিগ্রহণ। এই অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে। ওইদিন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বরাবর ভ‚মি অধিগ্রহণের অনাপত্তি ছাড়পত্রের আবেদন করেছিল চসিক। পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে ২০১৬ সালের ৩ জানুয়ারি জেলা প্রশাসনের কাছে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রমের জন্য পত্র দিয়েছিল চসিক। ওই সময় জেলা প্রশাসনের ভ‚মি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করলে পরে ‘এলাইনমেন্ট’ জটিলতায়। কেননা ডিপিপিতে যেসব জায়গায় ভূমি অধিগ্রহণের কথা বলা হয়েছে, সেখানে অধিগ্রহণ অযোগ্য স্থাপনা ছিল (মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান ইত্যাদি)। যার কারণে গৃহায়ণ লিমিটেড নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে ‘এলাইনমেন্ট’ ঠিক করে সংস্থাটি। যে কাজ প্রকল্পের অনুমোদের আগে করার কথা ছিল, প্রকল্প পরিচালকের গাফিলত ও অদূরদর্শীতার কারণে সে কাজ করতে হয়েছে প্রকল্প অনুমোদনের পর। এই কারণেই ভূমি অধিগ্রহণের পুরোপুরি অর্থ ছাড় হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে ওই সময় সর্বমোট প্রকল্পের বিপরীতে মাত্র ৬৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ছাড় দেয়া হয়। যার পুরোটায় জেলা প্রশাসনকে দিয়েছিল সিটি কর্পোরেশন। পুরো অর্থ দিতে না পারায় ভূমি অধিগ্রহণ সম্ভব হয়নি।
পরবর্তীতে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পের ব্যয় চারগুণ বাড়িয়ে সংশোধিত প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। অবশেষে ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর একনেকে অনুমোদিত হয়। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লক্ষ্য ৫৬ হাজার। যা প্রথমবারের তুলনায় চারগুণের বেশি। দ্বিতীয় দফা প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয় ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত। আর মাত্র ৫ মাস বাকি থাকলেও প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি বলতে যে দুইটি এলএম মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, সেই অংশে দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করেছে সিটি করপোরেশন। তাই সেখানে কাজ শুরু করবে সংস্থাটি। আগামী ২৮ জানুয়ারি ওয়াজ্জারপাড়া এলাকা থেকে খাল খনন প্রকল্প উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।