তাক্ওয়া অর্জনই রোজার প্রধান উদ্দেশ্য

46

মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।” (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩) রমজান বিষয়ক পবিত্র কোরআনে আয়াতটি বহুল পঠিত, আলোচিত এবং উচ্চারিত। আয়াতটির গুরুত্ব ব্যাপক। তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে মানে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর যখন রোজা বিধান অর্পিত হয়, তখন হতে কেয়ামত পর্যন্ত সব মুসলমানের ওপর ফরজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল মানে হযরত আদম (আ.) হতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত রোজার বিধান ফরজ ছিল। লক্ষ লক্ষ নবী-রাসূলের আগমনের সাথে সাথে ধর্মের অনেক শরীয়তের বিধান পরিবর্তন হয়, কিন্তু রোজার বিধান কখনো পরিবর্তন হয়নি। এটি মহাকালের বিধান।
বর্তমান পৃথিবী নামক গ্রহটি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। গত ২৫ বছরে কমপক্ষে ২৫ গুণ পরিবর্তন হয়েছে, আগামী ৩০ বছর পর বিশ্ব কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আমরা কেউ কল্পনা করতে পারি না। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পরিবর্তনের যুগের মানুষ আমরা। কিন্তু রোজার বিধান পরিবর্তন হবে না, কারণ রোজা সর্বকালের আত্মশুদ্ধির বিধান।
এই পরিবর্তনের যুগে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে আমরা মঙ্গলগ্রহে ঘর নির্মাণ করতে পারি, সেখানে গিয়ে যদি মারামারি, হানাহানি, পাপাচার, ব্যভিচার, হত্যাকান্ড করি সেটাকে উন্নতি বলা যাবে না। ফ্লাইওভার, টানেল, ব্রিজ, বিমানবন্দর, ইমারত নির্মাণকে প্রধান উন্নতি বলা যাবে না, মানুষের মনের উন্নতিই সত্যিকার বড় উন্নতি যা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে অর্জিত হয়।
মানুষের মন হলো পাওয়ার পয়েন্ট। আলোর গতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার আর মনের গতি তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি। মনকে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। বর্তমান যুগকে বলা হয় যান্ত্রিক সভ্যতার যুগ। এ যুগে কত শত যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে তার কোন ইয়াত্তা নেই, কিন্তু মনের পরিবর্তনের যন্ত্র এখনো আবিষ্কার হয়নি। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই মানুষ মনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। মহান আল্লাহপাক আত্মশুদ্ধির রমজানের রোজা কর্তব্য করেছেন।
বর্তমান তরুণ ও যুব সমাজের চরম অবক্ষয় মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক আইন প্রয়োগ করে বা রাষ্ট্রে নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করে দূর করা যাবে না। কারণ এই সমস্যাটি যতটা শারীরিক তার চেয়ে বেশি মানসিক। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ৭০ ভাগ রোগ মানসিক, ৩০ ভাগ আঘাতজনিত ও জীবাণুবাহী। মনের রোগ ব্যাধি দূর করতে মনের চিকিৎসা প্রয়োজন। দেহ ও মনের সমন্বয়ে মানুষের সৃষ্টি। দেহ মাটি আর রুহ আল্লাহর নির্দেশ বা নুর। মাটি নিম্নগামী আর রুহ ঊর্ধ্বগামী। মাটির বৈশিষ্ট্য মানুষের মধ্যে বেশি হলে মনুষ্যত্ব হারিয়ে মানুষ পশুত্বে পরিণত হয়। আত্মার শক্তি প্রবল হলে মানুষ ফেরেস্তার উর্ধ্বে চলে যায়। রমজানের রোজার কারণে আত্মার উৎকর্ষতার কারণে মানুষ ফেরেস্তার ঊর্ধ্বে চলে যেতে পারে।
ব্যক্তি সমাজ দেশের বাইরের পরিবর্তন চাইলে ভিতরের পরিবর্তন ছাড়া সম্ভব নয়। বাইরের বড় ধরনের মহাপরিবর্তন বা বিপ্লব চান? তাহলে ভিতরটা পরিবর্তন করে দিন বাইরে হয়ে যাবে মহাপরিবর্তন। রমজানের রোজার তাকওয়া দ্বারা ভিতরের পরিবর্তনে সমগ্র জাতির পরিবর্তন করা সম্ভব। রোজার মূল উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া। আমরা যদি গভীরভাবে চিন্তা করি তাহলে বুঝতে পারবো শুধু রোজা নয়, সমস্ত ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন। মানুষ তাকওয়ার মাধ্যমেই সকল অবিচার অপরাধ হতে বাঁচতে পারে। তাকওয়া হলো সকল ভালো কাজের উৎস এবং মন্দ কাজ হতে বিরত থাকার উপায়। যিনি তাকওয়া অর্জন করেন তিনি ‘মোত্তাকি’। মোত্তাকি নিজে সৎ হয়ে মানুষকে সৎ কাজের প্রতি উৎসাহিত করেন।
তাকওয়া শব্দটি ছোট কিন্তু অর্থ অনেক গভীর ও ওজনি। সরল অর্থ আল্লাহভীতি। যে দেশে প্রকাশ্যে রাজপথে ঘুষ দুর্নীতি আদান-প্রদান হয়, দুর্যোগে অসহায় মানুষের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত চাল চুরি করে বাজারে বিক্রি করা হয়, গুদামজাত করা হয়, সে দেশে আইন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে ঘরের চার দেওয়ালের ভিতরের পাপাচার, ব্যভিচার, খুন, নির্যাতন বন্ধ করবে কীভাবে? তার জন্য প্রয়োজন আল্লাহভীতি। রমজানের রোজা তাকওয়া সৃষ্টি করে।
তাকওয়া মানে আল্লাহর ভয়। ভয় মানে তাঁর আদেশ মানা। তাঁর প্রতি অনুগত থাকা। সমাজে মানুষ কী বলবে সে ভয়ে আমরা অনেক পাপাচার করি না, অথচ আল্লাহ সবকিছু দেখছেন, তাঁর সামনে কীভাবে পাপ করবো এ ভীতির নামই ‘তাকওয়া’। অপরাধ বন্ধ করতে হলে সমাজ ‘তাকওয়া’ ভিত্তিক হতে হবে। সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। অপরাধ দমনে তাকওয়াভিত্তিক সিসি ক্যামেরা অন্তরে স্থাপন করতে হবে। মনে রাখতে হবে ফেরেস্তারা আমার সবকিছু রেকর্ড করছে এবং মহান আল্লাহপাক আমাদের গর্দানের শাহী রগের চেয়ে নিকটে আছে।
তাকওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে আড়াই শতাধিক আয়াতে ইরশাদ আছে। সূরা বাকারাতেই আছে ‘তাকওয়া’ শব্দটি ত্রিশবার। পবিত্র কোরআনের প্রায় বিধি বিধানের পর তাকওয়া ছাড়া ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয় বলে ঘোষণা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, “নিঃসন্দেহে আল্লাহ মুত্তাকিদের আমলই কবুল করেন।” (সূরা : মায়েদা, আয়াত : ২৭) তাকওয়ার কারণেই মানুষ মুত্তাকি হয়।
আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে আরো ঘোষণা করেছেন, “আল্লাহর কাছে (তোমাদের কোরবাণীর) মাংস-রক্ত কোনটাই পৌঁছে না, পৌঁছে তাকওয়া। (সূরা : হজ্ব, আয়াত : ৩৭) তাকওয়াবান ব্যক্তিই সম্মানিত। তাই পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয়ই সে সর্বাধিক সম্মানিত যে সর্বাধিক তাকওয়াবান।” (সূরা : হুজারাত, আয়াত : ১৩)
যে মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক তাক্্ওয়া সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করেছেন, সে ‘কোরআন’ ও তাকওয়া ছাড়া মানুষের কোন উপকারে আসবে না বলে কোরআনে পাকের শুরুতেই ঘোষণা করেছেন। কোরআনে ঘোষণা হয়েছে, এই কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তাকিদের জন্য হেদায়ত।” (সূরা : বাকারা, আয়াত : ২)
তাকওয়া অর্জনকারীই মুত্তাকি। তাকওয়া অর্জিত হয় রোজার মাধ্যমে। আবার কোরআন নাজিলের মাধ্যমে রোজা ফরজ হয় এবং রোজার গুরুত্ব অধিক হয়। সরল অর্থে বলা যায়, কোরআনের হেদায়তের জন্য রোজার প্রয়োজন, কোরআনের কারণেই রোজার প্রাপ্তি। সবই একিভূত-একাকার, পৃথক করে দেখার কোন সুযোগ নেই।
ইসলামের দ্বিতীয় ওমরখ্যাত হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রা.) বলেছেন, দিনে রোজা রেখে রাতে পরহেজগারী বা তাকওয়া হয় না, হারাম পরিত্যাগ এবং সব ফরজ যথাযথভাবে পালন করাই পরহেজগারী।
মহান আল্লাহর সাথে বন্দার এক অনাবিল সেতুবন্ধনের নাম তাকওয়া। তাকওয়ার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্যের বন্ধন সুদৃঢ় হয়। অতীতে যারা মর্যাদাবান ছিল তাঁরা কেউই তাকওয়াহীন ছিল না। তাকওয়াবান ব্যক্তিরা জান্নাতবাসী হবে। আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, “উয়িদ্দাত লিল মোত্তাকিন” অর্থাৎ মোত্তাকিনদের জন্য জান্নাত নির্মাণ করা হয়েছে।
আমিরুল মোমেনিন হযরত আলী (রা.) বর্ণনা করেছেন, “তোমরা আমলের চেয়ে আমল কবুলের বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দাও। তোমরা কি মহান আল্লাহর কোরআনের বাণী শুননি? তিনি ইরশাদ করেছেন, “ইন্নামা ইয়াতাকাব্বালুল্লাহু মিনাল মোত্তাকিন।” অর্থাৎ আল্লাহ মোত্তাকিদের আমলই কবুল করেন। (৫:২৭)
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনবার নিজের ‘সিনা মোবারকের’ প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘তাকওয়া’ এখানেই হয়ে থাকে। অর্থাৎ তাকওয়ার জ্ঞান সিনার জ্ঞান, মাথার জ্ঞান নয়। হযরত জিব্রাইল (আ.) হেরা গুহায় কোরআন মহানবী (দ.)’র সিনা মোবারকে চাপ দিয়ে প্রদান করেছিলেন। মাথার জ্ঞান দুনিয়ার জ্ঞান সীনার জ্ঞান আধ্যাত্মিক ও তাকওয়ার জ্ঞান।
কোন ব্যক্তিকে তার বাহ্যিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করে সাধারণ মানুষ চিন্তা করতে পারবেন না, কারণ ভিতরের তাকওয়ার কারণে মহান আল্লাহর কাছে সম্মানিত হতে পারেন। প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্বের ভাষণে ঘোষণা করেছেন, “আজ হতে আরবের ওপর অনারবের, অনারবের ওপর আরবের, কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের এবং শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা হলো তাকওয়ায় ”। তাকওয়া হলো ভিতরের আর বর্ণবৈষম্য হলো বাইরের। ইসলাম অন্তরের বিষয়কে গুরুত্ব প্রদান করে বেশি।
মহান আল্লাহপাকের নিকট কে রাজা, মন্ত্রী, ধনী তার গুরুত্ব নেই, গুরুত্ব আছে তাকওয়াবানের। সে তাকওয়া অর্জন একজন সুইপার, জেলে, পতিতার সন্তানও অর্জন করতে পারে। একজন ভিক্ষুকের সন্তান যোগ্যতায় ও তাকওয়ায় দেশের জাতীয় মসজিদের ইমাম হতে পারে এবং তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে রাজা, মহারাজা, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী নামাজ পড়েন।
মাহে রমজানের রোজার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন অত্যন্ত সহজ। তাকওয়া সম্পর্কে কোরআন হাদিসে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে। বিখ্যাত সাহাবী হযরত ওবাই বিন কাবের কাছে আমিরুল মোমেনিন হযতর ওমর ফারুক (রা.) তাকওয়া সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। তিনি জানালেন, “দুই পাহাড়ের মধ্যখানে সরুপথের দুই দিকে কাটা, সে সরু পথে হাঁটার নাম ‘তাকওয়া’”। আসলে আমাদের চলার পথে কুসংস্কার, শিরিক, হারাম, অন্যায় অবিচারের সব কাঁটা, সেসব কাঁটা অতিক্রম করে পথচলা অত্যন্ত কঠিন। মহান আল্লাহপাক আমাদের সে কঠিন পথ যেন সহজ করেন।

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক