ডিজিটাল হাব হচ্ছে চট্টগ্রাম

89

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে চট্টগ্রামকে সফল হতে হলে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে এগিয়ে থাকতে হবে। এজন্যই চট্টগ্রামে নির্মাণ করা হচ্ছে হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ও ইনকিউবেশন সেন্টার। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে চট্টগ্রাম এমন জায়গায় রয়েছে, যার কারণে চট্টগ্রামের উন্নয়ন মানে বাংলাদেশ উন্নয়ন, চট্টগ্রামের শিল্পবিপ্লব মানে পুরো দেশের শিল্পবিপ্লব। বন্দর নগরীতে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটলে বাংলাদেশকে বিশ্বে নেতৃত্বে দাঁড় করাবে এ চট্টগ্রামই।
গতকাল বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন ডাক টেলিযোগাযোগ ও প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।
অনুষ্ঠানে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসনে আরা বেগম।
মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার আরও বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে যাত্রা করেছিল ‘হেনরি কিসিঞ্জার তলাবিহীন ঝুড়ি’র দেশ মন্তব্য করা বাংলাদেশ। ২০১২ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা যখন বললেন, বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ করা হবে। তখন অনেকে হাসাহাসি করেছেন। কিন্তু আজ ২০১৯ সালে এসে স্কুলের শিক্ষার্থীরাও ভালো করে বুঝে দেশে কী হতে যাচ্ছে। নাছিরাবাদ স্কুলে গিয়েছিলাম। সেখানে শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। তাদের যা ক্লিয়ার কনসেপ্ট, উন্নত দেশের শিক্ষার্থীদেরও এমন ধারণা নেই।
হাইটেক পার্ক নির্মাণে নগরীতে ভূমি জটিলতার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ১২টি জেলায় হাইটেক পার্ক নির্মাণ কাজ যখন বাস্তবায়নের পথে, তখন চট্টগ্রাম ছিল পিছিয়ে। কারণ, হাইটেক পার্ক নির্মাণে জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। কখনও বাকলিয়া, আবার কখনও বিটিসিএলের জায়গায়। কিন্তু কোনভাবে ভূমি জটিলতা নিরসন হচ্ছিল না। সে সময়ে ম্যাজিকের মত জায়গা ঠিক করে দিলেন মেয়ন নাছির।
মেয়র নাছির উদ্যোগী মানুষ- এমন মন্তব্য করে তিনি মন্ত্রী বলেন, বন্দর নগরীর জন্য হাইটেক পার্ক যে কত গুরুত্বপূর্ণ, সেটা মেয়র বুঝতে পেরেছেন। তিনি চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ দেখতে পান। তাই সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব ১১ একর জায়গা দিয়েছেন। সেখানে শুধু হাইটেক পার্ক বা টেকনোলজি পার্ক নয়, আরও অনেক কিছু করা যাবে। মেয়র আমাদের হাতে আকাশ পাওয়ার মত অনেক কিছু দিয়েছেন। এবার মেয়রকে আমাদের দেওয়ার পালা। সিলেটকে ডিজিটাল নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করা হচ্ছে। ঠিক একইভাবে চট্টগ্রামকেও ডিজিটাল নগরীর উদাহরণ হিসেবে গড়ে তুলতে আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকবে।
বন্দর নগরীতে প্রযুক্তির প্রযোজনিয়তার প্রতি জোর দিয়ে আইসিটি মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ‘হাব’ হল চট্টগ্রাম। এখান থেকে সারাবিশ্বের সাথে যোগাযোগ হয়। সেখানে যদি তথ্য প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটে, তাহলে ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের মিরসরাইতে স্পেশাল ইকোনোমিক জোন হচ্ছে। সেখানে প্রযুক্তির বিশেষ চাহিদা তৈরি হবে। যা যোগান দিবে হাইটেক পার্কে সৃষ্ট উদ্যোক্তরা। ২০১৯ সালের পর বাংলাদেশে এমন কোন ইউনিয়ন থাকবে না, যেখানে হাইস্পিড ব্রডব্যান্ড থাকবে না। সড়ক নেটওয়ার্কের মত বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জায়গায় ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক উন্নত করা হবে।
একই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, বন্দর নগরী দু-এক বছরের মধ্যে প্রযুক্তির নগরীতে পরিণত হবে। আর প্রযুক্তি শিল্প উন্নত হলে শিক্ষিত তরুণ-তরুণিদের জন্য জ্ঞানভিক্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্ট হবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন ব্রিটিশ, পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে চট্টগ্রামের ভূমিকা অপরিসীম। এ চট্টগ্রামকে পিছিয়ে রেখে বাংলাদেশ এগোতে পারে না। বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলো শেষ হলে ৫ বছরের মধ্যে চট্টগ্রামে ২০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
তিনি আরও বলেন, ১০ বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশ শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। ১০ বছর আগে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল ৫৬ লাখ, এখন তা ১০ কোটি। শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব রয়েছে ৯ হাজার। আরো ২৫ হাজার ৫’শ টি হবে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও এ থেকে বাদ যাবে না।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ১০ বছরে আইসিটি শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। এখন এ খাতে রপ্তানি আয় ১ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার টার্গেট রয়েছে। আইসিটি খাতে ১০ হাজার ৫’শ নারী উদ্যোক্তা তৈরি করা হবে।
বাংলাদেশ হাইটেক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসনে আরা বেগম বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য এসএসসি ও এইচএসসি পাশ শিক্ষিত বেকারদের দক্ষ মানব সম্পদ পরিণত করা। তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা। মেয়র অনেক জায়গা দিয়েছেন, যেখানে আরও একটি প্রকল্প নেয়া হবে।
পরে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্র্তৃপক্ষের পক্ষে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসনে আরা বেগম ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহা সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন।
চুক্তি অনুসারে, নগরীর চান্দগাঁও থানাধীন চর রাঙ্গামাটিয়া মৌজার বিএফআইডিসি রোড সংলগ্ন ১১ দশমকি ৫৫ একর জমিতে এ হাইটেক পার্ক নির্মাণ করা হবে। যেখানে ২ হাজার ১শ জন প্রশিক্ষক ও উদ্যোক্তা তৈরি করা হবে। চুক্তির মেয়াদ হবে ৩০ বছর এবং শুরুর ৩ বছরের মধ্যে স্থাপনা নির্মাণ শেষ করবেন হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লভ্যাংশের বন্টন হবে সমানে-সমানে।
আগ্রাবাদে হচ্ছে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক : নগরীর দক্ষিণ আগ্রাবাদ সিঙ্গাপুর ব্যাংকক মার্কেটের ৬ষ্ঠ থেকে ১১তলা পর্যন্ত সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে। গতকাল নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে টেকনোলজি পার্কটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।
জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের ৩০ কোটি টাকা অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। গত বছরের ১৮ জুলাই এ দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি সমঝোতা স্মারক চুক্তি সম্পন্ন হয়। এই পার্কে প্রায় ২৫শ’ জনের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রকল্পের ড্রয়িং, ডিজাইনিং এবং কনসালটেন্সি করেন ত্রিমাত্রিক আর্কিটেক্ট অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং। ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং (প্রা.) লি. নামক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
যা যা থাকছে এ টেকনোলজি পার্কে : মার্কেটের ৬ থেকে ১১তলা পর্যন্ত ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক নির্মাণ করা হবে। এ পার্কে সর্বমোট ফ্লোরের আয়তন হবে ১ লক্ষ ৮ হাজার বর্গফুট। প্রতি ফ্লোরে ন্যূনতম ২০ হাজার বর্গফুট আইটি সম্বলিত স্পেস থাকবে। এছাড়াও পুরুষ, মহিলা ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা টয়লেট বøক, টপ ফ্লোরে ৫শ’ জন ধারণক্ষমতার ১টি কনভেনশন হল, ৬ষ্ঠ তলায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ১টি মসজিদ থাকবে।
পার্কটিতে ন্যূনতম ফ্লোর ভাড়া প্রতি বর্গফুট ৩০ টাকা এবং সার্ভিস সার্জ প্রতি বর্গফুট ১০ টাকা করে আদায় করা হবে। ফ্লোর ভাড়া হতে প্রাপ্ত টাকার ১০ শতাংশ রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য পাবে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। বাকি ৯০ শতাংশ দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমান অনুপাতে বন্টন করা হবে।
পার্কটির নির্মাণকাজ উদ্বোধনকালে উপস্থিত ছিলেন চসিক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহা, সচিব আবু শাহেদ চৌধুরী, সিঙ্গাপুর মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রফিক মিয়া, সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন, সহ সভাপতি আলি নেওয়াজ চৌধুরী, মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি আহমদ হোসেন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম ভুঁইয়া, সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ।