জৌলুস হারাচ্ছে ফুলচাষ

131

এক সময় সাতকানিয়ায় ১৪ হেক্টর জমিতে চাষ হতো নানান জাতের ফুল। ফুলচাষ করেই স্বাবলম্বী হয়েছে শত শত কৃষক। কিন্তু ফুলের সেই জৌলুস এখন আর নেই। এখন ফুলচাষ কমতে কমতে অর্ধেকে ঠেকেছে। প্রতিবছর এ সংখ্যা নিচের দিকে। কাগজী ফুল ও প্লাস্টিক ফুলে বাজার সয়লাব হয়ে যাওয়ায় চাহিদা কমে গেছে তাজা ফুলের। যার ফলে উচিত মূল্য না পাওয়ায় হতাশ কৃষকরা। আর হতাশা থেকেই ফুলচাষ কমে যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে। বাজার থেকে আমদানি করা কাগজী ফুল ও প্লাস্টিকের ফুল সরাতে না পারলে একসময় ফুলচাষ বন্ধ হয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। ফুলচাষের সার্বিক অবস্থা জানতে চাইলে উপরোক্ত কথাগুলো বলেন সাতকানিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রতাপ চন্দ্র রায়। শুধু সাতকানিয়ায় নয়, পুরো চট্টগ্রামজুড়েই ফুলচাষের এ অবস্থা বিরাজমান বলে জানিয়েছেন জেলা (ভারপ্রাপ্ত) কৃষি কর্মকর্তা সুশান্ত সাহা।
পুরো বছরই বিয়ে, জন্মদিন, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফুলের চাহিদা রয়েছে। পাশপাশি ২১ ফেব্রæয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসসহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসেও ফুলের চাহিদার কমতি নেই। ১৪ ফেব্রূয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস নিয়ে বয়স্ব মানুষের মাঝে বিরূপ ভাবনা থাকলেও তরুণ-তরুণীদের মাঝে এ দিনটিকে ঘিরে উৎসাহের শেষ নেই। আর এই দিনটিকেই ফুল বিক্রির উত্তম সময় মনে করেন ফুল ব্যবসায়ীরা।
তবে বাজারে আগেকার মত চাহিদা না থাকায় হতাশ চাষীরা। সূত্রে প্রকাশ, দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, বাঁশখালী, চন্দনাইশ, আনোয়ারা, বোয়ালখালী, পটিয়া, কর্ণফুলী, উত্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারী, সীতাকুন্ড, মিরসরাই, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও ফটিকছড়ি উপজেলায় কম বেশি গোলাপ, গাঁদা,গ্লাডিওলাস, জিপসি সহ নানা ফুলের চাষ হয়ে থাকে। আগে শুধুমাত্র শখের বশে বাড়ির আঙ্গিনা কিংবা ক্ষুদ্র পরিসরে ফুলচাষ করলেও এক দশক থেকে ফুলের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা তৈরি হয়। ফলে বাড়তে থাকে ফুলের চাষ। বিভিন্ন উপজেলা থেকে উৎপাদিত ফুল নগরীর ব্যবসায়ীরা কিনে এনে বাজারজাত করত। ফুলচাষে সফলতার মুখ দেখায় কৃষকরাও ঝুঁকেন ফুল চাষে। বাড়তে থাকে ফুলচাষের পরিধি। তবে ফুল নিয়ে তৈরি হওয়া বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বেশিদিন টিকেনি। বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা প্লাস্টিক ফুলের ধাক্কায় ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে সম্ভাবনার এ খাতটি।
জেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান জানান, চট্টগ্রামের ১৫টি উপজেলায় গোলাপ ৪০ হেক্টর, গাঁদা ৩৯ হেক্টর, রজনীগন্ধ্যা ১৫ হেক্টর, গ্লাডিওলাস ৫৯ হেক্টর, জারবেরা ০.৮ হেক্টর, বাগান বিলাস ৩ হেক্টর, চন্দ্রমল্লিকা ২.৬ হেক্টর, জালিয়া ৫ হেক্টর, কসমস ১.৫ হেক্টর, দোলনচাপা ০.৫ হেক্টর, নয়নতারা ০.৫ হেক্টর, মোরগজুটি ০.৫ হেক্টর ও কলাবতি ২.৫ হেক্টর এবং অন্যান্য মিলিয়ে মোট ১শ ৭৩.৭৩ হেক্টর জমিতে ফুলচাষ হয়েছে। সম্প্রতি সাতকানিয়ার খাগরিয়া ইউনিয়নে একাধিক ফুলক্ষেত সরেজমিন পরির্দশন ও চাষীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, অন্তত ১২ বছর আগে সাতকানিয়ার মধ্যে খাগরিয়ায় প্রথম বাণিজ্যিক ফুলচাষ শুরু হয়। চাহিদা বাড়ায় বেড়ে যায় ফুল চাষের পরিধিও। ফুল চাষে যুক্ত হয় নতুন নতুন মুখ। প্রতিবছর একাধিক বার আধিপাত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া খাগরিয়া ইউনিয়নটি নতুনরূপে মানুষের কাছে পরিচিত পায় ফুল গ্রাম হিসেবে। বর্তমানে কমে গেছে ফুল চাষের পরিধি ও চাষীর সংখ্যা।
ফুলচাষী মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘একসময় আমার পিতা আব্দুশ শুক্কুর ফুলচাষ শুরু করেন। আমার বড় ভাই সুমন চট্টগ্রাম শহরের চেরাগী পাহাড় মোড়ে ফুলের দোকানদার। আর আমি এখানে ফুলচাষ করে তা চট্টগ্রাম শহরে পাঠিয়ে দেই। সেখানেই বিক্রয় হয় খাগরিয়ায় উৎপাদিত ফুল।’ চাহিদা কেমন জানতে চাইলে সেলিম উদ্দিন বলেন, এখন আর আগের চাহিদা নেই। খাগরিয়ায় প্রথম পর্যায়ে চাষ শুরু করা আব্দুল মতলব ও আব্দুল গফুর ফুলচাষ ছেড়ে দিচ্ছেন। আমরাও চাষ কমিয়ে এনেছি। চাহিদা কমে গেছে, কমেছে লাভের পরিমাণও। তাই চাষ কমিয়ে এনেছেন তারা। ১০ কানি জমিতে ফুলচাষ করতে খরচের পরিমাণ ৫ লক্ষ টাকা হলেও এখনো পর্যন্ত মূলধন উঠে আসেনি। ক্ষেতে যা ফল আছে তা দিয়ে কোন রকমে মূলধন উঠে আসলেও লাভের কোন সম্ভাবনা দেখছেন না এ কৃষক।
জেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, এক সময় সাতকানিয়াসহ আরো বেশ কয়েকটিন উপজেলায় ব্যাপক আকারে ফুলচাষ হতো। কিন্তু বাজারে প্লাস্টিকের ফুল বাজারে আসার কারণে তাজা ফুলের চাহিদা কমে গেছে। তবে এবারের করোনা ভাইরাসের কারণে চীন থেকে বিভিন্ন পণ্যের পাশপাশি প্লাস্টিকের ফুলও না আসায় দেশীয় ফুলের বাজার কিছুটা চাঙ্গা হতে পারে। তবে সেটি স্থায়ী নয়।
জেলা কৃষি কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) সুশান্ত সাহা বলেন, ফুলের চাহিদা কমেনি। তাজা ফুলের জায়গায় প্লাস্টিক ফুল ও কাগজের ফুল জায়গা দখল করে নেয়ায় তাজা ফুল বাজার হারাচ্ছে। বাজারে যথাযথ মূল্য না পাওয়ায় আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষকরা। বাজার থেকে প্লাস্টিক ফুল সরাতে না পারলে দেশে উৎপাদিত ফুলের চাহিদা বাড়ার কোন সম্ভাবনা নেই। বাজারে চাহিদা না থাকার কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারা আর ফুলচাষ করতে আগ্রহী না। তারা অন্য আইটেম চাষাবাদ করছে। তবুও আমরা কৃষকদের উদ্ধুদ্ধকরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।