চোখ জুড়ানো ঘুঘু

264

পৌষের শীতের অপেক্ষায় থেকে অবশেষে এলো শীত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতুর পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী। শীতের মওসুমে শীত নেই, বর্ষায বৃষ্টি নই। বিশ্ব ক্রমশ উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে। তার প্রভাবে কোথাও বেশি শীত আবার কোথাও বেশি বৃষ্টিপাত। আবার কোথাও তীব্র তাপপ্রবাহে জ্বলে পুড়ে ছারকার হচ্ছে বনাঞ্চল। তারপরও হুস হচ্ছে মানব জাতির? বিশ্বের নেতাদের কর্ণকুহুরে প্রবেশ করছে সে শনি সংতের বার্তা। আলামত দেখে তা মনে হয় না। আর তা না হলে কিন্তু মোড়ল লম্পট ট্র্যাম্প কী জলবায়ু চুক্তি থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে! শুধু নেতৃবৃন্দের দোষ দিয়ে কী হবে। দেশে দেশে নাগরিকবৃন্দ কী নিজেরা সচেষ্ট হচ্ছেন? উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশঘুলো উন্নয়নের জন্য জীবাষ্ম জ্বালানি বন্ধ করেছে? জৈব তথা অর্গানিক চাষাবাদে নিজেদের সম্পৃক্ত করছে? সোজা উত্তর না।
আমাদের চারপাশে বৃক্ষ কমে যাচ্ছে। একটি পরিবেশবান্ধব দেশের মোট ভূমির ২৫ শথাংশ বনভূমি থাকা আবশ্যক। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে আছে মাত্র ১০ থেকে ১২ শতাংশ। প্রকৃতিতে গাছ থাকলে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা যেমন সম্ভব তেমনি মানব জাতির মন ও মনন পরিশুদ্ধ থাকে। বাস্তুতন্ত্র থাকে কাম্য পর্যায়ে। ছোট্ট একটা উদাহরণ দোয়া যাক। আমার পাশের ফ্ল্যাটের ছাদে, মালিক ছাদ বাগান করেছেন। এই বাগানে সকাল সন্ধ্যাবধি বিভিন্ন জাতের শহরে পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে। বাসায় যতক্ষণ থাকি ওই পাখিদের দেখি আর কলকান শুনি। পাখিদের মধ্যে ধাঙ্গর পাখি আমার প্রিয় সখা। সেখানে তিনটি কাক যেন আমাদের পাহারা দিয়ে থাকে। যখনই আমি জানালার পাশে যাই কিম্বা লনে দাঁড়াই তাদের দেখি। কাক আমাদের ভয় পায় না। বেলম্বু গাছে তারা সারাক্ষণ বসে থাকে। এই কাক নিয়ে আমার লেখা ‘প্রিয়সখা কাক’ প্রকৃতি পত্রিকার কাক সংখ্যায় ছাপা হচ্ছে। এ ছাড়া অন্য যারা আসে বিভিন্ন সময়ে বা প্রহরে তারা হলো শালিক যেমন ভাত শালিক, গো শালিক ও ঝুুঁটি শালিক। এছাড়া বুনো কবুতর বা জ্বালানি কবুতর, বুলবুলি, টুনটুনি, মৌটুমী, কোকিল, হলদে পাখি, চড়–ই ইত্যাদি। দোয়েলকে দেখা যায় সার্বক্ষণিক। লনে হাঁড়ি বেঁধে দিয়েছি। এপ্রিলের শেষভাগে দোয়েল দম্পতির হাড়িতে ছানা তোলে। বর্ষা ভালো হলে প্রকৃতিতে তাদের খাবারের প্রাচুর্য থাকে। তখন তারা চারবার বাচ্চা তোলে। অন্যথায় এক মৌসুমে তিনবার বাচ্চা তোলে। প্রতিবার তিন থেকে পাঁচটি ছানা তোলে। তবে যেবার চারপ্রস্ত ছানা তোলে সে বার মা দোয়েলের শরীরে উপর ধকল যায়। দেখলেই বোঝা যায়। বড্ড মায়া হয়। যখন ছানা তোলে তখন মা-বাবা দোয়েল ভীষণ রাগী থাকে। সে সময় লনে যাওয়া যায় না। ছানা তোলা মুওসুমে তাদের ঠোকরে হাত, মাথায় রক্ত বের হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ভেজা কাপড় শুকাতে যখন যাই। বর্ষায় গো মালিক বেশি দেখা যায়। তারা বেশ আমুদে। যতক্ষণ থাকে সারাক্ষণ কিচিরমিচিল নানান কথা বলে। বেশ মজা করে তাদের আলাপন শুনি, বেশ মজা পাই। গো-শালিকের ঠোঁট ও পা হলুদ, চোখে পড়ার মতো। এতো কথা যে কারণে বলা হলে সেটা বলি। আজ সকালে গিন্নি ডেকে বললেন শুনে যাও। আমি তখন ইজি চেয়ারে বসে দৈনিক পত্রিকা পাঠেমন। তারপরও লনে গেলাম। তিনি বললেন, শুনতে পাচ্ছ? না বুঝেই বললাম না, না! তিনি চুপে চুপে বললেন, ঘুঘুর ডাক, শুনতে পাচ্ছ? কান পেতে দিলাম। শোনা গেল মৃদুস্বরের ঘুঘুর ডাক। মনটা প্রফুল্প হয়ে গেল। শৈশব থেকেই ঘুঘুর ডাক আমার ভালো লাগে। বিশেষ করে উদাস দুপুরে। আমার আগের বাসায় এভিয়ারি ছিল। সেখানে ঘুঘু পেলেছিলাম। শুধু তার উদাস করা ডাক শোনার জন্য। বাংলা সাহিত্যের কবি লেখকগণ ঘুঘুর ডাক নিয়ে প্রচুর লিখেছেন। তেমনি উর্দু ও হিন্দি ফার্সি কবি সাহিত্যিকগণ কোকিল ও বুলবুলি নিয়ে বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি সরকারি সিটি কলেজের অধ্যক্ষ (সাবেক) প্রফেসর ঝরনা খানম সুদূর আমেরিকার টেক্সাসে বেড়াতে গিয়ে ফেস বুকে একটি স্টাটাস দিয়েছেন। তাকে গাছের ডালে ২/৩টি ঘুঘুর ছবি দেন। লিখেছেন, এখনও শীত আসে নি। ঘুঘুগুলি শীতের আগমনীতে কাতর কেন? ডাকাডাকি করছে না। বাংলাদেশের শীতের শুরুতে গ্রামবাংলায় যখন সিমের ফুল আসে তখন সিমগাছের ঝোপের ভেতর থেকে ঘুঘুর ডাক শোনা যায়। এ সময়টা হলো ঘুঘুর প্রজননকাল। ঘুঘু প্রজননকালে বেশি ডাকাডাকি করে। শীতেই তাদের ডিম পাড়া, ছানা ফোটানের উত্তম সময়। আমি গত রমজানে মদিনায় ছিলাম। শুক্রবারে হুজুর (স.) রওজায় নামাজের চার ঘণ্টা পূর্বে যাই। প্রাণভরে সালাম ও দরুদ পেশ করার জন্য। তখনও অত মুসল্লী আসেননি। তবে নেহায়েত কমও নয়। রওজার কাছাকাছি বসে সালাম পেশ করছি। এমন সময় দূর থেকে ভেসে এলো ঘুঘুর ডাক। মনটা উতলা হয়ে উঠলো। এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে আপ্লুত হয়ে পড়ি। দু’চোখ ভরে পানি চলে এল। আমার মনে হলো হযরত (স.) সাহাবি পরিবেষ্টিত হয়ে খেজুর পাতায় নির্মিত মসজিদে নববীতে হেলান দিয়ে বসে আছেন। তাঁর আশেপাশে সাহাবী কেরাম। তিনি বয়ান করছেন। তার তখনই ঐ ঘুঘু মিষ্টি স্বরে তাঁর প্রতি সালাম ও দরুদ পেশ করছে। আমি যেন চলে গেছি সে জমানায়। বসে আছি তাঁর পরশে, স্নেহ ধন্য হয়ে। পরের দিন জোহরের নামাজ পড়ার জন্য হোটেল থেকে বের হয়ে রাস্তা অতিক্রম করার সময় বাবলা গাছে দেখা গেল একটি ঘুঘু। রাস্তা অতিক্রম করে পা বাড়াতেই আবার দেখা পেলাম-ফুটপাতের পাশে অন্য একটি। গায়ে গতরে কেষ্টা, তবে রঙে উজ্জ্বলতা আছে। তারপরের দিন দেখলাম বাবলা গাছে ঘুঘু দম্পতি বাসা বাঁধছে।
বিশ্বের সকল দেশেই ঘুঘু দেখা যা। শুধুমাত্র উত্তরমেরুর দেশগুলো ছাড়া। আমার লনের পাশে যাদের দেখেছি। তারা দম্পত্তি, বাসা বাঁধার তদবির করছে। এরা গত বছরও এসেছিল। পাশের বাড়ির ছাদে বাগান সৃজন করেছেন মালিক। সেখানে সকাল বিকাল লোকজনের আনাগোনা। এমন পরিবেশে ঘুঘু বাসা করে না। তারা একটু নির্জনস্থান পছন্দ করে থাকে। একবার বন্ধু আমিনুর রশীদ কাদেরীর মোহরাস্থ বাড়িতে ভোগেল ভালিয়ার ঝোপে ঘুঘু বাসা করেছিল।
আমাদের দেশে আগে প্রায় প্রতি গৃহস্থ বাড়িতে বাগান সৃজন করা হতো। এছাড়া বাড়ির আসে পাশে গাছ-গাছালি লাগানো হতো। এই সকল গাছের ঝোপঝাড়ে পাখিরা বাসা তৈরি করে বাচ্চা ফুটাতো। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বনবনানী যেমন কমেছে তেমনি কমেছে ঝোপ ঝাড়। পাখি ও ছোটখাট বন্যপ্রাণী এবং কীট পতঙ্গ দিনদিন বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা বা¯ুÍতন্ত্রের জন্য অতীত হুমকির বিষয়।
ইদানিং দক্ষিণ চট্টগ্রামে বন্যহাতির পাল লোকালয়ে এসে বেশ উৎপাত করছে। বন্য হেমানপশুর দোষ কী দেব? আমরা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ তাদের চলাচলের পথ, বাসস্থান ও খাদ্য এলাকা দখল করে আছি। তারা যাবে কোথায়? তাদেরও বেঁচে থাকতে হবে। তারা এখন বেঁচে থাকার লড়াইয়ে। যতদিন না পর্যন্ত মানুষ বন্য প্রাণির জন্য নির্ধারিত এলাকা, বাসস্থান ও খাদ্যজোন ছেড়ে না দিবে ততদিন তারা মানুষের ক্ষতি করেই চলবে। আসুন, বন্যপ্রাণি, পশুপাখিদের কথা চিন্তাভাবনা করি। এই পৃথিবীতে তাদের বাঁচার অধিকার আছে। তারা না বাঁচলে মানব জাতি যে ধ্বংস হতে বাধ্য। এ সত্য যত দ্রæত বুঝব-ততই মঙ্গল।
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ‘ভিটায় ঘুঘু চড়ানো’। এই প্রবাদ সম্পর্কে বাংলা ভাষাভাষি সকলেই অবগত আছেন। এর মানে নাজুল বয়ান করার প্রয়োজন বোধ করি না। ঘুঘুর ডাক আমাদের যেমন মোহিত করে, আবেগপ্রবণ করে তেমনি ঘুঘু চড়ানো বিষয়টাও ভীতসন্ত্রস্ত করে বৈকি? আমাদের প্রকৃতিকে আমরা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছি, ক্ষতবিক্ষত করছি তার বিষদ বর্ণনা দেয়া অনাবশ্যক। ইতিমধ্যে মানবজাতি প্রকৃতিতে উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। দেশে দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মানুষের একাট্টা হয়েছে। বিশ্বের নেতৃবৃন্দ ও আজ জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণগুলো বন্ধ/কমানোর জন্য সোচ্চার। তারপরেও ভোগবাদী মানুষকে ক্ষান্ত করা যাচ্ছে না। উত্তরের বরফগলে সাগরের পানির উচ্চতা বাড়াচ্ছে। এই পানি লবণাক্ত। নোনা পানি মানুষের কোন কাজে আসে না। মানব জীবনের জন্য হুমকীস্বরূপ। পরিবেশ ধ্বংস যদি এ মুহূর্তে বন্ধ করা না যায়Ñ তাহলে প্রকৃতি মানব বসতিতে ঘুঘু চড়িয়ে দিলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না।

লেখক : কবি, নিসর্গী, ব্যাংক নির্বাহী (অব.)