চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বাদশাহ মিয়া চৌধুরী ও সতীর্থদের অবদান

451

১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। সে স্কুলটি স্থানবদল করে আইস ফ্যাক্টরি রোডে গিয়ে নাম বদলে হয় কলেজিয়েট স্কুল। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম জিলা স্কুলের স্থানে প্রতিষ্ঠা পায় Chittagong College বাংলায় হয় চট্টগ্রাম কলেজ। কলেজ শুরু হয় F.A (First Art) অর্থাৎ উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত। সে সময়গুলোতে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ছাত্ররা এন্ট্রান্স পাস করার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে যেতেন কোলকাতায়। যারা আর্থিকভাবে দূর্বল ছিলেন তাদের উচ্চ শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ হতো না। তখন চট্টগ্রাম কলেজ ছিলো কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। তখনকার সময়ে দুরত্ব ও আর্থিক বিবেচনায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের ছাত্রদের জন্য কোলকাতায় গিয়ে উচ্চ শিক্ষা বা উচ্চ ডিগ্রি নেওয়া ছিলো একেবারে অসম্ভব, যদিনা থাকে অর্থের জোর। নানা প্রস্তাবনা ও দাবির প্রেক্ষিতে ৩০ এর দশকে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্প্রসারণ কমিটি গঠিত হয়। তারা বাংলায় বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে সুপারিশ করে। এই সুপারিশের কারণ ছিলো
১. চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি। অন্যদিকে পাহাড়, নদী ও সাগর ছিলো ঐতিহ্যের অংশ। তাছাড়া চট্টগ্রাম হচ্ছে নৌ ও সামুদ্রিক বন্দর।
২. চট্টগ্রামের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম ছিলো বা আছে সড়ক পথ, রেলপথ, নৌপথ ও বিমান পথ। এপথগুলো ব্যবহার করে ভারতবর্ষের এবং বিশেষ করে বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রিলংকা, মালদ্বীপসহ দক্ষিণাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে আসতে পারবে। তাছাড়া এদেশগুলোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য খুবই কাছাকাছি এবং প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের মিল খুবই দূরের নয়।
একই সময়ের পূর্বে চট্টগ্রামের সন্তান মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ শুরু করেন। তিনি ৩০/৪০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে আনোয়ারা থানার দেয়াং পাহাড়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য জমি কিনে দান করেছিলেন। প্রথমে তিনি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। পরে অবশ্য সার্বজনীন বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। সে জন্য তাঁকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা বলা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেমে যায়। এরপর চলতে থাকে ভারত বিভক্তির সংগ্রাম। ফলে ১৯৬০ এর পূর্ব পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আর কোন উদ্যোগ কেউ গ্রহণ করেননি।
এখানে বলা প্রয়োজন যে, ব্রিটিশ সরকার চট্টগ্রাম কলেজকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করে। এই প্রস্তাবে স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়েছিলো চট্টগ্রাম কলেজ, সংলগ্ন পাহাড়গুলো, প্যারেড মাঠ, দেবপাহাড়, পার্সিভ্যাল হিল এবং সংলগ্ন এলাকাগুলো। এতে শিক্ষানুরাগী মহল খুশী হলেও জমির মালিকরা খুশী হতে পারেননি। তারা উপরের মহলে তদবির করে জমি অধিগ্রহণ ঠেকিয়ে দেন। ফলে প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন চট্টগ্রামের ঐ অঞ্চলের ভূমি মালিকরা শুধু তাদের নিজের স্বার্থে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৬০ এর শেষ দিকে এসে চট্টগ্রামের শিক্ষানুরাগী মহল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তখন চট্টগ্রামের সকল রাজনৈতিক দল, সমাজশক্তির মানুষরা ঐক্যবদ্ধ হন। ১৯৬১ খ্রিস্টাদের ৭ মে চট্টগ্রামে ৩য় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবিতে সভা হয়। এতে বাদশাহ মিয়া চৌধুরী সভাপতি এবং প্রফেসর আহমদ হোসেন-কে সাধারণ সম্পাদক করে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সাংগঠনিক কমিটি’ গঠন করা হয়। এই কমিটি প্রায় বছরাধিকাল সময় কাজ করে ৯ ডিসেম্বর ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে লালদিঘি মাঠে বিকেল ৩ টায় একটি জনসভা আহŸান করেন। সে সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এ বি এম ফজলুল কবির চৌধুরী। বক্তব্য রেখেছিলেন ইউ এন সিদ্দিকী, বাদশাহ মিয়া চৌধুরী, আবুল খায়ের সিদ্দিকী, অধ্যক্ষ এ.এ. রেজাউল করিম চৌধুরী, অধ্যাপক এ বি এম সুলতানুল আলম চৌধুরী, দীপঙ্কর মহাথেরো, ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ বখতিয়ার, মুহাম্মদ আইয়ুব খান (প্রধান শিক্ষক) এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নেতৃবৃন্দ। এই সভার আগে এবং সাংগঠনিক কমিটি গঠনের পূর্বে ও পরে দেশের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লে. জেনারেল আজম খান- এর নিকট স্মারক লিপি প্রদান করা হয়। সমস্যা দেখা দিয়েছিলো পাকিস্তানের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় একটি শব্দ নিয়ে। যখন দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হয়েছিলো তখন ৩য় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্থান হবে চট্টগ্রাম বিভাগে। ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং জাকির হোসেন সংগ্রাম করে চট্টগ্রাম বিভাগ লিখতে পাকিস্তানিদের বাধ্য করেছিলেন। ফলে সমস্যা দেখা দিলো ‘বিভাগ’ শব্দটি নিয়ে। চট্টগ্রামে যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয় তখন আন্দোলন শুরু করে সিলেট এবং কুমিল্লা। ৩ ফেব্রæয়ারি ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে লে. জেনারেল আজম খান যখন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে সার কারখানা উদ্বোধন করতে গেলেন তখন সিলেটবাসী তাঁকে ঘেরাও করেন। তিনি অবস্থা বেগতিক দেখে গাড়ি থেকে নেমে যান এবং ঘোষণা দেন, “এয়ে থার্ড ইউনিভার্সিটি হযরত শাহজালাল (ব.) ক্যা মুল্লুক সিলেটমে হোগা। ‘অর্থাৎ দেশের তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হযরত শাহজালাল (র.) এর দেশ সিলেটে স্থাপিত হবে (দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আজাদী ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২) এদিকে চট্টগ্রামবাসির পক্ষে ফজলুল কবির চৌধুরী, আবুল খায়ের সিদ্দিকী, বাদশাহ মিয়া চৌধুরী, আজিজুর রহমান, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক, অধ্যাপক এ বি এম সুলতানুল আলম চৌধুরী, প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ, অধ্যাপক আহমদ হোসেন ও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভি.পি, জি.এস পৃথক পৃথকভাবে চট্টগ্রামেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য দৈনিক আজাদীতে বিবৃতি প্রদান করেন।
চট্টগ্রামে আন্দোলন শুরু হয় ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে। ঐতিহাসিক শিক্ষা আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ চট্টগ্রাম তাদের কর্মসূচিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে। অন্যদিকে জোর লবিং এবং আন্দোলন শুরু হয় কুমিল্লাতে। প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন মফিজ উদ্দিন আহমদ তিনি কুমিল্লার লোক। ডন পত্রিকায় সম্পাদক আলতাফ হোসেন সম্পাদকিয়তে লিখেন … পূর্ব পাকিস্তানে প্রস্তাবিত তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম বিভাগে স্থাপনের প্রশ্নে শিক্ষা মন্ত্রী ফজলুল কাদের চৌধুরী এক চরম পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন। কেননা প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী মফিজ উদ্দিন আহমদ হলেন কুমিল্লার লোক। তদুপরি এ ব্যাপারে প্রাদেশিক সরকারই সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের মালিক রাষ্ট্রের প্রসিডেন্ট ও জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল (এন ই সি)। দেখা যাক কে হারে কে জেতে। তবে নিঃসঙ্কোচে বলা যায় চট্টগ্রাম জিলা এ ব্যাপারে প্রাধান্য পাওয়ার সার্বিক যোগ্যতা রাখে (দৈনিক ডন, ২ নভেম্বর ১৯৬২), ৩০ ডিসেম্বর ১৯৬২ এ কে এম আবু বকর চৌধুরীর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয় এবং ৮ জানুয়ারি ১৯৬৩-তে চট্টগ্রামে পূর্ণ দিবস হরতাল পালন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনায়েম খান সিলেট অথবা কুমিল্লার পক্ষে, কোন অবস্থাতেই চট্টগ্রামের পক্ষে নন। এসময় প্রাদেশিক পরিষদের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সদস্যবৃন্দ ফজলুল কবির চৌধুরী, জাকেরুল হক চৌধুরী, এম.এ. জলিল, আজিজুর রহমান, ইসলাম মিয়া এক যৌথ প্রস্তাবে ৩য় বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে স্থাপনের জন্য জোর দাবি জানিয়ে শিক্ষা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে সংসদ থেকে একযোগে ওয়াক অউট করেন। চট্টগ্রামের আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এসময় ফজলুল কাদের চৌধুরী কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রী থেকে হয়ে যান জাতীয় পরিষদের স্পিকার। সে সময় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান গণচীন সফরের সময় স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব প্রদান করেন। ১৯৬৩’র ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় বৈঠকে তিনি কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রী এ টি এম মোস্তফাকে নির্দেশ দেন তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে স্থাপনের জন্য। (দৈনিক আজাদী ১৪ ডিসেম্বর ১৯৬৩) তারপরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে চট্টগ্রাম বিভাগের জেলা নেতৃবৃন্দের বৈঠক ডাকেন গভর্নর মোনায়েম খান, চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে। গভর্নর নিজেই বলেন, সিলেটবাসি বৈদেশিক অর্থের বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ জোগানের প্রস্তাব দেয় এবং তা সমর্থনযোগ্য। চট্টগ্রামবাসির জন্য অবস্থা বেগতিক। তখন আবুল খায়ের সিদ্দিকী ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহŸায়ক গভর্নরের মিলিটারি সেক্রেটারি কর্ণেল ইস্কান্দর করিম এর কক্ষে প্রবেশ করেন এবং রাওয়ালপিন্ডিতে মি. চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ করেন (ইস্কান্দর করিম ছিলেন গহিরা রাউজানের মানুষ) তিনি ফোনে মি. চৌধুরীকে পেলে আবুল খায়ের সিদ্দিকী সব বিস্তারিত বলেন। তখন তিনি গভর্নরের সাথে ফোনে কথা বলেন। কথাগুলো ইস্কান্দর করিম ওভার হেয়ার করেন। চৌধুরী সাহেব বলেন, আমি কোপেন হেগেন থাকাকালীন সময়ে শুনতে চাই যে, আপনি চট্টগ্রামেই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা ঘোষণা করছেন। গভর্নর মোনায়েম খান আবুল খায়ের সিদ্দিকীকে ডেকে বলেন, তোমরা আমাকে অপমান করলে। ঠিক আছে প্রাথমিক ফান্ড হিসেবে আজকের মধ্যে নগদ ২৫ লক্ষ টাকা দিতে হবে। তখনই তারা বের হলেন ফান্ড জোগাড় করতে। সুলতান আহমদ, এম.এ. জলিল, হাজি রাজ্জাক, হাজি জানু, ইসলাম খান, এম.এম ইস্পাহানী, মির্জা আবু আহমেদ প্রমুখ ব্যক্তিগণ এই ফান্ড জোগাড় করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ প্রশাসনের হুমকি ধমকির শিকার হয়েছিলেন। তখন ছাত্রনেতাদের মধ্যে মোহাম্মদ হোসেন খান, আবু বকর চৌধুরী, আশরাফ খান, এ বি এম খায়রুল আলম, মুহম্মদ মহসিন, সাঈদুর রহমান চৌধুরী প্রমুখরা শহরে ও গ্রামে তীব্র আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। এসময় কুমিল্লায় চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী পত্রিকা প্রকাশ্যে পোড়ানো হয়। ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ১৯৬৫’র ১৭ জানুয়ারি পিন্ডিতে মন্ত্রী সভার বৈঠকে প্রস্তাবিত পূর্ব পাকিস্তানের ৩য় বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয় এবং জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলে অর্থ অনুমোদন দেওয়া হয়। সংগ্রাম অব্যাহত রেখে রাস্তায় ছিলেন বাদশাহ মিয়া চৌধুরী, অধ্যাপক আহমদ হোসেন, আবুল খায়ের সিদ্দিকী, ফজলুল কবির চৌধুরী, ইউ.এন সিদ্দিকী এবং অসংখ্য ছাত্র।
বিশ্ববিদ্যালয় সাইট সিলেকশন কমিটিতে ছিলেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, ড. কুদরত-ই-খুদা, ড. এম.এ গণি প্রমুখ শিক্ষাবিদরা। সরকার ৩ ডিসেম্বর ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ড. আজিজুর রহমান মল্লিককে প্রকল্প পরিচালক করে চট্টগ্রামে পাঠান। সাথে ছিলেন ৩ জন কর্মকর্তা। অফিস নির্বাচন করা হয়েছিলো নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির ৩ নম্বর রোডে দো’তলা একটি বাড়িতে। ১১ মাস পরিশ্রমের পর ২৫ অক্টোবর ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিযুক্তি পান ড. এ.আর. মল্লিক। ১৮ নভেম্বর ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন করেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। বাদশাহ মিয়া চৌধুরী এবং অধ্যাপক আহমদ হোসেন ১৯৬০ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন পর্যন্ত ছিলেন অনড়। কমিটির সদস্যরা রাওয়ালপিন্ডি, করাচি, লাহোর অসংখ্যবার গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সফল হওয়ার মূল কারণ ছিলো-
১. সংগ্রাম কমিটির সভাপতি বাদশাহ মিয়া চৌধুরী এবং সেক্রেটারি অধ্যাপক আহমদ হোসেন ও তাঁদের প্রতিজন সদস্যের ত্যাগ ও ঐক্য। প্রত্যেকে ছিলেন ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে।
২. সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন দক্ষ সংগঠক, তারা চট্টগ্রামের সকল রাজনৈতিক দল ও সমাজ শক্তির মানুষদের আন্দোলন সংগ্রামে টেনে আনতে পেরেছিলেন। বিশেষ করে চট্টগ্রামের প্রতিজন সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও ব্যবসায়ী মহল ছিলেন পক্ষের শক্তি।
৩. প্রধান শক্তি ছাত্র সমাজ ও সাংবাদিকদের আন্দোলনে অব্যাহতভাবে যুক্ত রেখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিটি চট্টগ্রামের মানুষের দাবিতে পরিণত করতে সফল হয়েছিলেন।
৪. পত্রিকার সমর্থন বিশেষ করে দৈনিক আজাদী প্রথম থেকেই এই আন্দোলনের পক্ষে ইতিবাচক সংবাদ পরিবেশন করে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলো।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য, কিন্তু যারা জীবন সংগ্রাম করে এই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁদের স্মৃতি আজ বিস্মৃতির অতলে। তাদের কেউ স্মরণ করেন বলে মনে হয়না। এইতো ক’বছর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিক পালন হয়েছে, কর্তৃপক্ষ কি তাঁদের কথা স্মরণ করেছিলেন! তাঁদের কি সম্মানের আওতায় এনে ছিলেন? এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক হল হয়েছে, অনেক রাস্তা হয়েছে, লাইব্রেরি, গবেষণা কেন্দ্র হয়েছে কিন্তু প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা নিবেদিত ছিলেন তাঁদের নামে কি কোন স্থাপনার নাম হতে পারতো না? সম্মান জানানো কি কঠিন কাজ? সৃষ্টির ইতিহাস ঐতিহ্য যদি আমরা ভুলে যাই তাহলে ইতিহাসেও রচিত হয় কলংকিত অধ্যায়। এই দায়ভার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নেবেন কেন? অতীত ও বর্তমান প্রশাসনের সবাই এই দায়ভারের অংশতো অবশ্যই। তবে এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি। ইতিহাস বলে এখন না হলেও একটা সময় আসবে সময়ের প্রয়োজনে এদের মূল্যায়ন করতেই হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ইতিহাসের শাস্তি বড়ই করুন, ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনা।
তথ্য: শিক্ষা ও সমাজসেবায় কিংবদন্তি বাদশাহ মিয়া চৌধুরী গ্রন্থ।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট