চট্টগ্রাম গণহত্যায় ৫ জনের ফাঁসি

32

৩২ বছর আগে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি লালদিঘি ময়দানে পুলিশের গুলিতে ২৪ জন হত্যা এবং তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় পাঁচজনের মৃত্যুদÐাদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে একজনকে ১০ বছরের কারাদÐাদেশ দেয়া হয়েছে। আদালতে গতকাল সোমবার বিকেলে এ রায় ঘোষণা করা হয়।
চট্টগ্রামের বিশেষ জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক জেলা ও দায়রা জজ মো. ইসমাইল হোসেন পাঁচ আসামির মৃত্যুদÐের রায় ঘোষণা করেন।
মৃত্যুদÐপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, কোতোয়ালী থানার তৎকালীন পেট্রল ইন্সপেক্টর গোবিন্দ চন্দ্র মÐল (মামলার বিচার শুরুর পর থেকেই পলাতক), সাবেক পুলিশ কনস্টেবল মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, মো. আব্দুলাহ এবং মমতাজ উদ্দিন। বাকি চার আসামিকে রায় ঘোষণার সময় কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। পরে তাদের আবারও কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গত রবিবার ৪ আসামির সাফাই সাক্ষ্য শেষে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
এ মামলার অপর ৪ আসামির মধ্যে প্রধান আসামি সিএমপি’র তৎকালীন পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদা, কনস্টেবল বশির উদ্দিন ও আব্দুস সালাম মৃত্যুবরণ করেছেন।রায়ের পর এই আদালতের পিপি মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় আনিত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদানই সমীচিন বলে আদালত জানিয়েছেন। আমরা এই শাস্তিই প্রার্থনা করেছিলাম।
রায় ঘোষণার আগে বিচারক বলেন, ৫৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। এ মামলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সাক্ষী। নিরপত্তাজনিত কারণে তিনি সাক্ষ্য দিতে আসতে পারেননি। চার আসামিই সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছেন। প্রমাণ হয়েছে কোনো ধরনের সহিংস ঘটনার আগেই কিলিং শুরু হয়।
প্রসঙ্গত, ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি নগরীর লালদিঘি ময়দানে সমাবেশে যাওয়ার পথে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালালে ২৪ জন মারা যান। আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। এলোপাতাড়ি গুলিতে একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মো. হাসান মুরাদ, মহিউদ্দিন শামীম, এথলেবার্ট গোমেজ, স্বপন কুমার বিশ্বাস, স্বপন চৌধুরী, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, ডি কে চৌধুরী, পলাশ দত্ত, আব্দুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ, শাহাদাত, সাজ্জাদ হোসেন, আব্দুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বি কে দাশ, সমর দত্ত, হাসেম মিয়া ও মো. কাসেম।
১৯৯০ সারের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী মো. শহীদুল হুদা বাদি হয়ে ওই মামলা করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলাটি পুনরায় প্রাণ ফিরে পায়। আদালতের আদেশে মামলাটির তদন্তের ভার পড়ে সিআইডির ওপর। সিআইডি ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে আদালতে। আবারো আদালতের নির্দেশে অধিকতর তদন্ত শেষে ১৯৯৮ সালের ৩ নভেম্বর পুলিশের আট সদস্যকে আসামি করে দ্বিতীয় দফায় অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।
আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ফের ক্ষমতায় আসার পর মামলাটি আবারও গতি হারায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মামলাটি আবারও পুনরুজ্জীবিত হয়। এরপরও ২০১৬ সাল পর্যন্ত মামলাটি চলছিল ঢিমেতালে। ওই বছর মামলাটি বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে আসে। ওই আদালতের পিপি মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীর তৎপরতায় সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রমে গতি আসে।
সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, শিক্ষাবিদ ড. অনুপম সেন, সাংবাদিক নেতা অঞ্জন কুমার সেনসহ বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্যদিয়ে এই আদালতে বিচারকাজের দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়।
মামলার মোট সাক্ষী ১৬৭ জন। গত ১৪ জানুয়ারি ৫৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্যদিয়ে সাক্ষ্য কার্যক্রম শেষ হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে গত রবিবার রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে যুক্তি উপস্থাপন করেন। গতকাল সোমবার আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন করার কথা ছিল। কিন্তু আসামিপক্ষ যুক্তি উপস্থাপনে অসম্মতি জানালে আদালত তাৎক্ষণিকভাবে রায়ের সময় নির্ধারণ করেন।
কী হয়েছিল সেদিন : ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। জনতার ঢলে ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। স্বৈরাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে মুখিয়ে ছিলো সারাদেশ। তৎকালীন ১৫ দলীয় জোট নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার আগমনের প্রহর গুনছিল হাজার হাজার ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী জনতা। বেলা দেড়টার দিকে শেখ হাসিনার গাড়ি কোতোয়ালী থানা হয়ে পুরনো বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন অতিক্রম করছিল।
এ সময় তৎকালীন সিএমপি কমিশনার রকিবুল হুদার নির্দেশে গর্জে উঠে পুলিশ বাহিনীর রাইফেল। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে প্রিয় নেত্রীকে বাঁচাতে মানববর্ম রচনা করেন।
কিছু বুঝে উঠার আগেই শুরু হয় অতর্কিত গুলি। সেদিনের সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী এবং আইনজীবী, চিকিৎসকসহ অন্তত ২৪ জন বেসামরিক লোক শহীদ হন। আহত হন আরও প্রায় তিন শতাধিক ব্যাক্তি। নৃশংসতার একপর্যায়ে পুলিশের কড়া পাহারায় নিহতদের রাতের আঁধারে নগরীর অভয়মিত্র মহাশ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়। অন্যদিকে চলে লাশ গুম করার চেষ্টা।
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারির সেই নারকীয় হত্যাকাÐে নিহতদের স্মরণে আদালত ভবনের প্রধান ফটকে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে নিহত ২৪ জনের নাম লিপিবদ্ধ করা আছে। এটি ১৯৯২ সালের ২৪ জানুয়ারি উদ্বোধন করেন।