কার স্বার্থে মানা হচ্ছেনা, নির্দেশনা

42

পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া মানুষ জীবজন্তুর বেঁচে থাকা কঠিন। একজন স্বাভাবিক মানুষের প্রতিদিন গড়ে ২ থেকে ৩ লিটার পানি পান করা উচিত। এ ছাড়াও মানব জীবনের দৈনন্দিন কাজে পানির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তারপর ও বাংলাদেশে দেখা যায়, নানাভাবে পানির অপচয় হচ্ছে। তার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, আমরা জ্ঞাতসারেও অবহেলায় বেশি পানি অপচয় করে থাকি। অথচ বিশ্বের এমন অনেক দেশ আছে, যাদের পানীয় জল আমদানি করতে হয়। সম্প্রতি সৌদি আরবের অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। মক্কায় এক লিটার মিনারেল পানির মূল্য দুই রিয়াল। এক বাংলাদেশি গাড়ি চালক জানালেন, এক লিটার তেলের মূল্য একরিয়াল। তাহলে বুঝুন আমরা স্বর্গে বাস করছি। কিন্তু সকল উৎসের শেষ আছে, এ কথা আমরা ভুলে যাই। সাম্প্রতিক এক তথ্যে জানা যায়, ভূগর্ভের পানির স্তর প্রতিনিয়তই নিচে নামছে। এটা আমাদের জন্য অশনি সংকেত বৈকি? অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের ধরন ও সময় বদলে যাচ্ছে। কখনো অতিবৃষ্টি আবার কখনো খরা। আরো আছে মানুষের নানা কর্মকাÐ ও জবরদখলের কারণে দেশে নদ-নদীসহ প্রাকৃতিক জলাশয় ক্রমশ বিপন্ন হচ্ছে।
পানির এই গুরুত্ব বিবেচনায় সকল সরকারি ভবনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহারের জন্য ২০০০ সালের ১০ আগস্ট একটি আদেশ জারি করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এতে বলা হয়, সরকারি খাতে নির্মিত ভবনের নকশা এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে যাতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ১৯ বছর পার হয়ে গেলেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই নির্দেশনা কেউ মেনেছে বলে জানা যায় নি। আসলে সব সম্ভবের বাংলাদেশে নির্দেশ না মানা বা না প্রতিপালন করা যেন আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এই নির্দেশনা দিয়েছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই নির্দেশনার মূল উদ্দেশ্য ছিল, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা এবং অগ্নিকাÐের সময় অগ্নিনির্বাপন সহজ করা। এই নির্দেশনা যথাযথভাবে পালনের জন্য সকল সরকারি কর্মকর্তাদের অনুরোধ করা হয়েছিল। অতি দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ নির্দেশনা তো মানাই হয় নি বরঞ্চ অনেকেই এ নির্দেশনা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা প্রকাশ করেন। অর্থাৎ তাঁরা জানতেন না প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী না জানার মধ্যে যাদের নাম উল্লেখযোগ্য তা হলেন, গণপূর্ত অধিদপ্তর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাউজক), হাউস বিল্ডিং রিচার্স ইনস্টিটিউট (এইচবিআরআই) শিক্ষা প্রকৌশল দপ্তর। আমার ধারণা দেশের আরও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা এ নির্দেশনা সম্পর্কে জানে না।
প্রশ্ন হলো. জনস্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে জারিকৃত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই নির্দেশনার বাস্তবায়ন ১৯ বছরে না হওয়ায় এটাই প্রমাণ করে যে, দেশে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি। যে যার মতো চলছে এবং অবৈধ উপায়ে আর্থিক লাভবান হওয়ার ধান্দায় ব্যস্ত। আর সে কারণে দেখা যায় বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য দেয়া অর্থে কাজ না হওয়ায় ফেরত যাচ্ছে। অতএব, সরকারের উচিত হবে প্রতি ত্রৈমাসিকে অনুশাসন কতটা প্রতিপালিত হয়েছে, তা পর্যালোচনা করা এবং জবাবদিহিতার আওতায় আনা।
ভবনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণকে বলা হয় রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং। এতে ছাদে বৃষ্টির পানি চলে যায় ভূতলের চেম্বারে বা ট্যাংকে। সেখান থেকে প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিশ্বের বহু দেশে এই পদ্ধতি অতি জনপ্রিয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশের রাজধানী খোদ ঢাকায় প্রতিদিন ১০০ কোটি লিটার পানির ঘাটতি থাকে। যদি প্রতিটি বহুতল ভবনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে এই ধারণকৃত বৃষ্টির পানি দিয়েই চাহিদার ১৫-২০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হত। একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করা যাক, আমার ফ্ল্যাটের ছাদের পানি সংরক্ষণের জন্য মাত্র ১২ হাজার টাকার প্রকল্প হাতে নেই। দেখা গেল মুষলধারে ২/৩ ঘণ্টার বৃষ্টির পানিতে রিজার্ভার পূর্ণ হয়ে যায়। যা দিয়ে ২৪ পরিবার অনায়াশে দুই দিন ব্যবহার করতে সমর্থ হয়।
দেশের অধিকাংশ সরকারি ভবনের নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণের কাজ করে থাকে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়টি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে অগ্রণি ভূমিকা রাখে নি। একইভাবে সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে যারা অগ্রণি, তারাও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে তেমন ভূমিকা রাখেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃষ্টির পানি দিয়ে বাথরুমে ফ্লাশ করা, গাড়ি ধোয়া, বাগান করার কাজে অনায়াশে ব্যবহার করা চলে। এতে করে ভূগর্ভস্থ পানির চাপ বহুলাংশ কমে যাবে। লে ভবিষ্যত পানির স্তর কমে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক হ্রাস পাবে।
প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন ১৯ বছর অতিক্রান্ত হতে চলল। সময় থাকতে যদি আমরা সতর্ক না হই তাহলে হয়ত আমাদেরও পানি চাহিদায় কাতর হতে হবে। কারণ হিসাবে বলা যায়, আমাদের উজানে ভারত ও চীন নানা প্রকল্পের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করছে। ফলে ভাটির দেশ বাংলাদেশে মরুময়তা দেখা দিচ্ছে। ইতিমধ্যে আমাদের দেশে সুপেয় পানি দিন দিন দুষ্পাপ্য হয়ে উঠছে। আমাদের বিশুদ্ধ পানির প্রধান উৎস হচ্ছে-ভূগর্ভস্থ পানি। কিন্তু এই পানি আজ আর অনেক ক্ষেত্রে নিরাপদ নেই। ভূগর্ভস্থ পানিতে যেমন আছে আর্সেনিকের ভয়াবহতা তেমনি পানির স্তর নেমে যাওয়ার ফলে পানি স্বল্পতা। শুল্ক মওসুমে এখন অনেক জায়গায় গভীর ও অগভীর নলকূপে পানি উঠে না।
এই অবস্থায় আমাদের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ছাড়া বিকল্প নেই। ভবিষ্যতে পানির সংকট মোকাবেলায় এখন থেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। আমার মতে, শুধু সরকারি ভবন নয়, ব্যক্তিগত ভবন, স্কুল কলেজ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতে পারে। সরকারকে এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে দেশ ও জাতির স্বার্থে। ভবিষ্যতে প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পানি ব্যবস্থা করা আমাদের কর্তব্য। আসুন, সরকারের দিকে না থাকিয়ে আমরা নিজ নিজ উদ্যোগে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে উদ্যোগী হই। মধুরা পানির সর্ব উৎকৃষ্ট হলো বৃষ্টির পানি। আর অবহেলা নয়।

লেখক : কবি ও নিসর্গিক, প্রাক্তন ব্যাংক নির্বাহী