কর্ণফুলীর দখলদার উচ্ছেদে মধ্যম জোনই বড় চ্যালেঞ্জ

109

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদী কর্ণফুলী। কর্ণফুলী নদীকে ঘিরেই দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এ নদীর মোহনায় হয় দেশের ৮০ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি। ৩২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে কর্ণফুলীই চট্টগ্রামের প্রাণ। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে দখল, দূষণে এ নদীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে। প্রতিদিন হাজার টন বর্জ্য এ নদীতে পড়ার কারণে পরিবেশ দূষণে জর্জরিত বন্দরনগরীর প্রাণ কর্ণফুলী। এ নদীকে রক্ষা ও দূষণরোধে এবার দেরিতে হলেও ঘুম ভাঙছে প্রশাসনের। উচ্চ আদালতের নির্দেশে কাক্সিক্ষত উচ্ছেদ অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে প্রশাসন।
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বলেন, ‘আমাদের হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী আরএস মোতাবেক যেভাবে বলে দেয়া হয়েছে সেভাবেই কাজ শুরু করা হবে। আমরা কয়েকটা জোনে ভাগ করেছি। প্রথম জোনে আমাদের ২০০ স্থাপনা আছে। সেখানে দশ একরের মতো জায়গা আছে। সব উচ্ছেদ করা হবে।’
জানা যায়, আগামীকাল সোমবার থেকে শহর অংশে তিনটি জোনে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করবে জেলা প্রশাসন। এরমধ্যে বন্দর এলাকা থেকে গোসাইলডাঙ্গা, মাঝিরঘাট থেকে তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু ও তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু এলাকা থেকে মোহরা পর্যন্ত অংশকে তিনটি জোনে বিভক্ত করা হয়েছে। তবে মাঝিরঘাট থেকে তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু এলাকা পর্যন্ত মধ্যম জোনেই সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে উচ্ছেদ সংশ্লিষ্টদের।
উচ্ছেদ অভিযানের আগে গত দুইদিন ধরে মধ্যম জোন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা মাঝিরঘাট থেকে তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু এলাকা পর্যন্ত সীমানা পিলার নির্ধারণ করে লাল দাগ দেয়ার কাজ করছিলেন পতেঙ্গা সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) তাহমিলুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা তিনটি জোনে বিভক্ত করে উচ্ছেদ কাজ চালাবো। এখনো কোন অংশ থেকে উচ্ছেদ শুরু হবে সেটি নির্ধারণ হয়নি। তবে আমরা উচ্ছেদের আগে সীমানা পিলার নির্ধারণ করে লাল দাগ দিয়ে দিচ্ছি। দাগ অনুসারেই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে। তিন জোনের মধ্যে মধ্যম জোনেই স্থাপনা বেশি। যে কারণে সেখানে স্বাভাবিকভাবে চ্যালেঞ্জও একটু বেশি হবে।’
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ৯ জুন কর্ণফুলী নদীর ডান তীরে (শহরপ্রান্ত) বাকলিয়া, মাদারবাড়ি ও গোসাইডাঙ্গা মৌজায় বিএস রেকর্ড (১৯৮৫-৮৭ সাল) নদী হিসেবে রেকর্ডভুক্ত জমির বর্তমান দখলদার ও সরকারি সংস্থা ও তাদের অধীনস্থ স্থাপনাসমূহের তালিকা প্রস্তুত করা হয়। কর্ণফুলীর দুই পাড়ে দুই হাজার ১৮১ দখলদারকে চিহ্নিত করা হয়। জেলা প্রশাসনের করা দখালদারের তালিকায় থাকা বেশিরভাগই বিত্তশালী। এদের মধ্যে রয়েছেন কমপক্ষে ২৫ জন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। মূলত এরাই কর্ণফুলীর জায়গা দখলে নিয়ে বস্তি, কন্টেইনার টার্মিনাল, ডকইয়ার্ড, রাইচ মিল, কোল্ডস্টোরেজ, বরফ মিল ও লবণ মিল গড়ে তুলেছেন। দখলদারের তালিকায় ছয়টি সরকারি সংস্থা থাকলেও উচ্চ আদালত তাদের স্থাপনাগুলো উচ্ছেদের বাইরে রাখতে নির্দেশনা দিয়েছেন।
এ প্রতিবেদকের হাতে আসা আংশিক তালিকায় দেখা যায়, বাকলিয়া মৌজায় ভেড়া মার্কেট সমবায় সমিতি এলাকায় রয়েছেন অর্ধশত দখলদার। এ মৌজায় থাকা দখলদরারা হলেন- মো. আবুল কালাম, মো. নাসির, ফরিদ আহমদ, আবদুছ ছাত্তার, মো. বেলাল, মো. জসিম, মো. মোরশেদ, জীবন, ফরিদুল আলম, আলমগীর চৌধুরী, আমিরুজ্জামান, মো. আক্তার, মো. হেলাল উদ্দিন, মো. করিম সওদাগর, সেলিম সওদাগর, আক্তার কামাল, জামাল উদ্দিন, আবু সুফিয়ান, ইয়াহিয়া খান, মো. ইয়াছিন, ওমর ফারুক, মো. বাদশা, মো. সফিকুল ইসলাম, আবদুর রশিদ, রকিবুল হাসান, আহমদ উল্লাহ, নুরুল হক, লোকমান, মো. হারুন, হেলেনা আক্তার, জোস মোহাম্মদ, মো. শাহ নেওয়াজ, আহমদ নবী, জামশেদুর রহমান, মো. আরমান, মো. জাফর, কবির, মো. খোরশেদ, মহি উদ্দিন, ছগির আহমদ, সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার হাজী পেয়ার মোহাম্মদ গং, হামিদ ওয়াকফ এস্টেট, মোতোয়াল্লী আজিজ খান ইউসুফ খান, পটিয়া বড় উঠানের জাহাঙ্গীর সওদাগর, মোহাম্মদ আলী গং ও মো. ইউসুফ আলী। মাদারবাড়ি মৌজায় আব্দুস সালাম এন্ড ব্রাদার্স, জানে আলম কন্টিনেন্টাল এজেন্সিস, বিকন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস, আব্দুর নুর চৌধুরী গং, মো. ইউনুছ মিয়া, নজু মিয়া ওয়াকফ এস্টেট, পেয়ার আহমদ, আরেফা ট্রেডার্স, মো. সুজন, হাজী গনি মিয়া, হাজী মমতাজুল ইসলাম, বজলুল করিম চৌধুরী, দাদা সল্ট, মেসার্স ইউরো শিপিং, আনোয়ারা এ্যাপারেলস, হাজী মনছুর আলী বিএ এন্ড ব্রাদার্স ও কর্ণফুলী ¯øীপওয়ে এন্ড ডক ইয়ার্ড। গোসাইলডাঙ্গা মৌজায় আব্দুর নবী দোভাষ, একে খান এন্ড কোং, বাংলাদেশ রাইস মিল, রাসেল এন্ড ব্রাদার্স, বেঙ্গল আসাম রাইস মিল ও বাংলাদেশ জুট কর্পোরেশন।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ১৮ জুলাই কর্ণফুলী নদী সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশের’ পক্ষে এড. মনজিল মোরসেদ হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। এর প্রেক্ষিতে নদী দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা অপসারণের নির্দেশ কেন দেয়া হবে না এই মর্মে রুল জারি করেছিল আদালত। ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্টের বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান ও বিচারপতি কাশেফা হোসেনের ডিভিশন বেঞ্চ কর্ণফুলী নদীর তীর দখল করে গড়ে উঠা অবৈধ স্থাপনা সরাতে ৯০ দিন সময় বেঁধে দিয়ে রায় দিয়েছিল। এর রায় প্রকাশের পর আড়াই বছর পেরিয়ে যায়। কিন্তু রায়ের কপি হাতে না পাওয়া এবং উচ্ছেদ বরাদ্দ না থাকায় কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি জেলা প্রশাসন। শেষতক ভূমিমন্ত্রী অর্থ বরাদ্দ দিলে কর্ণফুলীর দখল উচ্ছেদের বাধা কেটে যায়।
কর্ণফুলীর পাড় দখল উচ্ছেদ মামলার বাদী এড. মনজিল মোরসেদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘উচ্ছেদ হচ্ছে জেনে খুব ভালো লাগছে। দুই বছর শেষ হলেও হাইকোর্টের রায়টা যে বাস্তবায়িত হচ্ছে সেটি কর্ণফুলী রক্ষার জন্য একটি ঐতিহাসিক কাজ হবে। প্রশাসনকেও আমরা ধন্যবাদ জানাই। তাঁরা দীর্ঘদিন পরে হলেও কাজটা শুরু করছে। অবশ্যই যেন কাজটি মাঝপথে থেমে না যায়। যে সমস্ত স্থাপনাগুলো তালিকায় আসছে সেগুলো যেন উচ্ছেদ করা হয়।’
উচ্ছেদে শঙ্কা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতাশালী, প্রভাবশালী আছে। উচ্ছেদে গেলেই কোনো চাপের মুখে যদি আবার থেমে যায় আমরাতো আছি। আবার আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে পারবো। সেটা নিয়ে বেশি চিন্তিত না। থামিয়ে দিতে পারে, থামিয়ে দিলেও সেটা আবার চালু করার মতো ব্যবস্থা আমরা করবো।’