করোনায় থমকে গেছে তিন জেলার পর্যটন শিল্প

39

অরণ্য, পাহাড়, ঝর্ণা আর হ্রদের স্বচ্ছ জলরাশির উপচে পড়া সৌন্দর্য্যরে আধার পাহাড়ি তিন জেলা রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি-বান্দরবান। বিনোদনে খোঁজে পাহাড়ে আসা পর্যটকদের আনন্দ আর উচ্ছলতা সাময়িক সময়ের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেয় জীবনের নানান জটিলতা। ইটপাথরের শহর আর যান্ত্রিক জীবনের ক্লান্তি দূর করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ছুটে আসেন পাহাড়ে। কিন্তু নিত্যদিনকার সেই কোলাহল ও কর্ম চাঞ্চল্যে এখন কেবলই ভয় আর শূণ্যতায় পূর্ণ হয়ে আছে। সর্বগ্রাসি করোনাভাইরাসেই থমকে গেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন ব্যবসা। এখাতে এখন দৈনিক লোকসানের পরিমাণ টাকার অংকে অন্তত সোয়া তিন কোটি বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট (খাবারের দোকান), টেক্সটাইল (পাহাড়িদের তৈরি কাপড়), সড়ক ও নৌযান এবং বিনোদন কেন্দ্রকে (বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান) ঘিরেই মূলত পাহাড়ের পর্যটন খাত। গত ১৯ মার্চ থেকে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তিন জেলার সব পর্যটন স্পট ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে আছে। তালা ঝুলছে হোটেল-মোটেল ও কটেজে। বন্ধ হয়ে আছে যানবাহনও। এতে গত দুই মাস ধরে পর্যটন ব্যবসায় মারাত্নক মন্দা দেখা দিয়েছে। খরচ কমাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে হয়েছে। পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত তিন জেলার কয়েক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী অলস সময় কাটাচ্ছেন। আকস্মিকভাবে বেকার হয়ে পড়া শ্রমজীবী এসব মানুষের মনে ভবিষ্যত নিয়ে এখন রাজ্যের হতাশা ভর করে আছে। ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যটনের ভরা মৌসুম। এরবাইরে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে উপচে ভীড় থাকে পর্যটকদের। এরসাথে স্বাধীনতা দিবস ও বাংলা নববর্ষ ঘিরে বিপুলসংখ্যক দেশি বিদেশি পর্যটকের সমাগম হয়। কিন্তু এবার করোনার প্রভাবে হয়ে পড়ে পর্যটক শূণ্য। রাঙামাটি শহরে বেসরকারি ৫০টি হোটেল-মোটেল রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী এখন বেকার। সব মিলিয়ে জেলা শহরে পর্যটনের পাঁচটি খাতে দিনে গড়ে অন্তত দেড়কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া রাঙামাটির সাজেকে ১০৬টি কটেজ-রিসোর্টে ১২ শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারীও বেকার হয়ে আছে। সেখানে রেস্তোরাঁ, যানবাহন, কটেজ-রিসোর্টসহ সব মিলিয়ে প্রতিদিন ৮০ লাখ টাকার বেশি লোকসান হচ্ছে। খাগড়াছড়ি জেলা শহরে ৩২টি আবাসিক হোটেল-মোটেল রয়েছে। এরসাথে অর্ধশতাধিক রেস্টুরেন্ট (খাবারের হোটেল) আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ছয় শতাধিক শ্রমিক কর্মচারী এখন বেকার জীবন যাপন করছেন। এখাতে দৈনিক অন্তত ৪০ লাখ টাকা ক্ষতি হচ্ছে। বান্দরবানে অর্ধশতাধিক আবাসিক হোটেল-মোটেল কটেজ আছে। এরসাথে অর্ধশতাধিক রেস্টুরেন্ট(খাবারের হোটেল) আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ছয় শতাধিক শ্রমিক কর্মচারীও এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। এখাতে দিনে গড়ে অন্তত অর্ধকোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আগমন না থাকায় তাঁত ও হস্ত শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েক হাজার মানুষও আর্থিক সংকটে পড়েছেন। বিশেষ করে স্থানীয় পাহাড়িদের কোমর তাঁতে তৈরি কাপড়, পোষাক, বাঁশ ও বেতের তৈরি হস্তশিল্পে উৎপাদিত জিনিসপত্র বিক্রি বন্ধ হয়ে পড়ায় উৎপাদনও হ্রাস পাচ্ছে। ফলে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে স্থানীয় অর্থনীতিতেও। রাঙামাটি আবাসিক হোটেল-মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ মঈনুদ্দীন সেলিম বললেন, ‘আবাসিক হোটেল-মোটেলের পাঁচ শতাধিক শ্রমিক কর্মচারী এখন বেকার। তবে হোটেল মালিকরা তাদের দেখভাল করছে সাধ্যমত।’ খাগড়াছড়ি আবাসিক হোটেল-মালিক সমিতির সভাপতি কল্যাণ মিত্র বড়ুয়া বললেন, ‘খাগড়াছড়ি জেলা শহরে হোটেল-মোটেল ও অর্ধশতাধিক রেস্টুরেন্ট’র ছয় শতাধিক শ্রমিক কর্মচারী এখন বেকার’। খাগড়াছড়ির তরুণ ব্যবসায়ী আবাসিক ‘হোটেল নূর’র এর স্বত্তাধিকারী তারেক আহমেদ চৌধুরী বলেন, পরিস্থিতি দ্রæত স্বাভাবিক না হলে ব্যবসায় ধস নামবে’। বান্দরবান আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি অমল দাশ বলেন, ‘বান্দরবানে অর্ধশতাকি আবাসিক হোটেল-মোটেলের ছয় শতাধিক শ্রমিক কর্মচারী এখন অলস সময় পার করছেন। এখাতে দিনে গড়ে অন্তত অর্ধকোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে’। রাঙামাটি পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক সৃজন বিকাশ বড়ুয়া বলেন, ‘মার্চ মাসেই ৫০ লাখ টাকা আয়ের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা হাতছাড়া হয়েছে। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত মাসে গড়ে ৩০ লাখ টাকার আয়ের টার্গেট ছিল। সেটাও হচ্ছেনা। এ লোকসান কবে বন্ধ হবে তাও বলা যাচ্ছেনা’। রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মোঃ বেলায়েত হোসেন ভূঁইয়া পর্যটন ব্যবসায় ক্ষতির পরিমাণ হিসেব কষে বলেন, ‘পাহাড়ে পর্যটন শিল্পের সাথে সংশ্লিস্ট পাঁচ খাতে গড়ে দৈনিক কমপক্ষে দেড় কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। সব বন্ধ হলেও দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয়, খাবার, কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিল ও ঘরভাড়া বন্ধ নাই। আমরা ছোট থেকে বড় সব সেক্টরের লোকসানের হিসেব তৈরি করছি। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার (ঋণ) একটি অংশ রাঙামাটিতে আনার চেষ্টা করছি’। সাজেক কটেজ অ্যান্ড রিসোর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুপর্ণ দেব বর্মণ বলেন, ‘ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় সাজেকে ১০৬টি কটেজ-রিসোর্টে ১২ শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী এখন বেকার হয়ে আছে। কটেজ-রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ ও যানবাহনসহ সব মিলিয়ে প্রতিদিন লোকসান গুনতে হচ্ছে ৮০ লাখ টাকার বেশি’।