‘এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে’

171

আফগান বাদশাহ আমানউল্লা দেশের ছোকরাদের পড়ালিখার প্রতি অতি গুরুত্ব দিয়েছেন ফলে সব ছোকরাকে পাঠশালায় আসতে হবে। না আসলে সেপাই তথা পুলিশ পাঠিয়ে ধরিয়ে আনা হবে। সুতরাং কেউ আর স্কুল পালাতে পারবে না। দারুণ ব্যবস্থা এবার শুনুন; ‘কাবুল পৌঁছে যে দিক তাকাই সেখানেই দেখি হরেকরকম সরকারি উর্দিপরা স্কুল-কলেজের ছেলে-ছোকরারা ঘোরাঘুরি করছে। খবর নিয়ে শুনি কোনটা উর্দি ফরাসী স্কুলের, কোনটা জর্মন, কোনটা ইংরেজি আর কোনটা মিলিটারি স্কুলের। শুধু তাই নয় গাঁয়ের পাঠশালা পাশ করে যারা শহরে এসেছে তাদের জন্য ফ্রি বোর্ডিং, ল-জিং, জামাকাপড়, কেতাবপত্র, ইন্সট্রুমেন্টবক্স, ডিকশনারি, ছুটিতে বাড়ি যাবার জন্য খচ্চরের ভাড়া, এক কথায় ‘অল ফাউন্ড’। ভারতবর্ষের হয়ে আমি বল-লুম, ‘নাথিং লস্ট’। প্যারিস ফেরত সইফুল আলম বুঝিয়ে বললেন, ‘আপনি ভেবেছেন ‘অল ফাউন্ড’ হলে বিদ্যেও বুঝি সঙ্গে সঙ্গে জুটে যায়। মোটেই না। হস্টেল থেকে ছেলেরা প্রায়ই পালায়।’ আমি বললুম, ‘ধরে আনার বন্দোবস্ত নেই?’
সইফুল আলম বললেন, ‘গাঁয়ের ছেলেরা শক্ত হাড়ে তৈরী। পালিয়ে বাড়ি না গিয়ে যেখানে সেখানে দিন কাটাতে পারে। তারও দাওয়াই আমানউল্লা বের করেছেন। হস্টেল থেকে পালানো মাত্রই আমরা সরকারকে খবর দিই। সরকারের তরফ থেকে তখন দুই জন সেপাই ছোকরার গাঁয়ের বাড়িতে গিয়ে আসর জমিয়ে বসে, তিন বেলা খায় দায় এবং যদিও হুকুম নেই তবু সকলের জানা কথা যে, কোর্মা-কালিয়া না পেলে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে ছেলের বাপকে তিন বেলা মার লাগায়। বাপ তখন ছেলেকে খুঁজতে বেরোয়। সে হস্টেলে হাজিরা দেবে, হেডমাস্টারের চিঠি গাঁয়ে পৌঁছবে যে আসামী ধরা দিয়েছে তখন সেপাইরা বাপের ভালো দুম্বাটি কেটে বিদায়-ভোজ খেয়ে তাকে হুঁশিয়ার না করে শহরে ফিরবে। পরিস্থিতিটার পুনরাবৃত্তিতে তাদের কোন আপত্তি নাই।” তাহলে বুঝুন এবার ছেলে হাজিরা দেবে, হেডমাস্টারের চিঠি গাঁয়ে পৌঁছবে ততদিনে ছেলের বাপের আর কি থাকবে? তারপরেও রেহাই নেই, তার ভালো দুম্বাটা খেয়েই তবে সেপাইরা যায় এবং যাবার আগে সাবধানও করে দিয়ে যায় না। ভাবুন এবার সেপাই তথা পুলিশ কি জিনিস আর এতক্ষণে তো নিশ্চয় বুঝেও গেছেন আমার উদ্দেশ্য। গত ৬ এপ্রিলের ‘পূর্বদেশ’ দেখলাম শিরোনাম করেছে, ‘থানায় চলে সালিশ বিচার’, তার নিচে লিখেছে ‘বিদ্যমান আইনে ফৌজদারি অপরাধের বিচারের এখতিয়ার পুলিশের নেই’। এখন বাগানে লিখা রয়েছে, বাগানের ফুল ছেঁড়া নিষেধ, ফলে চোর গাছটাই তোলে নিয়ে গেছে সুতরাং বিচার করবেন কোন আইনে? ফৌজদারি অপরাধের বিচার করার ক্ষমতা পুলিশের নাই, কথাটার ভেতরেই তো পুরা ফাঁক। ফৌজদারির বিচার করা যাবেনা, অন্যগুলা করতে পারবে, দেওয়ানি, সালিশ-নালিশ, ইত্যাদি পারবে। তাহলে পুুলিশকে আপনি অভিযুক্ত করবেন কি করে? বোর্ডে লিখা আছে, ঘাস মাড়াইবেন না, এখন আসামি বলল আমিতো মাড়াইনা পারাই। এমন হাজার হাজার ধারায় আইনের ফাঁক রয়েছে আমাদের ওসব দিয়ে পুলিশকে অভিযুক্ত করা বেশ দুরূহ কাজ।
এখানে কথারও অভাব নাই কৌশলেরও অভাব নাই, মুজতবা আলী সাহেবের গল্পটির মতো আরেকটি উদাহরণ দেই। এক বড় লোক বাবার মেয়ে ঘর থেকে ভেগে গেল। বাবা তখন সন্ধান চাই বিজ্ঞাপন দিয়ে পুরস্কার ঘোষণা করলেন এক লাখ টাকা। ক’দিনের মধ্যে দু’জন লোক মেয়েটিকে এনে তার বাবার হাতে তুলে দিল এবং পুরস্কারের একলাখ টাকা নিয়ে গেল। যাওয়ার সময় তারা মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে কণ্ঠে; সোনামণি আবার ভেগে যেও। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, চোরকে বল চুরি কর গৃহস্থকে বল ধরেফেল। প্রবাদটি আলোচ্যজনদের জন্যে বরাবর ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের ফকির আলমগীর সাহেব তাঁর একটি গানে তা আল্লাহর উদ্দেশে ব্যবহার করে ফেলেছিলেন। অতএব গানটি ব্যান্ড করা হয়েছিল, ৪০/৪২ বছর আগের কথা সেটি। সুতরাং সব কথা সব জায়গায় খাটেনা। উক্ত প্রবাদটির মতো বাংলায় আরো প্রবাদ আছে, শিয়ালকে মুরগী বর্গা দেওয়া, রক্ষক থেকে ভক্ষক হওয়া, ইত্যাদি। আসলে বাংলা বড় এক দুখিনী ভূখন্ড, সবাই খালি তাকে শোষণ করেছে, বেনিয়া, বর্গী, তুর্কী, মগ, সকলে শুধু বাংলাকে ভোগ করেছে তাই এসব প্রবাদের জন্ম হয়েছে এখানে। সবাই বাংলার সাথে বেইমানি, বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তো, ওগুলো দেখে দেখে এখন এখানে ভাই ভাইয়ের সাথে বাটপারী করে। এক জাতি বাালী কিন্তু আমরা একে অপরকে বিশ্বাস করতে পারিনা, আমরা একে অন্যের প্রতি কমিটেড নয়। তাই ব্যর্থতার দায় নিয়ে অন্য দেশে যখন মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করেন আমাদের দেশে আমরা তখন পদত্যাগ তো দূরেরকথা ব্যর্থতাকেই স্বীকার করিনা। নিজের ব্যর্থতা এড়াতে পুলিশকে ব্যবহার করি আর তাতে এখানে প্রবাদ হয়, মাছের রাজা ইলিশ দেশের রাজা পুলিশ। অথচ বাংলাদেশে কোন রাজা নাই, এখানে কেউ প্রভু নহে কারো, এখানে ক্ষমতার মালিক জনগণ। সে সুবিধা কি এখানে জনগণ ভোগ করতে পারছে?
কিছু অপরাধের এখানে অতি দ্রæত বিচার হয়ে যায় আবার কিছু অপরাধের হদিসই থাকেনা। ক’বছর আগে চট্টগ্রামে পুলিশের এসপির বউ মিতু খুন হয়েছিল। ক’দিন পর শুনা গেল সেখানে এসপি নিজে জড়িত, তারপর আর খবর নাই। মনে হয় মামলার কবর রচনা হতে চলেছে। বিগত সংসদ নির্বাচনের সময় দেখলাম, হায়রে মামলার ঢল, পেপার-পত্রিকা বলছে গায়েবি মামলা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন কোন গায়েবি মামলা নাই। এখানে একটি বিখ্যাত কবিতার ক’টি লাইন মনে পড়ে গেল: পশে যদি কাকোদর গরুড়ের নীড়ে, ফিরি কি সে যায় কভু আপন বিবরে, পামর? কবি মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধের অংশ, ঈগলের ডেরায় গমন যদি করে সর্প, কখনো কি সে আর ফিরে পাবে নিজ গর্ত, পাপিষ্ঠ? ঈগলের বাসা সাপের জন্যে যেমন থানাও জনগণের জন্যে প্রায় তেমন, ধনী হয়ে গিয়ে ঋণী হয়ে ফিরতে হয়। এমন অনেকে আছে যাদের বাপ-দাদার ভিটায় থানা ঘুঘু চরিয়েছে, এটি নতুন কিছু নয়। বিগত ৪ এপ্রিল শেষ পৃষ্ঠায় দৈনিক পূর্বদেশ, ‘পুলিশ কি তোর বাপ-দাদার কেনা গোলাম…’, দেখে আমি হতবাক। সম্প্রতি যে বিভিন্ন ঘটনাগুলো চোখে দেখছি, কানে শুনছি সব কাগজে-কলমে মিলে যাচ্ছে। গত ২২ মার্চ দেখেছিলাম আরেক খবর, বিচারপতির বাসায় গিয়ে ঘুষ দাবি, এএসআইয়ের দন্ড।
এই যে এতক্ষণ যে কাহিনীগুলা বর্ণনা করলাম সেগুলো তো আসলে নতুন কিছু নয়। যা বর্ণনা করেছি তা তো অতি সামান্য, লিখতে গেলে তো পুরা একটি গ্রন্থ রচিত হবে, সে জায়গায় একটি প্রবন্ধ মাত্র। কোন একটি প্রবাদ যে গঠিত হয় তা দীর্ঘ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আপ্ত হওয়া ফল সুতরাং উল্লেখিত বক্তব্যগুলো সব ওপেন সিক্রেট। কান্ডগুলা সব স্বামী-স্ত্রীর কর্মকান্ডের ন্যায়, করা যায় কিন্তু মুখে বলা যায় না। বিগত নির্বাচনের সময় শত শত মামলা হয়েছে, সব মিছে তা সবাই জানে কিন্তু প্রমাণ নাই। স্ত্রীর বাচ্চা হয়েছে, কিভাবে হয়েছে তা ছেলে থেকে বুড়ো সবাই জানে কিন্তু প্রমাণ চাইলে কে দিতে পারবে? সম্প্রতি ব্রাজিলে এমন একটি কান্ড ঘটেছে, যমজ ভায়ের একজন বাচ্চার বাবা, কিন্তু কেউ এখন আর পিতৃত্ব স্বীকার করছে না। বাচ্চাটির মাও বলতে পারছেনা বাচ্চার বাবা কে? কারণ দু’জনের চেহারা এত মিল, মহিলা নিজেই বুঝতে পারছেনা কোনটি তার প্রেমিক? ডিএনএ টেস্টও পারলনা বাচ্চার বাবা নির্ণয় করতে, অতএব কোর্ট দুভাইকেই বাচ্চার বাবা বানিয়ে দিয়েছে। তার আগে তাদের উদ্দেশে কোর্ট কিছুক্ষণ নৈতিক লেকচার দিয়েছে যে, আপনাদের মধ্যে একজন কিন্তু বাচ্চার বাবা, তা অস্বীকার করে আপনারা নৈতিক অপরাধ করেছেন, কাজটি ভাল করেন নি, মানবতার বিচারে অতি নিকৃষ্ট একটি কাজ, ইত্যাদি ইত্যাদি আরকি। কিন্তু কে শুনে কার কথা, দু’জনেই নীরব, নীতিকথায় কাজ হয়নি। তবে একটি কথা, কোর্ট চাইলে দুজনকেই জেলে দিতে পারত কিন্তু দেয় নাই। কারণ একজন তো নিরপরাধ, একজন অপরাধীর জন্য একজন নিরাপরাধীকে কেমনে শাস্তি দেবে? আর আইনের কথাও তাই প্রয়োজনে হাজার অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক তথাপি একজন নিরপরাধ সাজা না পাক। আমরা কি তা মানছি? আইনকে মানতে হবে, আইনকে শ্রদ্ধা করতে হবে, নিজেকে সৎ হতে হবে এবং নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ হতে হবে, তবেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। সবার মধ্যে সততা, নৈতিকতা আসুক এবং সকলের সৎ ও নৈতিক বিবেক জাগ্রত হোক।
সন্তানের জন্মবৃত্তান্ত যেমন সকলে জানে, দেশের থানা, পুলিশ, মামলাসহ উল্লেখিত বিষয়াদিও সবাই জানে, হাইকোর্ট নিশ্চয় অনেক বেশি জানে। তবে দুঃখের বিষয় সবার মত হাইকোর্টও সেসব ব্যাপারে বরাবরই নীরব থেকেছে, হঠাৎ গত ৩ এপ্রিলের পত্রিকায় দেখলাম, হাইকোর্ট বলছে, ওসিরা এত সাহস কোথায় পায়? আর তা দেখে আমার মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের কতগুলো চরণ মনে পড়ে গেল, যা মেঘনাদ বলছে বিভীষণকে; ‘জানিনু কেমনে আসি লক্ষণ, পশিল রক্ষঃপুরে, হায়, তাত, উচিত কি তব, এ কাজ, নিকষা সতী তোমার জননী, সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ? শূলীশম্ভুনিভ কুম্ভকর্ণ? ভ্রাতৃপুত্র বাসববিজয়ী, নিজগৃহপথ তাত দেখাও তস্করে? চন্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?’ তার আগে কিছু কথা সে লক্ষণকে বলেছে; ‘ মারি অরি পারি যে কৌশলে, ক্ষত্রকুলগ্লানি, শত ধিক তোরে, লক্ষণ, নির্লজ্জ তুই। পশিলি এগৃহে তুই, তস্কর সদৃশ শাস্তিয়া নিরস্ত তোরে করিব এখনি। ক্ষত্রিয়সমাজে রো-ধিবে শ্রবণপথ ঘৃণায় শুনিলে নাম তোর রথিবৃন্দ।’ মেঘনাদ লক্ষণকে বলছে, ‘শত্রুকে যে কৌশলে পারব মারব, ক্ষত্রিয়জাতির কলঙ্ক তোকে শতধিক লক্ষণ তুই নির্লজ্জ। চোরের মত তুই ঘরে ঢুকেছিস, তোকে শাস্তি দিয়ে তবে ক্ষান্ত হব। ক্ষত্রীজাতি তোর নাম শুনলে কানে আঙ্গুল দেবে আর রথ-যোদ্ধাগণ ঘৃণায় মুখ লুকাবে।’ বিভীষণকে বলেছে; ‘ লক্ষণ কেমন করে রাক্ষস পুরীতে প্রবেশ করল, এ কাজ কি তোমার উচিৎ হয়েছে কাকা? তোমার মা নিকষাসতী, ভাই রাক্ষসরাজ এবং শিবদন্ড বাহক কুম্ভকর্ণ। বাসব বিজয়ী তোমার ভ্রাতুস্পুত্র, কাকা তুমি চোরকে নিজের ঘরের রাস্তা দেখালে? চামারকে স্থান দিতে চাও রাজ প্রাসাদে?’ এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে। হায়রে ভাষণ, ভাষণে কি কাজ হয়, তখন হয়নি এখন কি হবে?
এইবার আমাদের আদালতের কথাগুলো একটু শুনি, পত্রিকায় যেই ভাবে এসেছে, ‘ওসিরা থানায় সালিশ বসায় কোন সাহসে? তারা নিজেরা বিচার বসায় কিভাবে? এত সাহস তারা কোথায় পায়? এত ক্ষমতা তাদের কে দিয়েছে? পুলিশের কাজ তো মানুষের সেবা করা, মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সালিশ-বিচার করা নয়। থানাগুলোতে টাকা ছাড়া জিডি হয় না। অনেক পুলিশকে দেখি কষ্টে দিন যাপন করেন। আবার অনেক পুলিশের চারটি-পাঁচটি করে সুন্দর সুন্দর বাড়ি। দেশটা কি চোরের দেশ হয়ে গেল? দুদক কি তাদের দেখতে পায় না? ১৩ হাজার পুলিশ, যারা থানায় বসেন, তাদের কারণে গোটা পুলিশের বদনাম হচ্ছে।’ এ’ত গেল বিভীষণকে বলা কথা, লক্ষণকেও নিশ্চয় তাঁরা কিছু বলেছেন, উল্লেখিত কথাগুলো থেকে সেটাই তো প্রতীয়মান হয়, তবে মনে মনে। দুর্মদ তোরা চোর, পুলিশ জাতির কলঙ্ক, লোকে তোদের ঘৃণা করবে, তোদের দেখে মানুষ দু’হাতে চোখে ঢাকবে, ইত্যাদি আর কি। মেঘনাদ যখন এতক্ষণে বিষাদে কহিল, আদালত কি আর এতক্ষণে হরিষে কহিবে? তাঁরাও এতক্ষণে নিশ্চয় সে বিষাদেই কহিবে, তবে এখানে আদালতকে যদি মেঘনাদ ধরি, থানাকে তবে ধরব লক্ষণ। তাহলে বিভীষণটা কে?

লেখক : কলামিস্ট