এখন আতংকের জনপদ রাজবিলা ও কুহালং

22

বান্দরবান সদর উপজেলার রাজবিলা ও কুহালং ইউনিয়নের মানুষ এখন আতংকে আর উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন পার করছেন। রাজবিলা ইউনিয়নের বাঘমারা, জামছড়ি মুখ, জামছড়ি ভিতর পাড়া, খামাদং পাড়া, আনতা পাড়া এবং কুহালং ইউনিয়নের তাইংখালী পাড়া, উজি হেডম্যান পাড়া, চড়–ই পাড়া, হেব্রণ পাড়া, রাবার বাগান পাড়াসহ আশেপাশের এলাকায় এখন বিরাজ করছে ভীতিময় পরিবেশ। ধারাবাহিক হত্যাকাÐ, হামলা, অপহরণ, গুম, খুনসহ একাধিক অপ্রীতিকর ঘটনা এখানকার মূল আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব এলাকায় স্থানীয় জেএসএস, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও আওয়ামী লীগ সমর্থক নেতা-কর্মীদের ভয় আর আতংক তাড়া করছে।
সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জেএসএস সন্তু লারমা গ্রূপ এবং সংস্কারপন্থী এমএন লারমা গ্রূপ, ইউপিডিএফ এবং সম্প্রতি নতুনভাবে আবির্ভাব হওয়া মগ লিবারেশন পার্টির সদস্যদের মধ্যে চাঁদাবাজিসহ আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এখন ভাতৃঘাতী সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। নিজেদের লড়াইয়ে একের পর এক গুম, খুন, অপহরণের মত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এসব হত্যাকান্ডে বাদ যাচ্ছে না স্থানীয় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষও।
জানা গেছে, পাহাড়ি জেলা বান্দরবানে দীর্ঘদিন জনসংহতি সমিতির একক আধিপত্য ছিল। চাঁদাবাজি-অপহরণের ঘটনা চলমান থাকলেও হত্যার খবর পাওয়া যেত না। কিন্তু সম্প্রতি সংস্কারপন্থী এমএন লারমা গ্রূপ, মগ বাহিনী নামে নতুন একটি সংগঠনের আবির্ভাব হওয়ায় চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটছে হত্যাকান্ডের মতো ঘটনা। তবে এসব হত্যাকান্ডের পেছনে মগ লিবারেশন পার্টি ও জেএসএস উভয়কে গ্রূপকে দায়ী করছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও। তবে ঘুরেফিরে একই এলাকায় গুম, খুন ও অপহরণের ঘটনায় প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছে।
এদিকে বান্দরবান সদর উপজেলায় গেল বছরে ঘটেছে বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ড। এর মধ্যে জেএসএস ও এমএন লারমা গ্রূপের সদস্যদের পাশাপাশি নিহত হয়েছেন আওয়ামী লীগেরও বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী। গত ২৩ মে রাতে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা বান্দরবান পৌর আ’লীগের সহ-সভাপতি চ থোয়াই মং মার্মাকে তার খামারবাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। চারদিন পর রাজবিলা ইউনিয়নের জদার্নপাড়ার গহীন জঙ্গল থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৯ মে ভোররাতে রাজবিলা ইউনিয়নের তাইংখালীতে ক্যচিং থোয়াই মারমা নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মীকে গুলি করে হত্যা করে দুষ্কৃতিকারীরা। তিনি স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। এর আগে ৯ মে জয়মনি তঞ্চঙ্গ্যাকে গুলি করে হত্যা করে অস্ত্রধারী দুষ্কৃতিকারীরা। ৭ মে রাজবিলা ইউনিয়নের তাইংখালী এলাকায় বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে বিনয় তঞ্চঙ্গ্যা নামে এক ব্যক্তিকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহত বিনয় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ঐদিনই পুরাধন তঞ্চঙ্গ্যা নামের একজনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। তার সন্ধান এখনো মেলেনি। তারও আগে গত ১৪ এপ্রিল অংক্য চিং মার্মা নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এর আগে তিনি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জেএসএস ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৭ এপ্রিল গুলিতে জেএসএসের তিনজন, আওয়ামী লীগের পাঁচজন, মগ পার্টি থেকে জেএসএস-লারমায় যোগদানকারী একজন এবং একজন সাধারণ মানুষ নিহত হন।
চলতি বছরের শুরুতে কয়েকটি অপহরণের ঘটনা ঘটে কুহালং ও রাজবিলা এলাকায়। এতে আওয়ামী লীগের এক কর্মীকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। এছাড়াও গত ২ জুলাই কুহালং ইউনিয়নের হেব্রন পাড়ার বাসিন্দা আওয়ামী লীগের কর্মী রুয়াল লুল থাং বমকে সন্ত্রাসীরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। এই কর্মী জেএসএস সন্তু লারমা গ্রূপ থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। সর্বশেষ গত ৭ জুলাই (মঙ্গলবার) নিহত হন জেএসএস সংস্কারপন্থী এমএন লারমা গ্রূপের তিন কেন্দ্রীয় নেতাসহ ছয়জন।
অপরদিকে পাহাড়ে সম্প্রতি বিনষ্টকারী সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও রাজবিলা ও কুহালং এলাকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপনে দাবি জানিয়ে এলাকার সচেতন মহল বলেন, সম্প্রতি পাহাড়ে গুম, খুন, অপহরণ মহামারি আকার ধারণ করেছে। বান্দরবানে হত্যাকান্ড বেড়ে গেছে আর এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ড নিরসনে রাজবিলা ও কুহালং এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করা খুবই জরুরি।
অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মনে করে- আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পাহাড়ে খুনোখুনি করছে। তারা পাল্টা-পাল্টি প্রতিশোধের অংশ হিসেবে গুম, খুন, অপহরণের মত কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এছাড়াও নতুন আবির্ভাব হওয়া সংগঠন মগ লিবারেশন পার্টির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে মনে করেন পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। পাহাড়ে আঞ্চলিক দলগুলোর আধিপত্য বিস্তার এবং পাহাড়ি সংগঠনগুলোর সন্ত্রাসী কর্মকান্ড থেকে মুখ ফিরিয়ে অনেক নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগদান করায় তারাও খুন, গুম ও অপহরণের শিকার হচ্ছেন বলে মনে করেন জনপ্রতিনিধিরা।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইসলাম বেবী বলেন, পার্বত্য জেলার একটি সন্ত্রাসী গ্রূপ চাঁদাবাজি, অপহরণ, গুম, খুন এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোর দাবি জানিয়ে বলেন, অবিলম্বে পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত জনগণ যাতে শান্তিতে বসবাস করতে পারে সেই লক্ষ্যে দ্রুত পাহাড়ে চিরুনী অভিযান চালানো দরকার। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, রাজবিলা ও কুহালং ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ ও নিরীহ মানুষের উপর একের পর এক গুম, খুন ও অপহরণ, গুলি বর্ষণসহ নিরীহ মানুষের উপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটছে। পার্বত্য মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি’র সম্প্রীতির বান্দরবানকে নষ্ট করে যারা সন্ত্রাসের রাজ্য বানাতে চায় তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করতে দেওয়া হবে না। সন্ত্রাস বিরোধী কর্মকান্ড সাধারণ জনগণকে নিয়ে রুখে দেওয়া হবে। সন্ত্রাসীদের এসব কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রত্যেক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে সজাগ থাকার আহব্বান।
বান্দরবান সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বলেন, পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলো বিভিন্ন সময় ভেঙে উপদলের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিজেদের স্বার্থে অথবা একই গ্রূপের ভেতরে অন্তর্কোন্দলের কারনে বিভিন্ন সময় হত্যাকান্ডগুলো সংঘটিত হয়। এলাকাভিত্তিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টিও আছে। তিন পার্বত্য জেলায় একইসূত্রে কাজ করে এই গ্রূপগুলো। আমরা সার্বক্ষণিক তাদের ব্যাপারে নজর রাখার চেষ্টা করছি। তারপরও দু:খজনক হলেও সত্য বিভিন্ন সময় হত্যাকান্ডের মতো ঘটনা ঘটছে। আমরা বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত হত্যাকান্ডের চার্জশিট দিয়েছি। কিছু কিছু মামলা যেগুলো আমরা ক্লু সংগ্রহ করতে পারিনি ওগুলোরও ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছি। বর্তমানে যেসব মামলা আমাদের কাছে তদন্তাধীন রয়েছে সেগুলো আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। তদন্তের স্বার্থে আমরা সবকিছু এখনই জানাতে পারছি না।