একে অপরের দিকে ‘ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার হুমকি দিয়েছিল ভারত-পাকিস্তান’

61

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে গত মাসে যেভাবে উত্তেজনা ছড়িয়েছিল তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে তা বেশিদূর গড়ায়নি বলে খবর। পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশ দুটির উত্তেজনা কমিয়ে আনতে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনও ভূমিকা রেখেছেন বলে এ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পাঁচটি সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
পশ্চিমা কূটনীতিকসহ নয়া দিল্লি, ইসলামাবাদ ও ওয়াশিংটনের সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে, কাশ্মীর নিয়ে উত্তেজনার এক পর্যায়ে ভারত পাকিস্তানের দিকে অন্তত ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার হুমকি দিয়েছিল। এর পাল্টায় ইসলামাবাদের প্রতিক্রিয়া ছিল, নয়া দিল্লি যতগুলো ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়বে তারাও তার ‘তিন গুণ’ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে প্রতিক্রিয়া দেখাবে। হুমকি-পাল্টা হুমকির মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে চলে যাচ্ছিল এবং পারমাণবিক অস্ত্রধর দেশ দুটি কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে সর্বাত্মক যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এগুলো হুমকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, কিন্তু যেসব ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা হচ্ছিল সেগুলো প্রচলিত অস্ত্রের চেয়ে বেশি কিছু না হলেও তা ওয়াশিংটন, বেইজিং ও লন্ডনের কর্মকর্তাদের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল। ২০০৮ সাল পরবর্তী দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় এ সামরিক সংকট ও তা নিরসনে সব কূটনৈতিক তৎপরতার উদ্যোগগুলোকে একসূত্রে গেথে প্রতিবেদন করেছে রয়টার্স। এ সংকটের সূত্রপাত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীর গাড়িবহরে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদের আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জনেরও বেশি সেনা নিহত হওয়ার পর। এর প্রতিক্রিয়ায় ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের বালাকোটে হামলা চালালে ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির মধ্যে উত্তেজনা তীব্র হয়ে ওঠে।
ভারতীয় বিমানবাহিনীর দাবি তারা বালাকোটে জইশ-ই-মোহাম্মদের একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে হামলা চালিয়েছে। বালাকোটে জঙ্গিশিবিরের অস্তিত্ব অস্বীকার করা ইসলামাবাদ বলছে, ভারতীয় বাহিনী খালি পাহাড়ি এলাকায় বোমা হামলা চালিয়েছে। বালাকোটের হামলাকে কেন্দ্র করে ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশ দুটির বিমানবাহিনী একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এর সূত্র ধরেই ১৯৭১ সালের পর পাকিস্তান প্রথমবারের মতো তাদের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ভেতর ভারতীয় একটি বিমানকে ভূপাতিত করে এর পাইলটকে আটক করে।
কয়েক ঘণ্টা পর পাকিস্তানি জিজ্ঞাসাবাদকারীদের সঙ্গে আটক বিমানচালকের হাত ও চোখ বাঁধা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাও নয়া দিল্লিকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। এপ্রিল-মেতে সাধারণ নির্বাচনের আগে বিমানের পাইলট আটকের ঘটনা ভারতের বিজেপি সরকার ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ব্যাপক চাপে ফেলে দেয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র প্রধান অসীম মুনিরকে টেলিফোনে বলেন, পাইলট আটক হলেও ভারত ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ অবস্থান ও প্রচারণা থেকে পিছিয়ে আসবে না। ভারতীয় সরকারের একটি সূত্র ও এ কথোপকথন সম্পর্কে অবগত পশ্চিমা এক কূটনীতিক রয়টার্সকে এমনটাই জানিয়েছে।
দোভাল মুনিরকে জানান, ভারত সেসব জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করছে যারা পাকিস্তানের মাটি থেকে অবাধে তৎপরতা চালাচ্ছে এবং নয়া দিল্লি এ যুদ্ধ প্রস্তুতি আরও বাড়াবে। প্রায় একইসময়ে ভারত পাকিস্তানের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার হুমকি দেয় বলে পরে পাকিস্তান সরকারের এক মন্ত্রী ও ইসলামাবাদে নিযুক্ত এক পশ্চিমা কূটনীতিক পৃথকভাবে রয়টার্সকে নিশ্চিত করেছে।
কে এই হুমকি দিয়েছে, পাকিস্তানের কাকে দিয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ভারত ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে ‘যুদ্ধের সময়ও যোগাযোগ ছিল, এখনও আছে’, বলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাকিস্তানের ওই মন্ত্রী।
তিনি জানিয়েছেন, ভারতের ওই হুমকির প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান জানায়, নয়া দিল্লি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লে ইসলামাবাদও পাল্টা জবাব দেবে। “আমরা বলেছি, তোমরা যদি একটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ো, আমরা তিনটি ছুড়বো। যাই ভারত করবে, আমরা তার তিনগুণ করবো,” বলেছেন তিনি। এই তথ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে দোভালের দপ্তর সাড়া দেয়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার হুমকি বিষয়ে ভারত অবগত নয় বলে রয়টার্সের এক প্রশ্নের জবাবে জানান ভারতের এক সরকারি কর্মকর্তা। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীও এই বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং মুনিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও রয়টার্সের জিজ্ঞাসার কোনো জবাব দেয়নি।
ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতা কিম জং উনের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে চুক্তির চেষ্টার মধ্যেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে এ উত্তেজনা তৈরি হয়। এর মধ্যেই ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে ও ২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প-কিম বৈঠকের দ্বিতীয় দিনে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোল্টন দোভালের সঙ্গে কথা বলে উত্তেজনা নিরসনের উদ্যোগ নেন বলে নয়া দিল্লিতে নিযুক্ত এক পশ্চিমা কূটনীতিক ও ভারতীয় এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। হ্যানয়ে থাকা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও পরে ভারত ও পাকিস্তান দ্ইু দেশকে সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ খোঁজার আহব্বান জানান।
‘মন্ত্রী পম্পেও সরাসরি কূটনৈতিক যোগাযোগ চালিয়েছিলেন, যা দুই পক্ষের উত্তেজনা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে,’ ৫ মার্চ ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী মুখপাত্র রবার্ট পালাদিনো বলেন। দুই দেশের মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র হুমকি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র জানত কি না এ বিষয়ে রয়টার্সের এক জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। পম্পেও ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা দোভাল এবং ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয়, যথাক্রমে সুষমা স্বরাজ ও মাহমুদ কোরেশীর সঙ্গেও কথা বলেছেন বলে জানিয়েছেন পালাদিনো।
গত সপ্তাহে সিঙ্গাপুরে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের অ্যাডমিরাল ফিল ডেভিডসন জানান, ভারত-পাকিস্তানের ওই উত্তেজনার মধ্যে তার সঙ্গে ভারতের নৌপ্রধান সুনীল লানবার যোগাযোগ ছিল। যোগাযোগের ধরন কী ছিল সে বিষয়ে লানবার দপ্তর তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেননি। চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও সেসময় উত্তেজনা নিরসনে ভূমিকা রেখেছিল বলে জানিয়েছেন পাকিস্তানি ওই মন্ত্রী। তবে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর প্রতিবেশী দেশ দুটি তিনবার যুদ্ধে জড়িয়েছিল, যার শেষটি হয়েছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে।