ইতিকাফের একটি মকবুল মারকায

14

শাহাবুদ্দিন আহমদ চৌধুরী সেলিম

সময়টা সম্ভবত ২০০৭ বা ২০০৮ সাল হতে পারে। হঠাৎ করেই অন্তরে ইতিকাফ করার বাসনা জাগ্রত হলো। মনে মনে একজন হক্কানি আলেমে-দীন, কামেল বুজুর্গ ব্যক্তির সাথে সময় কাটানোর উদগ্র বাসনায় খোঁজখবর নেয়া শুরু করলাম। মানসপটে কয়েকটি জায়গার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে, ইতিকাফের জন্য বিভিন্ন সহায়ক পরিবেশগুলো বিবেচনায় নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলাম। এমন সময় রমাদানের শুরুর দিকে আমার এক বন্ধু, আমাকে নিয়ে গেলেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে জামি’আ ইসলামিয়া ওবাইদিয়া নানুপুর মাদরাসায়। তখন সেখানে আমার ওই বন্ধুর পিতাসহ প্রায় ৪০-৫০ জন লোক দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে পুরো রমাদানব্যাপী ইতিকাফের জন্য অবস্থান করছিলেন। তাদের কারো কারো সাথে পরিচয় হলো এবং সংক্ষিপ্ত কিছু কথাও হলো।
এরপর দেখা করতে গেলাম মাদরাসার তৎকালীন মহাপরিচালক খতিবুল ইসলাম শায়খুল মাশায়েখ আল্লামা শাহ জমিরউদ্দিন রহমাতুল্লাহ আলাইহির সাথে। প্রথম সাক্ষাতেই উনি আমাকে খুব আপন করে নিলেন, আমিও অন্তরে উনার জন্য গভীর মমত্ববোধ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অনুভব করতে শুরু করলাম। খুব অল্প সময়ের পরিচয়পর্ব ও আলোচনায় আমি উনার শান্ত সৌম সফেদ চেহারা, উদারতা, প্রজ্ঞাপূর্ণ নসিহা, ব্যক্তিত্বপূর্ণ চাহনি ও মানুষকে আপন করে নেয়ার মানসিকতা দেখে বিমোহিত হয়ে গেলাম। বিশেষ করে উনার চেয়ে বয়স আমল আখলাক জ্ঞান-গরিমায় অনেক ছোট হওয়ার পরও অন্য মানুষের প্রতি উনার সর্বোচ্চ সম্মানজনক আচার-ব্যবহার দেখে সত্যিই অবাক হলাম! আসার সময় সবিনয়ে অনুমতি চাইলাম, যাতে রমাদানের শেষ ১০ (দশ) দিন উনার এবং উনার সাথীদের সাথে মাদরাসা মসজিদের মেহমান হয়ে থাকতে পারি। আলহামদুলিল্লাহ! উনি খুশি মনেই অনুমতি দিলেন।
সেই থেকে আমার নানুপুরের সাথে আসা যাওয়া শুরু হলো। আল্লাহর রহমতে যা আজও বিদ্যমান আছে। আমার মধ্যে কোনো ধরনের দীনি ও দুনিয়াবী যোগ্যতা না থাকা সত্তে¡ও শুধুমাত্র হুজুরের স্নেহধন্য হওয়ার কারণে উনার সন্তানগণ আমাকে তাঁদের আপন ভাইয়ের মতোই দেখেন এবং আজ পর্যন্ত আমিও তাঁদের দেয়া ভাতৃত্বের মর্যাদা রক্ষা করে চলার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
বিশাল আয়তনের এ মাদরাসায় সারা বছরজুড়ে প্রায় নয়-দশ হাজার ছাত্রদের নিয়ে ইলমচর্চার এক নিরবিচ্ছিন্ন কর্মপ্রচেষ্টা চলতে থাকে। আর রমাদানের কয়েকদিন আগে থেকেই মাদরাসা কর্তৃপক্ষের ব্যস্ততা বেড়ে যায় ইতিকাফের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে থাকা মু’তাকিফ ভাইদের মেহমানদারির আয়োজন প্রচেষ্টায়। থাকা-খাওয়া বিশেষ করে ইফতার, রাতের খাবার, সেহরির আয়োজনে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা, ইবাদতের পরিবেশ ও রুটিন বিবেচনায় এটি একটি অনন্য বৈশিষ্ট্যমÐিত ইতিকাফ মারকায। শেষরাতে কিয়ামুললাইল, যিকির-আসকার ও ব্যক্তিগত ইবাদত-বন্দেগির যে চিত্র আমি সেখানে দেখেছি, নিঃসন্দেহে তা রমাদান পরবর্তী জীবনে যে কোনো মানুষের অন্তরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পথে চলতে অনুপ্রাণিত করবে।
মু’তাকিফ ব্যক্তিদের খেদমতে মাদরাসা ছাত্রদের নিঃস্বার্থ ও অক্লান্ত পরিশ্রম আপনাকে মুগ্ধ করবেই। বর্তমানে মাদরাসার সুযোগ্য মুহতামিম মাওলানা সালাহউদ্দিন নানুপুরীর প্রত্যক্ষ তত্ত¡াবধানে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ ও আলেম-ওলামাদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় প্রায় দু’হাজার বা তারও অধিক ধর্মপ্রাণ মানুষের অংশগ্রহণে এটি একটি অত্যন্ত সফল ধর্মীয় শিক্ষামূলক নিবিড় আত্মিক কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। সময়-সুযোগ থাকলে আগ্রহী সবাইকে সেই ইতিকাফ মারকাযের সাথে পরিচিত হবার আহŸান জানাই। রমাদানে মু’তাকিফ ভাইদের উদ্দেশ্যে দেয়া ধ্রæবতারাতুল্য আল্লামা শাহ জমিরউদ্দিন রহ.-এর মূল্যবান নসিহাসমূহ হতে কয়েকটি নসিহা পাঠকসমীপে পেশ করছি। জীবনকে মূল্যবান করতে হলে, মউত দামি হউক এবং হাশর ভালো হউক তা চাইলে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নবিজির সুন্নাত অনুযায়ী চলার চেষ্টা করুন।
মসজিদে বসে একে অন্যের সাথে গল্পগুজবে সময় কাটাবেন না। এতো কথা কিসের? কথা যদি বলতেই হয়, তবে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে নিরবে আল্লাহর সাথে কথা বলুন।
কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে, তা যদি সামান্য জুতার ফিতাও হয়, মানুষের কাছে না চেয়ে সরাসরি আল্লাহর কাছে চান।
অন্যের সমালোচনা ও দোষ-ত্রæটি তালাশ করবেন না। নিজেকেই বেশি গুনাহগার ভাবুন, অনুতপ্ত হয়ে বিনীতভাবে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করুন।
মুনাজাতে তিনি প্রায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে কাতরভাবে বলতেন- হে আল্লাহ! পৃথিবীতে আপনার তো অসংখ্য বান্দা রয়েছে, কিন্তু আমার তো আপনি ছাড়া আর কোনো আল্লাহ বা মাবুদ নেই। দয়া করে আপনি আমাকে, আপনার বান্দা হিসেবে স্বীকৃতি দিন এবং আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে কবুল করে নিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী