আসন্ন বাজেট ও আমাদের প্রত্যাশা

23

লিটন দাশ গুপ্ত

“এল্যা অইলি আঁরা হোইল্যা গোরি চোইল্লুম, হরোনায় মারের একমিক্যা, ম্যানসে মারের আরেকমিক্যা, আবার বাজেড আইলে সরগারে মারিইবো অন্যমিক্যা। আঁরা জাইয়োম হনমিক্যা! সরগারে বিয়াগ্গুনেরে টিঁয়া দের, ফ্যাক্টরির মালিগঅরে টিঁয়া দের, আঁরা নফাই কিন্তু! সরগারত্তে টিঁয়া ছাবানোর মেশিন আছে, বিয়াগ্গুনেরে দিলে অসোবিদা হন্ডে ?”
গত কয়েকদিন আগে টেক্সি করে অফিসে যাবার সময়, চালক ঐ কথাগুলো বলেছিল। উল্লেখ্য, সে চলমান বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ একেরপর এক শুনিয়ে যাচ্ছিল, প্রসঙ্গক্রমে সরকারের নির্দেশ মোতাবেক মাস্ক পড়া ও নিজের সচেতনতা নিয়ে গর্ববোধ করছিল, সেই বিষয়ে পরে আসছি। তার আগে শিরোনাম অনুযায়ী মূল বিষয় আসি। টেক্সি চালকের কথার প্রসঙ্গ নিয়ে বলতে চাই, আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ, বিশেষ করে শ্রমজীবী বা অশিক্ষিত শ্রেণির ব্যক্তিগণ এই টেক্সি চালকের মত মনে করে, সরকারের কাছে টাকা তৈরির মেশিন আছে; আর চাইলে যে কোন সময় হাজার হাজার কোটি ছাপাতে পারে। চলমান লকডাউন বা যেকোন সংকটে, টাকা ছাপিয়ে সকল মানুষকে দেয়া যেতে পারে!
এই সকল মানুষ অর্থনীতির এতসব পরিভাষা বুঝেনা; জানেনা মুদ্রাস্ফীতি কি, কিংবা মুদ্রানীতি অর্থমিতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, টাকার তারল্য সংকট, ব্যয় সংকোচন নীতি ইত্যাদি শব্দগুলো। তাদের এই সকল শব্দ জানারও দরকার নেই। তবে বাজেটের পর তারা জানতে চাই কোন জিনিসের দাম বেড়েছে কোন জিনিসের দাম কমেছে। দুবেলা দুমুটো ভাত খেতে চায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, যাতায়ত খরচ, মোবাইলে কথা বলা ইত্যাদি খাতসমূহ তাদের আয়ত্বে দেখতে চাই। শুধু ওরা কেন, আমাদের সকলের প্রত্যাশা থাকে, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য যেন ক্রয় সীমায় থাকে। মোবাইলে কলের বিষয়ে বলি, মোবাইল থেকে এখন ২১ শতাংশ কর গ্রহণ করা হয়। শোনা যাচ্ছে, এবারের বাজেটে আরো ৫ শতাংশ কর বৃদ্ধি করতে পারে। এমনিতে করোনার কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে, কাছের মানুষ চলে গেছে অনেক দূরে। তার উপর মোবাইলের কথায় আরো টেক্স আরোপ করলে, দূরে চলে যাওয়া মানুষ, চলে যাবে আরো বহু দূরে। বর্তমানে সামাজিক দূরত্বের কারণে মানুষের মনে অদৃশ্য মানবিক দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। যখন মানুষ আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধবের সাথে মোবাইলে কথা বলতে পারবেনা, তখন এই সামাজিক ও মানবিক দূরত্ব থেকে সামাজিক সংঘাতে রূপ নিবে। স্বাভাবিক ভাবে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হবে অরাজকতা, অস্থিরতা, অমানবিকতা; সৃষ্টি হবে সামাজিক অবক্ষয়। এমনিতে মানুষের সামগ্রিক পরিস্থিতি করোনার কারনে ভালো নেই। তার উপর বড় আকারের বাজেট শুনলে আমাদের মত সাধারণ মানুষে মনে ভয় হয়। কারণ সরকার রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করতে গিয়ে ভ্যাট, টেক্স, শুল্ক ইত্যাদি বাড়ালে দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পাবে। আর করোনা সময়কালীন সময়ে বা তৎপরবর্তী কালে বহুমুখী সমস্যা সৃষ্টি হবে। এমনিতে গত কয়েক মাস যাবৎ করোনার প্রভাব, ক্ষুধা ও অভাব মানুষকে গ্রাস করতে চলেছে; শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয় সমগ্র বিশ্ববাসীকে। আজ কোটি কোটি মানুষ এমন অবস্থায় রয়েছে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বলতে কিছু নেই। দারিদ্র এখন বিস্তৃত হচ্ছে সমগ্র বিশ্বে। দিন দিন দারিদ্র্যতার পরিমাণ আর গভীরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই সকল মানুষকে ক্ষুধা নিবৃত্তি ও খাদ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা আনতে হবে বাজেটে।
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে যতটা বুঝি, ২০২০-২১ সালের বাজেটে দুটি বিষয় সামনে রেখে পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। প্রথমটি করোনা মহামারী পরিস্থিতি মোকাবেলা, দ্বিতীয়টি করোনাত্তোর দেশ গঠনের প্রস্তুতি স্বরূপ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
এই অবস্থায় সরকারি বিভিন্ন খাতে ব্যয় বরাদ্দ কমিয়ে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতকে প্রয়োজনে ভর্তুকির মাধ্যমে সহায়তা করে আপাতত মহামারি মোকাবেলায় কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে, মানুষ বাঁচানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এই অবস্থায় সরকারে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে গিয়ে যাতে নি¤œ আয়ের মানুষ বা মধ্যবিত্তের ঘরে ‘করোনা ভাইরাস’-এর চেয়ে আরো বেশী শক্তিশালী ‘অভাব ভাইরাস’ ঢুকে না পড়ে সেই দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
সত্যিকথা হচ্ছে শিক্ষক হিসাবে শিক্ষা নিয়ে বলার যতটুকু আত্মবিশ্বাস থাকে, বাজেট নিয়ে ততটা দক্ষতা আমার নেই, তবে ক্ষুধা দারিদ্রতা দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি সবার মত বুঝি, সেই হিসাবে কিছু বলা।
যাইহোক, শুরুতে যে কথা বলছিলাম, টেক্সি চালক সরকারের নির্দেশ মোতাবেক মাস্ক পরা ও নিজের সচেতনতা নিয়ে গর্ববোধ করার কথা। সে মাস্ক পড়েছে আর বলছে অনেক প্যান্ট পরা ভদ্র লোক মাস্ক ব্যবহার করছেনা। অথচ গত দুই মাসে একদিনও সে মাস্ক ছাড়া চলেনি। সেই সময় আমি জানতে চাইলাম, এই মুহূর্তে সে মাস্ক পড়ছে কিনা? সে আমার দিকে তাকিয়ে প্রমাণ করছে মাস্ক পরেছে। কঠোর হয়ে বললাম, কে বলেছে তোমাকে মুখ থেকে এক ইঞ্চি বা নাক থেকে আড়াই ইঞ্চি নিচে মাস্ক রাখতে! এটাকে কি মাস্ক পরা বলা হয়? পরে তার কথায় বুঝতে পারলাম, সে জানেনা মাস্ক পরা মানে নাক মুখ ঢেকে রাখা। যদিও ড্রাইভারের এই দৃষ্টান্তের সাথে শিরোনামের প্রাসঙ্গিকতা নেই, তারপরেও বলছি, শুধু ঐ ড্রাইভার নয় অনেক মানুষের মধ্যে বিভিন্নক্ষেত্রে সচেতনার অভাব রয়েছে, শৃঙখলা, নিয়মনীতি, সামাজিক মূল্যবোধ ইত্যাদি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। পরিশেষে আগত নববর্ষের অগ্রীম শুভেচ্ছা। মানে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া অর্থবছরের কথাই বলছিলাম।

লেখক : শিক্ষক ও সাহিত্যিক