আজ চৈত্র সংক্রান্তি ও বর্ষবিদায়

812

বাংলা ক্যালেন্ডারে মুদ্রিত বর্ষপরিক্রমায় আজ শনিবার বছরের শেষ মাস অর্থাৎ চৈত্রের শেষ দিন। দিনের সূর্য অস্তমিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বর্ষপঞ্জি থেকে বিদায় নেবে ১৪২৫ বঙ্গাব্দ। বর্ষবিদায় নেয়ার এ দিনটিকেই বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি। পরদিন রবিবার পহেলা বৈশাখ-নববর্ষ ১৪২৬ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। চৈত্র সংক্রান্তিতে জীর্ণ পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে পহেলা বৈশাখে নববর্ষ বরণের নানা আয়োজনে মাতোয়ারা হবে সমগ্র বাঙালি জাতি।
আবহমান কাল থেকেই বছরের শেষ দিন হওয়ায় চৈত্র মাসের এ দিনটিকে বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি। বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকজ উৎসবের অন্যতম দিনও বটে। অসা¤প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ বাঙালি জাতির কাছে কালের পরিক্রমায় চৈত্র সংক্রান্তি এক বৃহত্তর লোক উৎসবে পরিণত হয়েছে। পুরাতন জীর্ণতাকে বিদায়ের আয়োজন থাকে চৈত্র সংক্রান্তিতে। পরদিন সকালে পূব আকাশে উদিত সূর্যের কিরণ নতুন স্বপ্ন-আশায় রাঙিয়ে দেবে বাঙালির মন। নতুন সম্ভাবনাকে হাতের মুঠোয় আনার সংকল্প বাস্তবায়নে যাত্রা শুরু করবে গোটা জাতি। সেই হিসেবে আজ ও আগামীকাল দু’দিন উৎসবমুখর থাকবে বাংলার আনাচ-কানাচ। দুদিনের উৎসবমুখরতা শেষ হবে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।
বাংলা উইকিপিডিয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, চৈত্র থেকে বর্ষা মানে আষাঢ়ের প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্যের উত্তাপ যখন তীব্রতর থাকে থাকে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও বৃষ্টির আশায় কৃষিজীবী সমাজ বহু অতীতে চৈত্র সংক্রান্তি উদ্ভাবন করেছিল। এক সময় তা গ্রামীণ জনপদের প্রধান উৎসব হিসেকে সীমাবদ্ধ থাকলেও কালের প্রবাহে একসময় নাগরিক জীবনেও স্থান করে নেয়। এ উপলক্ষে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে নানা ধরনের মেলা ও উৎসবের আয়োজন করা হয়। সাংস্কৃতিক নানা আয়োজনের মধ্যে প্রধানত মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে শুরু করে হালখাতার জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাজানো, সঙ্গীত, আবৃত্তি, সঙযাত্রা ও নৃত্যানুষ্ঠান থাকে।
তবে, বিশুদ্ধ পঞ্জিকা অনুসারী বিশেষত সনাতন ধর্মালম্বীরা চৈত্র সংক্রান্তি পালন করবেন আগামীকাল রবিবার। এদিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আয়োজন করা হয় শুভ হালখাতার। বাংলাদেশ ও প্রতিবেশি ভারতের সনাতন ধর্মালম্বীরা এদিন আয়োজন করেন শিব-কালীর পূজা। কোনও অঞ্চলে চড়ক পূজা আবার কোনও অঞ্চলে হয় ক্ষেত্রপাল পূজা। কারণ চৈত্র সংক্রান্তির পূণ্য-লগ্নে শিব ও কালীর মিলন হয় বলে এ ধর্মের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন। ক্ষেত্রপাল মানে ক্ষেত্রের বা ও সৃষ্টির অধিপতি। তিনিই মঙ্গলের ধারক ও বাহক। এ কারণে দেবতা শিবের আরেক নাম মঙ্গলেশ্বর। শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘যত্র জীব তত্র শিব’। তার মানে যেখানে জীবের অস্তিত্ব থাকবে সেখানেই শিবের উপস্থিতি থাকবে। ওই ধর্ম-বিশ্বাস অনুযায়ী, পৃথিবী-ক্ষেত্র বা প্রকৃতি রূপে কালী আর ক্ষেত্রের অধিপতি হলেন শিব। তাই চড়ক পূজা হল, শিব ও কালীর প্রতীক। চড়ক পূজার দন্ডায়মান গাছটি শিব আর ঘুরানোর চড়ক হল কালীর প্রতীক। শিব আর কালীর মিলনের প্রতীকি রূপেই চড়ক পূজা।
এদিকে, নগরীর ডিসি হিল, সিআরবি শিরীষতলা, চবি চারুকলা ইনস্টিটিউট, নেভাল-২, জেলা শিল্পকলা একাডেমিসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের আয়োজনে আজ শনিবার বাংলা বর্ষ বিদায়ের অনুষ্ঠানমালা উদযাপিত হচ্ছে। ‘সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদ, চট্টগ্রাম’-এর আয়োজনে ডিসি হিলে ৪০তম বর্ষবিদায় অনুষ্ঠান শুরু হবে আজ বিকাল চারটায়। ‘নববর্ষ উদযাপন পরিষদ, চট্টগ্রাম’- এর উদ্যোগে সিআরবি চত্বরে শিরীষতলায় আজ বিকাল চারটায় বর্ষবিদায়ের অনুষ্ঠানমালা শুরু হবে। জেলা শিল্পকলা একাডেমি থেকে আজ বিকাল চারটায় র‌্যালির পর অনিরুদ্ধ মুক্তমঞ্চে বর্ষবিদায়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলবে। চট্টল ইয়ুথ কয়ারের আয়োজনে কলেজিয়েট স্কুল প্রাঙ্গণে আজ বিকাল চারটায় শিশু উৎসব অনুষ্ঠিত হবে।

চৈত্র সংক্রান্তিতে
পাচনের
উৎসব
এম এ হোসাইন
বাঙালি এবং নৃতাত্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাচন খাওয়ার রেওয়াজ বেশ পুরানো। বৈশাখ উপলক্ষে চৈত্র সংক্রান্তি অর্থাৎ চৈত্রের শেষ দিনে সব ধরনের সবজি দিয়ে রান্না করা নিরামিষ তরকারি হলো পাচন। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে পাহাড়ের আদি বাসিন্দাদের ঘরে ঘরে চলে পাচন খাওয়ার উৎসব। সমতলে হিন্দু স¤প্রদায়ের মধ্যে আগে পাচন খাওয়ার প্রচলন থাকলেও এখন ধীরে ধীরে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবার ঘরেই রান্না হচ্ছে পাচন। প্রচলিত আছে, ১০৮ ধরনের সবজি দিয়ে এই পাচন রান্না করা হয়। আঞ্চলিক ভাষায় একে ‘আডোরা’ বলা হয়।
পহেলা বৈশাখের আগের দিন বিভিন্ন ধরনের সবজি দিয়ে রান্না করা নিরামিষ পাচন খাওয়ার রেওয়াজ অনেক আগের। প্রতিবছর চৈত্রসংক্রান্তির আগে অন্তত দুইদিন থেকে চট্টগ্রামের কাঁচাবাজারগুলোতে পাচনের সবজি বিক্রির ধুম পড়ে যায়। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বাজারে পাচনের সবজির পদগুলো বিক্রি হচ্ছে হরদম। বছরে শুধুমাত্র একবার পাচনের জন্য বিক্রি হয় এমন সবজির মধ্যে আছে কাট্টুস, কাঁচা কাঠাল, তারা, ডুমুর, তিতা বেগুন, কলার খাড়া, গিমাশাক ইত্যাদি সবজি দেখা যাচ্ছে প্রতিটি বাজারে। শুধু বাজারে নয়, রাস্তার পাশের ভ্রাম্যমাণ রিকশা ভ্যানেও বিক্রি হচ্ছে পাচনের সবজি।
ব্যাটারি গলিতে পাচনের সবজি বিক্রি করা রাজু নাথ বলেন, সাজানা, কাঁচা আম, কাঁচা কলা, মূলা, পটল, গাজর, লাউ, তিতা করলা, টমেটো, কাঁকরোল, বরবটি, ঢেঁড়স, কচুর ছড়া, পেঁপে, মিষ্টিকুমরা, শালবন, শসা, চালকুমড়া, আলুসহ বারোমাসী বিভিন্ন সবজি। শাকের মধ্যে আছে লাউ ও মিষ্টি কুমড়ার শাক, কচুরলতি, মারিশ শাক, পুঁই শাক, কলমি শাক ও ঢেঁকি শাক। বিভিন্ন ধরনের ডাল দিয়ে পাচনের আইটেম করা হয়েছে। তিনকেজি ওজনের প্রতিটির দাম ২শ টাকা। ১০৮ রকমের পদ বলা হলেও পাচনে যত বেশি পদ ব্যবহার করা যায়, ততই সুস্বাদু হয়। এজন্য এখন সবজির সঙ্গে শাকও মানুষ কিনছেন।
গতকাল শুক্রবার নগরীর আসকারদিঘীর পাড়, ব্যাটারি গলি, হাজারী লেন, জামালখান ও দেওয়ান বাজার এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, সচরাচর বাজারে মেলে না এমন অনেক সবজি বিক্রি হচ্ছে কাঁচা সবজির দোকানে। সচরাচর বিক্রি হওয়া সবজির সাথে বিক্রি হচ্ছে এসব সবজিও। কেজি দরে সবজিগুলো বিক্রি হলেও পাচনের পদের সবজিগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিক্রি হচ্ছে লট হিসাবে। অনেকগুলো সবজির টুকরো একটি পলিথিন ব্যাগে নিয়ে লট করা হচ্ছে। একশ, দেড়শ ও দুইশ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এসব পলিথিনের প্যাকেট ভর্তি লট। পাচনের এসব সবজি কেনার জন্য ক্রেতাদের ভিড়ে ঠাসা দেখা গেছে অনেক দোকানও।
দেওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা বিপ্লব বলেন, এখন চৈত্র সংক্রান্তির পাচন দুইদিন রান্না হয়। সাধারণত ১৩ এপ্রিল চৈত্রসংক্রান্তি হিসাব করে সেদিন পাচন রান্না করে। আবার দিনপঞ্জিকা অনুসারে অধিকাংশ সনাতন ধর্মাবলম্বী একদিন পর পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে। এর ফলে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পরিবারে পাচন রান্না হয় ১৪ এপ্রিল। পাচনের আইটেমগুলো নিয়ে দোকান সাজানো হয়েছে। কেজিপ্রতি ৭০ টাকা করে পাচনের সবজি বিক্রি করছি।
শুধু পাচনের সবজি নয়, বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ডালও। মসুর ডাল, খেসারি ডাল, মটরশুটি, শুকনো ফেলন ডাল এমনকি শিমের বিচিও বিক্রি হচ্ছে পাচন রান্নার জন্য।
ঘাটফরহাদ বেগ এলাকার বাসিন্দা বিমল দাশ বলেন, আগে চৈত্র সংক্রান্তির আগে হাজারী লেনে পাচনের সবজি পাওয়া যেতো। এখন সব জায়গায় পাচনের সবজি পাওয়া যায়। ১০৮ রকমের পদ দিয়ে রান্নার প্রচলন থাকলেও অনেকে কম দেন, অনেকে আবার তরকারিতে এর চেয়েও বেশি সবজি দেন। বিভিন্ন ধরনের ডালও ব্যবহার করা হয়। অনেকগুলো আইটেম একসাথে হওয়াতে এর স্বাদটাও অসাধারণ।