আগুনঝরা মার্চ

55

একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার/ সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার/ তোমার স্বাধীনতা গৌরব সৌরভে/ এনেছে আমার প্রাণের সূর্যে রৌদ্রেরও সজীবতা/ দিয়েছে সোনালি সুখী জীবনের দৃপ্ত অঙ্গীকার/ সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার/ তোমার ছায়া ঢাকা রৌদ্ররে প্রান্তরে/ রেখেছি অতল অমর বর্ণে মুক্তির স্নেহ মাখা/ জেনেছি তুমি জীবন মরণে বিমুগ্ধ চেতনার/ সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার…
বাঙালি জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার পূর্বাহ্নে একাত্তরের ১৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আলোচনা ‘নিষ্ফলা’ হওয়ার পথ ধরে। আর তাতেই বন্ধ হয়ে যায় সমঝোতার সব পথ। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা ছাড়া বাঙালির সামনে কোন পথ খোলা ছিল না। ‘নরঘাতক’ জেনারেল টিক্কা খানরা গোপন বৈঠক করে নির্বিচারে বাঙালি নিধনে ‘অপারেশন সার্চ লাইটের’ পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। যদিও চতুর্থ দফা বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু বলেন, আলোচনা আরও হবে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনা হচ্ছে-এই মর্মে একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশের সব খবর আমার জানা আছে।’
বাংলার আপামর জনতা বুঝতে পারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের আলোচনায় বসাটা ছিল সম্পূর্ণ লোক দেখানো ও প্রহসনমাত্র। আলোচনার আড়ালে পাকিস্তানে স্বৈরশাসকরা বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়ার কৌশলে নিয়েছিল। এরই মধ্যে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নির্বিচারে বাঙালি নিধনের সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবদুল হামিদ ও জেনারেল টিক্কা খানের এক বৈঠক থেকেই অপারেশন সার্চলাইটের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়।
একাত্তরের একুশ মার্চ ছিল ঘটনাবহুল উত্তেজনাপূর্ণ একটি দিন। আন্দোলনে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহবান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু সংবাদপত্রে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ‘একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য জনগণ যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। তাই মুক্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে এ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে আমি বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রতি আহবান জানাই। এবারের সংগ্রাম প্রতিটি শহর, নগর, বন্দর ও গ্রাম। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা বাংলাদেশের দাবির পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ, সারা বিশ্বের স্বাধীন জাতি কীভাবে স্বীয় লক্ষ্য পানে এগিয়ে যেতে পারে, বিশ্বের সামনে বাংলার মানুষ আজ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।’
অসহযোগ আন্দোলনের ঊনবিংশ দিবসে একাত্তরের অগ্নিঝরা এদিনই বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতি দিয়ে ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাব উপলক্ষে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেন। এদিন বিহারী ও পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাঙালির সংঘর্ষ হয়েছে মিরপুর, চট্টগ্রাম, পার্বতীপুর ও সৈয়দপুরে। এতে আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক বাঙালি। সারাদেশে এক উত্তপ্ত পরিবেশ বিরাজ করতে থাকে। ক্ষুব্ধ বাঙালিরা নেমে আসে রাজপথে। যুদ্ধের প্রস্তুতি চলতে থাকে দেশজুড়ে। কিন্তু তখনও পূর্ব পাকিস্তানবাসী বুঝতে পারেনি যে অতর্কিতেই তাদের ওপর চালানো হবে ‘অপারেশন সার্চ লাইট।’ জেনারেল ইয়াহিয়া খান এদিন তার সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল হামিদ খান, টিক্কা খান, জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল ওমর প্রমুখকে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক অভিযান পরিচালনার চুড়ান্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। অপরদিকে, প্রায় প্রতিদিনই সর্বনিম্ন ছয়টি থেকে সর্বোচ্চ ১৭টি পর্যন্ত ফ্লাইটে করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও যুদ্ধের রসদ নিয়ে আনা হচ্ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। একইসাথে স্থল ও বিমান শক্তি দ্বিগুণ করে।
একাত্তরের এইদিনে ছাত্র ইউনিয়ন এক ব্যতিক্রমধর্মী কর্মসূচি পালন করে। তাদের উদ্যোগে গঠিত গণবাহিনী দশদিনের প্রশিক্ষণ শেষ করে রাজপথে এক শোভাযাত্রা বের করে। গণবাহিনীর সকল সদস্যই সেদিন ডামি রাইফেল নিয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন। ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি ছিলেন নুরুল ইসলাম নাহিদ (বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী)। তার নেতৃত্বে এ শোভাযাত্রা বের হয়। সেসময় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমও (বর্তমানে সিপিবি সভাপতি) সার্বক্ষণিক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন এবং ছাত্রদের সংগঠিত করতে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন।