আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের উজ্জ্বল নক্ষত্র

168

যাদের জীবন শুধু সংগ্রামের, ত্যাগের যারা দিতে জানে বিনিময়ে কিছু নিতে জানে না প্রকৃত অর্থে তারাই মানুষ, যাদের অনুস্মরণ করলে প্রকৃত মানুষ হওয়া যায়, সেরকম একজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। চট্টগ্রামের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের প্রিয় বাবু ভাই। নানা ঝড়ঝাপ্টার মাঝেও দলীয় আদর্শে তিনি ছিলেন অবিচল, দলীয় নেতাকর্মীদের নিকট হয়ে উঠেছিলেন বড় অবলম্বন। কেবল রাজনীতিই নয়, ব্যবসা বাণিজ্য এবং শিল্পায়নের মাধ্যমেও দেশের মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করেছেন তিনি। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেশের বেকারত্ব হ্রাসে সহায়তা করেছেন। আখতারুজ্জামন চৌধুরী বাবু বহু বছর ধরে সক্রিয় ছিলেন চট্টগ্রামের রাজনীতিতে। দীর্ঘ সময় ধরে ছিলেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন চারবার। নবম জাতীয় সংসদে তিনি ছিলেন পাট বস্ত্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। ১৯৪৫ সালে আনোয়ারা হাইলধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তার পিতার নাম নুরুজ্জামান চৌধুরী। তিনি ছিলেন আইজীবী এবং জমিদার। তাঁর মাতার নাম খোরশেদা বেগম। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে পটিয়া হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে এই বছরই ঢাকা নটরডেম কলেজে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে পড়ার সময় তিনি বৃত্তি পেয়ে আমেরিকার ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। পরে তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে বিজনেস এডমিটিস্ট্রেশনে পড়াশোনা করেন। ওখান থেকে এসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফিরেন। ১৯৬৫ সালে তিনি বড় ভাইয়ের সাথে ব্যবসায় যোগ দেন।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আলহাজ্ব আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তার পাথরঘাটাস্থ জুপিটার হাউজ থেকে সংগ্রাম কমিটির কর্মকান্ড পরিচালিত হত। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে আসার পর জুপিটার হাউজ থেকে সাইক্লোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তার বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভারতে যান এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। তিনি প্রথম লন্ডনে যান। সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে আমেরিকায় যান। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণ পরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। তিনি ৭২ সালের সংবিধানের অন্যতম স্বাক্ষরকারী। স্বাধীনতার পর ১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ২০০৯ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। ৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং পরবর্তীতে দলের পুনরুজ্জীবন ও পুনর্গঠনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেন। কেবল রাজনীতিতেই নয়, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা ছিলেন। স্বাধীনতার পূর্বে তিনি বাটালী রোডে রয়েল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। একই সাথে তিনি বড় ভাইয়ের কারখানাগুলোও দেখাশোনা করতেন। পরবর্তীতে আখতারুজ্জামান বাবু আসিফ স্টিল মিল, জাভেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, প্যান আম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিথেটিক প্রোডাক্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। ভ্যানগার্ড স্টিল মিল, সিনথেটিক রেজিন প্রোডাক্ট ক্রয় করে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের প্রথম দু’দশকে জামান শিল্পগোষ্ঠীর গোড়াপত্তন করেন। তিনি বিদেশি মালিকানাধীন আরামিট মিল ক্রয় করে সেটিকে সুদৃঢ় ভিত্তিক উপর দাঁড় করান। বাংলাদেশে বেসরকারি ব্যাংকিং সেক্টর প্রতিষ্ঠায় তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তিনি দেশে দ্বিতীয় প্রাইভেট ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্সিংয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল) এর উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স¤প্রতি তিনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পুননির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দেশের ব্যবসায়ী সমাজের মুখপাত্র ও ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি দু-দফায় চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৮৮ সালে তিনি দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠক এফবিসিসিআইর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওআইসিভুক্ত দেশসমুহের চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্রæপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি যিনি এই মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ব্যক্তি জীবনে ৩ পুত্র ও ৩ কন্যা সন্তানের জনক। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একজন সমাজহিতৈষী, দানবীর ও জনদরদী ছিলেন। ১৯৬৭ সাল থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। স্বাধীনতার পরেও তিনি হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং থানা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়ার বহু মসজিদ, মাদ্রাসা ও স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। আনোয়ারা ডিগ্রী কলেজ, হাইলধর রশিরুজ্জামান স্মৃতি শিক্ষা কেন্দ্র, বরুমচড়া বশরুজ্জামান উচ্চ বিদ্যালয়, আনোয়ারা যুগেস চন্দ্র মেমোরিয়াল স্টাট্র, ঝি.বা.শি উচ্চ বিদ্যালয়সহ আরো অনেক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বটতলী মোহছেন আউলিয়া ডিগ্রী কলেজ, চন্দনাইশ বরমা কলেজ, এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ, এ.জে.চৌধুরী ডিগ্রী কলেজ, রায়পুর উপক‚লীয় উচ্চ বিদ্যালয়সহ আনোয়ারা পশ্চিম পটিয়ার ও চট্টগ্রামে অনেক স্কুল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা দাতা সদস্য। এছাড়া ও বহু জনহিতকর কাজের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। আমি সৌভাগ্যবান, ধন্য আমার জীবন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মত এত বড় মাপের মহৎ হৃদয়বান জাতীয় নেতার সাহচর্য লাভের সুযোগ হয়েছে। বিশ্বস্থতার সহিত মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর অভিভাবকত্বে তাঁর সহিত রাষ্ট্রের সেবামূলক কাজ করেছি এবং তাঁর সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। তাঁকে নিবিড়ভাবে দেখেছি, মিশেছি। সুখ, দুঃখের সঙ্গী হয়েছি। আমি দেখেছি, তাঁর মধ্যে এক নরম প্রকৃতির হৃদয়, মানুষকে ভালবাসার উদার মন-মানসিকতা। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু সমস্ত লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসা¤প্রদায়িক বাংলাদেশে বিনির্মাণের অগ্র সৈনিক ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা উত্তর কালের সেই সব বিরল রাজনীতিবিদে অন্যতম। যিনি আওয়ামীলীগের দুঃসময়ে হাল ধরেছেন, রাজনীতি করেছেন নিজের অর্থ ব্যয় করে। একটা মানুষের সঙ্গে চলে যায় গোটা একটি পৃথিবী। কথাটি লিখেছেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখ্যোপাধ্যায়। আসলে সব মানুষই জীবনে নিজ নিজ ক্ষেত্র গড়ে তোলে আপন আপন ভূবন। আর যার কর্মে কীর্তিতে, মেধায়, মননে, স্নেহ, ভালবাসায় ও সখ্যতায় অনন্য স্বাক্ষর রেখে যায়। তারা সারা জীবন ধরে তৈরি করে এক একটি বিচিত্র ও বর্ণিল অনন্য পৃথিবী। অবিনাশী যৌথ স্মৃতির অংশীদার। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা বর্ষিয়ান আওয়ামীলীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিল এমনি এক অসাধারণ মহাপুরুষ। যার সঙ্গে সঙ্গে চলে গেছে বিশাল এক প্রাণবন্ত জগৎ। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে সংগঠন ও জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর জীবনী থেকে নতুন প্রজন্মের অনেক কিছু শেখার আছে। জীবনে অনেকবার মন্ত্রীত্বের সুযোগ পেয়েও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুতি হয়নি। তিনি অত্যন্ত দূরদর্শী ও বিচক্ষণ রাজনীতির ধারক ছিলেন। চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তিনি চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ছিলেন একজন রাজকীয় এবং বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব। রাজনীতিতে যেমন ব্যবসা, ব্যাংক, বীমা ও শিল্প স্থাপনে তিনি ছিলেন একজন ঈর্ষণীয় সফল ব্যক্তিত্ব। আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নেতা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÐের পর বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ও চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে তাঁর অবদান অপরিসীম। যেকোন কঠিন সময়ে দলের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত এক কর্মী। ক্রমেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগের একজন অভিভাবক। তাঁর মৃত্যু চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগকে শুধু অভিভাবকহীন করেনি, সামগ্রীক রাজনীতিতে একটি শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। যদিও তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, তবুও তিনি আমাদের অন্তরে চির জাগ্রত। আজ আমরা শ্রদ্ধাভাবে স্মরণ করি তাঁর স্মৃতি, অর্থপূর্ণ জীবন ও লালিত মূল্যবোধ।

লেখক : মরহুমের সাবেক একান্ত সচিব