অস্বাভাবিক চক্রে তাপমাত্রা

129


শিল্পায়নজনিত দূষণসহ পরিবেশবিধ্বংসী নানা কর্মকান্ডে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের গড় তাপমাত্রার মতই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাপমাত্রার পারদ ক্রমাগত চড়ছে। কেবল গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চল দেশগুলোতেই নয়, শীতপ্রধান ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও চলতি বছর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ঋতুচক্র বা কালের হিসাব-নিকাশ শিকেয় তুলে অস্বাভাবিক আচরণে অভ্যস্ত হতে থাকা প্রকৃতিও যেন এরইমধ্যে নির্মম প্রতিশোধের পথেই হাঁটতে শুরু করেছে। বছরজুড়েই অস্বাভাবিক চক্রে উঠানামা করছে তাপমাত্রার পারদ। এতে বজ্রপাতে প্রাণহানিসহ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি যেমন বেড়েছে, তেমনি মানুষ সহিষ্ণুতা ও মেজাজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে।
এদিকে শরতের মাঝামাঝি কিংবা ভাদ্রের শেষে উত্তর বঙ্গোপসাগরে বিরাজমান মৌসুমি বায়ু সক্রিয় ও প্রবল অবস্থায় ফিরে আসায় গত কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রামসহ দেশের প্রায় সব বিভাগেই কমবেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ সময় চট্টগ্রাম বিভাগের আওতাধীন উপকূলীয় এলাকাগুলো ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির কবলে পড়ে। এতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পারদেরও খানিকটা নিম্নমুখি প্রবণতা পরিলক্ষিত হলেও তা এই সময়ের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরেই ছিল।
গত শুক্রবার মৌসুমি বায়ু ফের দম হারিয়ে মাঝারি অবস্থায় ফিরতেই বৃষ্টিপাত তুলনামূলকভাবে কমে আসায় তাপমাত্রার পারদও ফের চড়তে শুরু করে। ওইদিন খুলনায় দেশের সর্বোচ্চ ৩৩ দশমিক চার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
একদিন পর গতকাল শনিবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পারদ এক লাফে আরও প্রায় দুই ডিগ্রি চড়ে গিয়ে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে ঠাঁই নিয়েছে রাজশাহীতে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা শনিবার থেকে বর্ধিত পাঁচ দিনের আবহাওয়ার অবস্থায় দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিয়েছেন।আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি নিরূপণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে এরইমধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রবণতা অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে। গরমপ্রধান মধ্যপ্রাচ্য কিংবা গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চল ছাড়াও ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানিসহ শীতপ্রধান ইউরোপও এবার পুড়েছে অস্বাভাবিক গরমে। অসহনীয় গরম স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে থমকে দিয়েছে। চলতি বছরেই ফ্রান্সের তাপমাত্রা ভঙ্গ করেছে বিগত ৪০ বছরের রেকর্ড। প্রতিবেশি দেশ ভারতের রাজস্থানে চলতি বছরের গত ১০ জুন সর্বোচ্চ ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। তিন বছর আগে অর্থাৎ ২০১৬ সালে ভারতের এই রাজ্যে একই পরিমাণ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। যা দেশটির ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত প্রকৃতির বৈরি আচরণের শিকারে পরিণত হয়েছে দেশটির বিভিন্ন রাজ্যের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। সেখানে মাথায় বাজ পড়ে প্রাণহানি যেমন বেড়েছে, তেমনি কালবৈশাখী মৌসুমে ঘূর্ণিঝড় ‘ফনী’র তান্ডবলীলা এবং বর্ষা মৌসুমে কেরালাসহ বিভিন্ন রাজ্যের বাসিন্দাদের দীর্ঘমেয়াদী বন্যার মোকাবেলা করতে হয়েছে। ঘটেছে প্রাণ ও সম্পদহানি। আর গরমপ্রধান মধ্যপ্রাচ্যের আবহাওয়া তো চলতি বছর পৃথিবীর তাপমাত্রার ইতিহাসকে নতুন উচ্চতায় দাঁড় করিয়েছে। গত ৮ জুন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। ওইদিন দেশটিতে ছায়ায় ৫২ দশমিক দুই ডিগ্রি এবং রোদে সর্বোচ্চ ৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
আবহাওয়া বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড মিটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবী ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। প্রায় সমস্ত স্থলভাগেই আরও বেশি মাত্রায় উষ্ণতা ও তাপপ্রবাহ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিস্থিতিতে যখন এমন অস্বাভাবিক অবস্থা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, তখন দেশে বিরাজমান আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতিকেও স্বাভাবিক নয় বলে মনে করছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। বরং চলতি বছরকে অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদরা অন্য বছরের চেয়ে ব্যতিক্রমও আখ্যা দিয়েছেন।
তারা বলছেন, চলতি বছরের গত আট মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পারদ স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত এক থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। এমনকি ভাদ্রের বিদায়বেলায় আবহাওয়ার যে আচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে তাও রীতিমত অস্বাভাবিক। বৃষ্টিস্নাত দিনগুলো বাদে শরতের এই সময়ে দিনের বেলা সূর্যের এতটা উত্তাপ বা তেজ থাকার কথা নয়।
অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. রুহুল কুদ্দুস পূর্বদেশকে বলেন, ‘চলতি বছর গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত গড়ে চার থেকে পাঁচ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়তি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আগস্টের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ৩১ দশমিক চার ডিগ্রি থাকার কথা সেখানে বেশিরভাগ দিনই তা ছিল ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। সেপ্টেম্বরের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহেও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। বৃষ্টিপাতে হেরফের হচ্ছে। বাতাসের আর্দ্রতাও বেশি। বাতাসে এখন জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি ৮৫ থেকে ৯৩ শতাংশ। এটাও স্বাাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। তাছাড়া, বাতাসের স্বাভাবিক গতিবেগ এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে, যা ঘণ্টায় মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। এসব কারণেও চলতি মৌসুমে স্বাভাবিকভাবে যে ধরনের উষ্ণতা থাকার কথা, তার চেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে।’
সাত মাসে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছে দুইশ’ ৪৬ জন :
বিগত ২০১৬ সালে সরকারিভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় জায়গা করে নেয়া বজ্রপাত কিংবা মাথায় বাজ পড়ে দেশে চলতি বছরের গত সাত মাসেই (ফেব্রুয়ারি -আগস্ট) প্রাণ হারিয়েছে দুইশ’ ৪৬ জন। এর মধ্যে গত জুন (জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়) মাসেই সবচেয়ে বেশি ৬৬ জনের মৃত্যু ঘটেছে। আহত হয়েছে অন্তত ৯৭ জন। বজ্রপাত নিয়ে কাজ করা ‘সেভ দ্য সোসাইটি এন্ড থান্ডারস্ট্রর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম’ নামে দেশের একমাত্র বেসরকারি সংস্থাটি গতকাল শনিবার সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছে।
তাদের তথ্যমতে, চলতি বছর গত ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সাত মাসেই বজ্রপাতে প্রাণহানির এসব ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে ১১জন, মার্চে পাঁচ জন, এপ্রিলে ২০ জন, মে মাসে ৬০ জন, জুনে ৬৬ জন, জুলাইয়ে ৪৭ জন এবং আগস্টে ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ৩০ জন নারী, ছয়জন শিশু, আটজন কিশোর-কিশোরী, এবং দুইশ’ দুইজন পুরুষ।
যেভাবে বাড়ছে গড় তাপমাত্রা :
আবহাওয়া অধিদপ্তরের রেকর্ড বলছে, দীর্ঘ কয়েক দশক ধরেই প্রধানত গ্রীষ্মকালীন মাসগুলোতে গড় তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। রেকর্ড অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ মাসে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে শূন্য দশমিক ৭৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এপ্রিলে শূন্য দশমিক ৫৮ এবং মে ও জুন উভয় মাসেই তাপমাত্রা বেড়েছে গড়ে শূন্য দশমিক ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জুলাই মাসে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে যথাক্রমে এক ডিগ্রি ও শূন্য দশমিক চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। একইভাবে আগস্ট মাসেও সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল যথাক্রমে এক দশমিক আট ডিগ্রি ও শূন্য দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস। এভাবে গত কয়েক বছর ধরেই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা টানা চার অব্যাহত থাকলে তা জলবায়ুতে প্রভাব ফেলে।
অধিদপ্তরের হিসাবে, বছরজুড়ে মাসওয়ারি দেশে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা থাকার কথা যথাক্রমে জানুয়ারিতে ২৫ দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস, ফেব্রুয়ারিতে ২৭ দশমিক আট, মার্চ মাসে ৩১ দশমিক ছয়, এপ্রিলে ৩৩ দশমিক দুই, মে মাসে ৩২ দশমিক ৯, জুনে ৩১ দশমিক ৯, জুলাইয়ে ৩১ দশমিক এক, আগস্টে ৩১ দশমিক চার, সেপ্টেম্বরে ৩১ দশমিক পাঁচ, অক্টোবরে ৩১ দশমিক পাঁচ, নভেম্বরে ২৯ দশমিক পাঁচ এবং ডিসেম্বরে ২৬ দশমিক চার ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি :
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের গড় তাপমাত্রার পারদ ক্রমাগতভাবে চড়ার প্রবণতা সরাসরি প্রভাব ফেলবে জলবায়ুতে। আর তাতে নানাধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে মানুষের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিও অনেকাংশে বেড়ে যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
চুয়েটের সাবেক ও বর্তমানে ইউএসটিসির উপাচার্য ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম পূর্বদেশকে বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের নানামুখি প্রভাব ইতিমধ্যেই প্রাকৃতিক পরিবেশ ও আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতিতে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। এর মধ্যে তাপমাত্রা বা উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত প্রভাবটিই এখন বেশি চোখে পড়ছে।
শীতপ্রধান অঞ্চলগুলোতে যেমন উচ্চ তাপমাত্রা অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করছে তেমনি গ্রীষ্মমন্ডলীয় ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলগুলোতেও তাপদাহ, ঘুর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াস, বজ্রপাত ও ভুমিকম্পের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ ও ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে গত কয়েকবছরে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেড়েছে। রয়েছে ভূমিকম্প ও সুনামির ঝুঁকিও। সবমিলিয়ে প্রকৃতি ক্রমান্বয়ে মানবসভ্যতার জন্যই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
অপরদিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, উচ্চমাত্রার তাপপ্রবাহ, তীব্র শৈত্যপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা ইত্যাদি মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী ঘটনা। দুর্যোগে বিপর্যস্ত পরিবারের জীবন-জীবিকা হারানোর মানসিক যন্ত্রণা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলে। এতে মানুষ ইন্দ্রিয়গুলোর সহজাত সহনশীলতা ও মেজাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। যে কোনও ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মানুষের শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতার পাশাপাশি সামাজিক উৎপাদনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতাও কমিয়ে ফেলে।
এছাড়া উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে কীটপতঙ্গবাহিত বা সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়তে পারে। উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনে ভেক্টর অণুজীব যেমন মশা, মাছি, ইঁদুর অনুকূল পরিবেশ পেয়ে স্বাভাবিক জীবনকাল বৃদ্ধির পাশাপাশি অধিকহারে বংশবিস্তার করবে। তার মানে, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, কালাজ্বরের মত সংক্রামক রোগের প্রকোপ বাড়বে।